ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ
অনুবাদক হিসেবে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন .....
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যারা যুগে যুগে সমৃদ্ধ করে তুলেছে, বাংলা সাহিত্য যাদের কাছে ঋণী,সেই শক্তিমান লেখকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(১৮২০-১৮৯১)। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভা। বিদ্যাসাগর আসলেই বিদ্যার সাগর।
পাণ্ডিত্য,উদারতা,সমাজ সংস্কার,অনুবাদ,মৌলিক রচনায় তিনি সিদ্ধহস্থ ছিলেন। দেশের শিতি লোকদের সম্মুখে সৎ সাহিত্যের আদর্শ তুলে ধরে জাতীয় জীবনকে সুন্দর রূপে গড়ে তোলার মানসে তিনি অন্য ভাষার সাহিত্য থেকে কয়েকটি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন।
অনুবাদ একটি বিশিষ্ট শিল্পকর্ম। ভাষা সাহিত্যের গঠনকালে অনুবাদকর্মের দ্বারাই সাহিত্যের শ্রী বৃদ্ধি হয়। বাংলাা অনুবাদ সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর আগেও বাংলা গদ্যে অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তা নাবিধ গুণে সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠে নি। পূর্ণায়তন সাহিত্য গ্রন্থের অনুবাদ করে তিনিই প্রথম বাংলা সার্থক অনুবাদ সাহিত্যের গোড়াপত্তন করেন।
“ঈম্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের অস্থির রূপটিকে স্থির করে দিয়ে গেছেন। ”
উৎস: লাল নীল দীপাবলী: হুমায়ুন আজাদ: পৃষ্ঠা: ৯৯
বিদ্যাসাগর যখন সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তখন তাঁর সম্মুখে এমন কোন বৃহৎ জীবনাদর্শ ছিল না যার প্রেেিত তিনি সমশ্রেণির সাহিত্য রচনা করবেন। তাই কুসংস্কারপূর্ণ বাঙালি সমাজে মহৎ জীবন প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি অনুবাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, বিদ্যাসাগর একজন মস্ত বড় লেকক হওযা সত্ত্বেও একজন প্রখ্যাত অনুবাদক। “. . . যথার্থ বিচারে তাকে কেবল অনুবাদক নয়,বরং পুনঃস্রষ্টা বলা যেতে পারে।
উৎস: বাংলা ভাষা – সাহিত্যে উল্লেখ্য: মহাম্মদ দানীউল হক;পৃষ্ঠা:৭৬
তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি প্রকাশক গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ অনুবাদমূলক রচনা। বিদ্যাসাগরের অনুবাদকর্মগুলো হলÑ
১. বাসুদেব চরিত
২. বেতাল পঞ্চবিংশতি
৩. বাঙ্গালা ইতিহাস (২য় ভাগ)
৪. শকুন্তলা
৫. মহাভারত(আদিপর্ব
৬. সীতার বনবাস
৭. ভ্রান্তিবিলাস
৮. চরিত জীবনী
৯. কথামালা
১০. বোধোদয়
নিম্নে এ অনুবাদকর্মগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
১.বাসুদেব চরিত: ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রকাশ করেছেন আগে কিন্তু তার আগে বাসুদেব চরিত লিখেছেন। এটি ভাবানুবাদ। মহাভারতের কৃষ্ণলীলার ভাবানুবাদ। এ সম্পর্কে তাঁর জীবনচরিতকার বিহারীল বলেন,“ ইহা অনুবাদ বা অবলম্বন যাহা হউক,লিপিচাতুর্যে এবং ভাষা সৌন্দর্যে মূল সৃষ্টি সৌন্দর্যের সমীপবর্তী।
উৎস: বিহারিল রচনাসমগ্র।
২.বেতাল পঞ্চবিংশতি: এটি তাঁর ২য় অনুবাদ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ফুল্লজা লালের ‘বৈতালপচ্চীসী’ শীর্ষক হিন্দী গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এতে যতি চিহ্নের পূর্ণ ব্যবহার রয়েছে।
এ গ্রন্থ অবয়ী হিন্দু যুগে নরনাররি শঠতা,ভ্রষ্ঠতা,কামুকতা এবং উপপতি, উপপতœীর বাহুল্য অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। বেতালের একটি উক্তিÑ “ এই মায়াময় সংসার অতি অকিঞ্চতকর। ইহাতে লিপ্ত থাকিলে কেবল জন্ম মৃত্যু পরম্পরা রূপ দুর্ভেদ্য শৃঙখলে বদ্ধ থাকিতে হয়। ”
তাঁর অনুবাদের ভাষা শৈলীতা দেখে এজন্যই হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম গদ্য শিল্পী”
উৎস: সাহিত্য কথা অনুবেদন: মুহাম্মদ দানীউল হক: পরিশিষ্ট বিদ্যাসাগরের গদ্য রচনা।
৩.বাঙ্গালার ইতিহাস (২য় ভাগ):বিখ্যাত লেখক জনকার্ক মার্শমান এর “ঙঁঃষরহবং ড়ভ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ ভড়ৎ ঃযব ঁংব ড়ভ ুড়ঁঃয রহ ওহফরধ” এই গ্রন্থের শেষ নয় অধ্যায় অবলম্বনে তিনি ‘বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’ রচনা করেন।
এটি ১৮৪৮ সালে রচনা করেন। সরস অনুবাদের জন্য ছাত্র সমাজের কাছে এটি বড়ই আদরণীয় ছিল। ভাষা পরিচ্ছন্ন ভঙ্গিমার জন্য এই বইয়ের কোন কোন অংশ কেউ কেউ আবৃত্তিও করত।
৪. শকুন্তলা: বিদ্যাসাগর কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটক অবলম্বনে শকুন্তলা গ্রন্থটি অনুবাদ করেন। এটি ১৯৫৪ সালে তিনি অনুবাদ করেন।
বস্তুত শকুন্তলা দ্বারই তিনি পাঠক সমাজে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। যদিও এর আগে তাঁর অনেক গ্রন্থ অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে। এর ভাষাশৈলী ছিল অপূর্ব। যেমন- “রাজা,দেখিয়া শুনিয়া,প্রীত ও চমৎকৃত হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন,এই সেই কণ্বতনয়া শকুন্তলা! মহর্ষি অতি অবিবেচক ;এমন শরীরে কেমন করিয়া বঙ্কল পরাইয়াছেন। ”
বিনয় ঘোষ বলেন, “শকুন্তলার ভাষা সৌন্দর্র্যে মুগ্ধ হইয়া পাঠক বারবার ইহা পড়িত।
”
উৎস: বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ।
৫.মহাভারত: এটি তিনি ১৯৩০ সালে অনুবাদ করেন । মহাভারতের উপক্রমণিকা অংশ অর্থাৎ আদি পর্ব অনুবাদ করেন। এর পর সংস্কৃত ভাষা থেকে অনুবাদ করা সম্পূর্ণ রপ্ত করে ফেলেন।
৬. সীতার বনবাস: ঈশ্বরচন্দ্র ১৯৬০ সালে সীতার বনবাস অনুবাদ করে বাঙালি জনমনে নৈতিকতার প্রবল ছাপ ফেলেন।
রামচন্দ্রের লঙ্কা বিজয়ের কাহিনী ও সীতার পরিণাম অবলম্বনে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন। সে যুগে এই গ্রন্থটি পাঠ্যপুস্তক রূপে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পরিচিত ছিল। সাহিত্যগুণ বাদ দিলেও এর ভাষা সৈকর্য,শব্দ চয়ন,পদবিন্যাস,সমাস,সন্ধি অলংকারের যথোপযুক্ত ব্যবহার করেছেন বলে এটি আজও স্মরণীয়। এর একটি চরণÑ “ . . .এই সেই জন্মস্থান মধ্যপথ প্রস্রবণ গিরি,এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চারমান জলধরমণ্ডলীযোগেনিরন্তও নিবিড় নীলিমায় অলকৃত। ”
৭. ভ্রান্তিবিলাস: শেক্সপীয়রের ‘ঞযব ঈড়সবফু ড়ভ ঊৎৎড়ৎং’ গ্রন্থ অবলম্বনে ভ্রাšিতবিলাস গ্রন্থটি ১৮৬৯ সালে রচনা করেন।
নাটকীয় কাহিনীকে সম্পূর্ণ নিজের সৃষ্টিশীলতায় গদ্য গ্রন্থে প্রঞ্জল করে তুলেছেন। গ্রন্থটিতে সরসতা সঞ্চারিত হয়েছে।
যেমন: “ বিদ্যাধর চিরঞ্জীবকে বলিল,বাবু! তোমার হাতটা দাও, নাড়ীর গতি কিরূপ দেখিব। চিরঞ্জীব যৎপরোনাস্তি কুপিত হইয়া বলিলেন,এই আমার হাত তুমি কানটি বাড়াইয়া দাও। ”
৮.চরিত জীবনী: বাঙালি পাঠকদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য বিদ্যাসাগরের এই গ্রন্থটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
৯.কথামালা: বিদ্যাসাগর কেবল সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিকপও ছিলেন। ভাষার বৈচিত্রময় ব্যবহার তার এই গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।
১০.আখ্যানমঞ্জরী: নীতি উপদেশমূলক বিভিন্ন রকম রচনার সারগর্ভের দ্যোতক তাঁর এই আখ্যানমঞ্জরী গদ্য গ্রন্থটি।
আমারা জানি বিদ্যাসাগরের কোন অনুবাদই বিদ্যাসাগরের হুবহু অনুবাদ নয়। এজন্য তাঁর অনুবাদকে ম্যেলিক অনুবাদ বলা যায়।
বিদ্যাসাগরের অনুবাদ সম্পর্কে প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই বলেন, “ . . . তাঁর ভাষাতে সে কারণে একটা রচনাশলীর পরিচয় পরিচয় পাওয়া যায়। ”
উৎস: বাংলা সাহিত্যেও ইতিবৃত্ত (১৯৬৮)
তাই বলা যায়, এ সমস্বত অনুবাদমূলক গ্রন্থেও সাথে যেমন তাঁরমৌলিকতা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি এসব গ্রন্থেও মাধ্যমেবাংলা ভাষা শৈশবকে পেরিয়ে কৈশোরত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। ভাষা সহজ,সরলরূপ পরিগ্রহ করেছে। আর এখানেই বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব এবং যার জন্য তিনি স্মরণীয় ও বরণীয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।