একই কাজ একেক জন একেক রকম স্টাইলে করেন। এক ঘুমেরই যে কত রকম স্টাইল আছে। (স্টাইলের যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দটা মনে করতে পারলাম না। ) খাওয়া, হাঁটা, বসা সব কিছুর জন্যই আছে যার যার নিজস্ব স্টাইল।
খাওয়া দিয়ে শুরু করা যাক।
আমাদের ভাই-বোনদের অভ্যাস ছিল টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া। প্লেটে খাবার নিয়ে টিভির সামনে সোফায় বসে খেতাম। আমাদের বোনদের প্লেট হাতেই থাকত। ছোট ভাইটার আবার নিজের আলাদা স্টাইল ছিল। সে সোফায় বসে একটা চেয়ার সামনে নিত।
চেয়ারে খাবারের প্লেট, বোনপ্লেট আর পানি থাকত। ভাতের সাথে একটা বড় লেবুর পুরোটা রস একবারে মিশিয়ে ফেলত। এত টক ভাত কিভাবে যে খাওয়া যায় এটা শুধু সে-ই বলতে পারবে।
আমার আর ছোট ভাইয়ের একসাথে টিভি দেখার একটা স্টাইল ছিল। আমি সোফার এক পাশে বসতাম, ছোট ভাই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখত।
আমি ওর চুলে বিলি কেটে দিতাম। আর যখন বাসার সবাই মিলে টিভি দেখা হত, তখন তো সোফায় শোয়ার জায়গা থাকত না। ছোট ভাই তখন যে কোন দুই বোনের মাঝখানে বসে টিভি দেখত। যখন কোন হরর মুভি বা নাটক দেখতাম তখন সে চোখ বন্ধ করে পাশের দুইজনকে বলত যেন তাকে দুই পাশ থেকে চেপে রাখে। এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও যাতে শুনতে না পারে সেজন্য বলত, আমার কান দুটো ঢেকে রাখ।
ওকে বলতাম, ভয় পেলে অন্য ঘরে গিয়ে বস, দেখতেও হবে না শুনতেও হবে না। কিন্তু ঐ সময় অন্য ঘরে একা থাকাটা তার জন্য আরও ভয়ংকর ছিল, তাই কষ্ট করে হলেও ঐ ভাবেই সবার সাথে বসে থাকত।
ছোট বেলা থেকেই আমার পড়তে বসার স্টাইল ছিল এমন, বিছানায় সব বই খাতা ছড়িয়ে উপুর হয়ে বসে পড়তাম বা লিখতাম। বড় হয়েও অভ্যাসটা পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। এইচ এস সি ফার্স্ট ইয়ারে এক স্যারের কাছে অংক পড়তে যেতাম।
টেবিল চেয়ারেই বসতাম, কিন্তু একদিন ঐ ঘরে কাজ চলছিল তাই অন্য ঘরে বিছানায় বসে সবাই অংক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। সবারই লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু আমি আরামে লিখে যাচ্ছি, এটা দেখে স্যার বললেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি বিছানায় বসেই লেখাপড়া করতে অভ্যস্ত।
মেডিকেলে ভর্তি হবার পর যখন হোস্টেলে থাকা শুরু করলাম, তখনই প্রথম নিজস্ব টেবিল চেয়ারে পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু দেখা যেত টেবিলে শুরুটা করলেও কিছুক্ষণ পর সব বই-খাতা নিয়ে বিছানায় শিফট করে গিয়েছি। কখনও শুয়ে, কখনও বসে, কখনও দুটোর মাঝামাঝি অবস্থায় পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি।
এই স্টাইলটা এখনও বহাল তবিয়তেই অব্যাহত আছে। টেবিল-চেয়ারে লেখা পড়া বলতে ক্লাসরুম আর পরীক্ষার হলেই যতটুকু হত।
আম্মার কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় আমার হাঁটার স্টাইল নাকি ছিল এমন হাস্যকর, দুই পা ক্রস করে হাঁটতাম আমি। মানে ডান পা বাম দিকে আর বাম পা ডান দিকে বাড়িয়ে হাঁটতাম। অবশ্য আমার এমন কিছু মনে পড়ে না।
বড় বোনরা বলত, আমি নাকি উপরে নীচে লাফাতে লাফাতে হাঁটি। এই বিষয়টাও আমি মেনে নিতে পারি না। তবে আমার হাঁটার একটা স্টাইল আমি জানি যে আমি মাথা নিচু করে হাঁটি। এটা অবশ্য কিছু ছোট-খাট ধপাস টাইপের দুর্ঘটনার পর থেকে এমনিতেই অভ্যাস হয়ে গেছে। একবার স্কুলের সামনের রাস্তায় কাজ চলছিল।
কয়েক জায়গায় গর্ত করে রাখা হয়েছিল। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী কাজগুলো বর্ষাকালেই চলছিল, তাই গর্তগুলো সব বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর হয়ে ছিল। ছুটির পর স্কুল থেকে বের হয়ে রিকশা ডাকব আর তখনই............... আচ্ছা থাক প্রসঙ্গের বাইরে বেশি কথা না-ই বলি।
আমার ভাত খাওয়ার একটা স্টাইল আছে। আমি ভাতের সাথে শুরুতেই ডাল নিয়ে নিই।
এরপর শাক-সব্জী, মাছ-মাংস যা আছে সেগুলো নিই। শাক বা মাছ যাই দিয়ে ভাত খাই না কেন, সাথে ডাল থাকতেই হবে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমার এই ডালপ্রীতি নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। তখন মনে হয় চার বছর বয়স, একদিন বাসায় ডাল রান্না হয়নি। আমি ভাত খেতে বসে ডালের জন্য প্রায় কান্না-কাটি লাগিয়ে দিয়েছি।
আম্মা বললেন, ডাল তো শেষ হয়ে গেছে, কালকে বাজার করে আনলে রান্না করে দিব, আজকের দিনটা ডাল ছাড়াই খাও। আমি চলে গেলাম পাশের ফ্ল্যাটে। ওরা দরজা খুলতেই আমি বলি, আপনাদের বাসায় ডাল আছে? আমার কান্ডে লজ্জায় আম্মার মাথা কাটা যাওয়ার মত অবস্থা, কিন্তু পুরো ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে আম্মা আমাকে বাধা দেয়ার সময়টুকুও পাননি।
ছোটবেলায় আমার ঘুমের একটা স্টাইল ছিল যে ঘুমের মধ্যে গড়াগড়ি দিতাম আর গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানা থেকে মেঝেতে বদলি হতাম। টের পেলে আবার বিছানায় উঠে যেতাম, আর না হলে ওভাবেই ঘুমিয়ে থাকতাম।
আম্মা এক সময় বিছানার পাশে একটা বড় কাঠের তক্তা লাগিয়ে দিয়েছিলেন আমার পতন রোধ করার জন্য। এখন অবশ্য ঘুমের স্টাইলটা বদলেছে, পতন এখন আর ঘটে না, তবে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে এত বেশি এপাশ-ওপাশ করি যে পাশের ভদ্রলোকের ঘুমের বারোটা বেজে যায়।
মেডিকেলের ফাইনাল পরীক্ষার একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ভাইভা বোর্ডে গিয়ে বসেছি, সাথে সাথে এক প্রফেসর বললেন, এই তুমি না সেই মেয়ে। আমি মহা ঘাবড়ে গেলাম, থতমত খেয়ে হা করে বসে রইলাম।
আরেকজন প্রফেসর বললেন, কোন মেয়ের কথা বলছেন। প্রথমজন বললেন, আরে এ তো সেই মেয়ে, যে কেমন করে যেন কলম ধরে। স্যারদের নজর এড়িয়ে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললাম। যাক ভয়ের কিছু নেই। স্যার ততক্ষণে তার হাতের পেন্সিলটা নিয়ে নানান রকম কসরত করা শুরু করে দিয়েছেন আর বলছেন, দাঁড়ান দাঁড়ান দেখাই আপনাকে এই মেয়েটা কিভাবে কলম ধরে।
কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না। এইবার আমার হাসি লুকানো কষ্টকর হয়ে গেল। আসলে লিখিত পরীক্ষার সময় এই স্যার ছিলেন, তিনি যে আমার কলম ধরার স্টাইল খেয়াল করেছেন এটা আমি নিজেও খেয়াল করিনি। একটু অন্যভাবেই ধরি মনে হয় কলমটা, অনেকেই এটা দেখে অবাক হয়েছে। কিন্তু স্টাইলটা বলে বোঝানো সম্ভব না, তাই আর চেষ্টাও করলাম না।
নীল দর্পণের পরামর্শে আর রাজ বারামদীর পরিবেশনা দেখে আমিও উদ্বুদ্ধ হলাম। আমার কলম ধরার স্টাইল অনেকটা এরকম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।