আমি নতুন কিছু পড়তে ভালবাসি
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকাঃ
যাকাতের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী সমাজ হতে দরিদ্রতা দূর করা। দারিদ্র্যতা মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্র বিশেষে তা কুফরী পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যে কোন সমাজ ও দেশের এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি হয় দারিদ্র্যতার ফলে।
পরিনামে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। বহু সময়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটে। অধিকাংশ অপরাধই সচরাচর ঘটে দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যাগুলির প্রতিবিধান করার জন্যে যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার। যে আট শ্র্রেণীর লোকের কথা পূর্বেই উলেখ করা হয়েছে, যাকাত লাভের ফলে তাদের দিনগুলি আনন্দ ও নিরাপত্তার হতে পারে।
যাকাত যথাযথভাবে আদায় ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে আজকের দিনেও এর মাধ্যমে দরিদ্রতা দূর করা সম্ভব।
কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, এক সময়ে যে যাকাত পদ্ধতি চালু ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারনে জাযিরাতুল আরবে যাকাত গ্রাহকের সন্ধান পাওয়া ছিল দূর্লভ, আজও সেই যাকাত ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বে দুঃস্থ, অভাবী ও নিস্ব লোকের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো- মুসলিম দেশগুলিতে আজ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় ও বিলি-বন্টনের ব্যবস্তা নেই। উপরন্তু বহু বিত্তশালী মুসলিমই যাকাত আদায় করেন না। যারা যাকাতের অর্থ প্রদান করেন তাদেরও বেশির ভাগই বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিতভাবে যাকাতের অর্থ বিলি-বন্টন করেন।
তাতে না সমাজের তেমন উপকার হয়, না অভাবী ও দরিদ্র জনগনের সমস্যার স্থায়ী সুরাহা হয়। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো যে, আসলে আমরা যে সমাজে বাস করি, তার কল্যাণ ও উন্নতির সাথেই আমাদের কল্যাণ ও উন্নতি জড়িত। আমি যদি আমার অর্থ সম্পদ থেকে আমার ভাইদের সাহায্য করি, তবে তা আবর্তিত হয়ে বহু কল্যাণ সাথে নিয়ে আমার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু আমি যদি সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে তা নিজের কাছেই জমা করে রাখি কিংবা কেবল নিজের ব্যক্তি স্বার্থেই ব্যয় করি, তবে শেষ পর্যন্ত তা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে বাধ্য।
যেমন ধরুন, কেউ যদি একজন এতিম শিশুকে প্রতিপালন করেন এবং তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজের একজন উপার্জনক্ষম সদস্যে পরিনত করে দেন, তবে আসলে তিনি সমাজের সম্পদই বৃদ্ধি করলেন।
আর সমাজের সম্পদ যখন বৃদ্ধি পাবে, তখন সমাজের একজন সদস্য হিসেবে তিনিও তার অংশ লাভ করবেন। তবে এই অংশ যে তিনি সেই বিশেষ এতিমটির যোগ্যতার ফলে লাভ করেছেন, যাকে তিনি সাহায্য করেছিলেন, তা হয়তো ঐ ব্যক্তি হিসাব করে মিলাতে পারবেন না। কিন্তু তিনি যদি সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে বলেন যে, আমি তাকে সাহায্য করবো কেন? তার বাপের উচিত ছিলো তার জন্য কিছু রেখে যাওয়া। তবেতো সে ভবোঘুরের মতো টো টো করে ঘুরে বেড়াবে। বেকার অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।
নিজের শ্রম খাটিয়ে সমাজের সম্পদ বৃদ্ধি করার যোগ্যতাই তার মধ্যে সৃষ্টি হবে না। বরং সে ব্যক্তি যদি অপরাধ প্রবণ হয়ে কারো ঘরে সিঁদ কাটে অথবা যে সাহায্য করলো না তার ঘরেই সিঁদ কাটে তাহলে তাতেও বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। এর অর্থ এই দাড়াবে যে, তিনি সমাজের একজন অকর্মণ্য, ভবঘুরে এবং অপরাধ প্রবণ বানিয়ে কেবল তারই ক্ষতি করেন নি, নিজেরও ক্ষতি করলেন।
বেশিরভাগ লোকই মনে করেন দরিদ্র জনগনের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে চাই সরকারী সাহায্য, নয়তো বিদেশী অনুদান। কিন্ত একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যেতো, এ দেশে যে বিপুল পরিমান অর্থ যাকাতের মাধ্যমে বিতরণ করা হয় তার সুষ্ঠু, সংগঠিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার হলে এসব দরিদ্র লোকদের অবস্থার পরিবর্তন করা খুবই সম্ভব।
উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, বহু ধনী ব্যক্তি বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার উপর যাকাত দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা সাধারনত-এই অর্থের বড় অংশ নগদ পাঁচ/দশ টাকার নোটে পবিত্র রমযান মাসের শেষ দশ দিনে বাড়ির গেটে উপস্থিত গরীব নারী-পুরুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন, বাকীটা শাড়ি-লুঙ্গী আকারে বিতরণ করে থাকেন। কখনও কখনও এরা এলাকার মাদ্রাসার লিল্লাহ বোডিং বা ইয়াতিমখানাতেও এই অর্থের কিছুটা দান করে থাকেন। এরা মুসাফির ঋণগ্রস্থ অসুস্থ লোকদের কথা আদৌ বিবেচনায় আনেন না। বিবেচনায় আনেন না আল্লাহর পথে মুজাহীদদের জন্যে খরচের কথাও।
অথচ এরাই যদি পরিকল্পিতভাবে এলাকার দুস্থ, বিধবা, সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মধ্যে থেকে বাছাই করে প্রতি বছর অন্ততঃ তিন/চারটি পরিবারকে নিজের পায়ে দাড়াবার জন্যে রিক্সা, ভ্যান, সেলাই মেশিন, ছাগল ইত্যাদি কিনে দিতেন তাহলে দেখা যেতো তার একার প্রচেষ্টাতেই পাঁচ বছরে তার এলাকায় অন্ততঃ বিশটি পরিবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। ভিক্ষুক ও অভাবী পরিবারের সংখ্যাও কমে আসছে।
উপরে উল্লেখিত বাংলাদেশে যাকাতের খাত হতে প্রাপ্তব্য এই বিপুল অর্থ দিয়ে যেসব ত্রাণ ও পূণর্বাসনমূলক এবং প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান মূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা সম্ভব সে বিষয়ে নিচে আলোকপাত করা হলো।
জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী
যাকাতের টাকা থেকে যে সব জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১.বৃদ্ধদের জন্য মাসহারাঃ
এ দেশে সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হতে যারা অবসর নেয় শুধুমাত্র তারাই পেনশন পেয়ে থাকেন । কিন্তু লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবীর বার্ধক্যে কোন আর্থিক সংস্থান নেই।
এদের জন্য কিছু করা খুবই জরুরী। অনেক সময় এরা নিজেদের পরিবারের কাছেও হয় অবহেলিত। এদের এই অসহায় অবস্থা দূর করার জন্যে প্রাথমিকভাবে দেশের সকল ইউনিয়ন এবং পৌর কর্পোরেশনের অধিনস্থ ওয়ার্ডের (ইউনিয়ন ৪,৪৫১ ও ওয়ার্ড ৫৮৪টি) প্রতিটি হতে প্রতি বছর যদি অন্ততঃ পঞ্চাশ জনকে মাসিক ১,০০০টাকা হিসেবে আর্থিক সহায়তা দেয়া যায় তাহলে উপকৃত হবে ২,৭১,৭৫০জন। তাদের ন্যুনতম প্রয়োজনের খানিকটা হলেও পুরণ হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে ৩০২কোটি ১০লক্ষ টাকা।
২. মৌলিক পারিবারিক সাহায্যঃ
এ দেশের গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরতলীতেও বহু পরিবারের মশার আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে যেমন মশারী নাই, তেমনি শীতের প্রকোপ হতে বাঁচার জন্যে লেপ বা কম্বোল নেই। এর জন্য প্রতি বছর অনেক বৃদ্ধ ও শিশু মৃত্যুবরণ করে। এর প্রতিবিধানের জন্যে যদি প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড হতে প্রতি বছর কমপক্ষে পঞ্চাশটি পরিবারকে বেছে নিয়ে তাদের একটা করে বড় মশারী ও একটা বড় লেপ দেওয়া যায় তাহলে তারা দীর্ঘদিনের জন্যে মশার আক্রমণ ও শীতের প্রকোপ হতে রক্ষা পাবে। যদি মশারীর মূল্য ২২০টাকা ও লেপের মূল্য ৪৩০টাকা হয় তাহলে এজন্যে প্রয়োজন হবে প্রায় ১৬কোটি ৩৭লক্ষ টাকা।
৩. কন্যা দায়গ্রস্থদের সাহায্যঃ
আমাদের দেশে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা সমূহের অন্যতম প্রকোট সমস্যা মেয়েদের বিয়ে।
যৌতুকের কথা বাদদিলেও মেয়েকে একটু মোটা-মুটি সাজিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই হাজার হাজার পরিবারের। এছাড়া বিয়ের দিনের আপ্যায়ন ও অপরিহার্য কিছু খরচও রয়েছে যা যোগাবার সাধ্য অনেকেরই নাই। এসব কারনে বিয়ের সম্বন্ধ এলেও বিয়ে দেয়া হয়ে উঠেনা। পিতা বেঁচে না থাকলে বিধবা মায়ের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। যদি দেশের সকল ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে প্রতি বছর দশজন করে মেয়ের বিয়ের জন্যে ৩,০০০টাকা করে দেওয়া হয় তাহলে বছরে ব্যয় হবে প্রায় ১৫কোটি ১১লক্ষ টাকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।