সাধারণ পর্যায় থেকে শুরু করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নানা কৌশলে নানা কায়দায় দেশজুড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যখন চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, কথিত বন্দুকযুদ্ধ, গুপ্তহত্যা, অপহরণের পর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং গণপিটুনিতে যখন বিগত কয়েক মাসে নিহত হয়েছে চার শতাধিক মানুষ, সেই সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়েও কয়েকটি খাঁটি নির্ভেজাল বিবেক থেকে উত্সারিত কথা উচ্চারণ করে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। দেশের কর্তা বনে যাওয়া ব্যক্তিরা মিথ্যার ফানুস উড়িয়ে নিজেদের হিংস্র নখ, দাঁত ও লোভাতুর জিহ্বাগুলো আড়াল করে, নিজেদের ঊচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য ক্রমাগত মিথ্যাচার চালিয়ে মনে করে, যেহেতু তাদের মুখোশ সম্পর্কে কেউ জ্ঞাত নয়, সেহেতু কোনো বাধা নেই চালিয়ে যেতে অন্যায় এবং অপকর্ম। ব্যবহার বাড়াতে হবে পেশির। তাদের মুখের ওপর থেকে একটানে মুখোশ খুলে দেখিয়েছেন এই ভদ্রলোক। বর্তমান ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, হতাশ, অচল, অবশ, স্থবির সময়ে যখন ন্যায়, নীতি, আইন, নৈতিকতাকে শাসকরা মর্গে পাঠিয়ে কায়েম করেছেন ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর আপ্তবাক্য, মানুষ যখন প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ দেখে দেখে ভুগছে মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায়, নিজেদের মনে করছে অসহায়, সেই সময় তার কথাগুলো যেন ক্ষতের ওপর মলম লাগিয়েছে কিছুটা।
কথার ফুলঝুরির বেলুন কিছুটা হলেও ফুটো করে দিয়েছেন তিনি। আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যেসব পিতামাতা হারিয়েছেন সন্তান, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামী, ছেলেমেয়েরা হারিয়েছে পিতা, ভাই হারিয়েছেন ভাই তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাবেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। কোনো সভ্য সমাজে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে একটি দেশের ভাবমূর্তি।
তার কথা থেকে পাওয়া গেছে, বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় দারিদ্র্যের কোনো স্থান নেই। আইনগুলোও দরিদ্রবান্ধব নয়। ধনীবান্ধব বিচার ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তার বক্তব্য বেশ পরিষ্কার। তিনি বলেন, এ কাজ শুধু বাংলাদেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে হবে, ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেছি বলে যারা অষ্ট প্রহর কৃতিত্বের বগল বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দিয়েছেন—তাদেরও জুত্সই জবাব তার কথা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছি বলে সবাই উল্লাস প্রকাশ করছি। সেই সংবিধানে বৈষম্যহীন যে সমাজ কাঠামোর কথা বলা হয়েছিল তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তাই গোঁজামিল দিয়ে বলছি, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেছি। ’
বর্তমান সময়ের হৃদয়হীন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিঘাংসা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে এই উচ্চারণ নিশ্চয়ই যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, আজও সত্য কথা বলাকে নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করেন, যারা আজও দুর্নীতি আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে হারিয়ে ফেলেননি বোধবিবেচনা, চক্ষুলজ্জা—তারা কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা পাবেন।
আশার অনুরণন পাবেন।
সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে যারা আজ হত্যা, জুলুম, সন্ত্রাস ও দখলের কসাইখানায় পরিণত করেছে, যাদের কাছে মানবাধিকার মানেই হলো আমি ও আমার দলের প্রতিপত্তি, অন্যরা নয়—তাদের বুকে এসব সত্য উচ্চারণ থেকে কোনো ধাক্কা লাগবে কিনা জানি না। জানি না, তাদের সুমতি ফিরবে কিনা। তবে ইতিহাস বলে, যারা যে জিনিসকে লালন করে পালন করে, সেই জিনিসের মধ্যেই নিহিত থাকে তাদের পতনের বীজ। বৈজ্ঞানিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এক্ষেত্রে জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রয়েছে মানবজাতির জন্য।
দৈনিক পত্রিকা থেকে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।