এটা কবিতার বই বলতে হবে। আসলে ভাল কবি না হলে ভাল ছড়া লেখা যায় না। সার্থক ছড়াকারের বৈশিষ্ট্য হলো- অল্প কথায় তিনি বিশাল ইতিহাস তুলে ধরতে পারেন। শিকদার মোস্তফা এক্ষেত্রে সফল। ‘ঢাকাইয়া মশার গিরিঙ্গি' বইতে তিনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষা।
বাংলার মুসলমানদের যে স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা, ভাষা ও সংস্কৃতি আছে, অর্থাৎ আমরা যে আলাদা শিকদারের বইটা এটারই নিশানা। ' তরুণ কবি শিকদার মোস্তফার প্রথম বই ‘ঢাকাইয়া মশার গিরিঙ্গি' প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বইটি সম্পর্কে একথাগুলো বলেন প্রখ্যাত ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক সাজজাদ হোসাইন খান।
গত ১১ নবেম্বর বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশন ও উৎসঙ্গ সৃজন চিন্তনের যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট কবি হাসান আলীম, কবি ইসমাইল হোসেন দিনাজী, কবি আবদুল কুদ্দুস ফরিদী, কবি বেদুঈন মোস্তফা, বিশিষ্ট লেখক হাসান রাউফুন, বাংলা সাহিত্য পরিষদের কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান, ‘উল্টোস্রোত' সম্পাদক ও ছড়াকার মুহিব নেছার, কবি সাবিত সারওয়ার, কবি আবু হাসান তাহের, শিশু-সংগঠক মিরাজ জামান রাজ ও বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশন-এর নির্বাহী প্রধান, কবি ও ছড়াশিল্পী রেদওয়ানুল হক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন উৎসঙ্গ সৃজন চিন্তন-এর পরিচালক কবি আহমদ বাসির। প্রকাশিত ছড়াকাব্য ‘ঢাকাইয়া মশার গিরিঙ্গি' থেকে আবৃত্তি করেন মাহিদুল ইসলাম ও মুনিরুল ইসলাম।
বইটি সম্পর্কে কবি হাসান আলীম বলেন, এর প্রতিটি ছড়ায় পজেটিভ অ্যাপ্রোচ আছে। ছড়াগুলো খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। বক্তব্যকে সংহত করার জন্য অন্নদাশংকর রায় অনেক সময় দুর্বল অন্ত্যমিল ব্যবহার করেছেন। এটা কখনো কখনো লেখাকে অধিক সার্থকতা দেয়। বক্তব্যকে সার্থক ও সংহত করার জন্যই শিকদার মোস্তফাও সচেতনভাবেই কোথাও কোথাও দুর্বল অন্ত্যমিল ব্যবহার করেছেন।
শিকদার ইচ্ছে করে কোথাও কোথাও মাত্রাও কম দিয়েছেন। এটাও তার একটা শৈল্পিক চাতুর্য। এতে তার ছড়াগুলো অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়েছে। শিকদার মোস্তফা সম্পর্কে হাসান আলীম বলেন, শিকদার খুবই মেধাবী একজন লেখক। মেধাবী লেখকদের ক্ষেত্রে যা হয় সচরাচর তারা কম লেখেন।
শিকদারও কমই লিখেছেন। সে কারণে তার অধিকাংশ লেখাই উত্তীর্ণ, উৎকৃষ্ট। তরুণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছড়াকার হিসাবে তার নাম প্রতিষ্ঠিত বলে আমার বিশ্বাস। শিকদারকে আমি বলব এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তার লেখায় নিজস্বতা আছে।
শব্দের আড়ালে শব্দ থাকে। সেই শব্দকে তুলে আনার ক্ষমতা, চেনার ক্ষমতা মোস্তফার আছে।
কবি ইসমাইল হোসেন দিনাজী বলেন, ‘ঢাকাইয়া মশার গিরিঙ্গি' না হয়ে বইটির নাম ‘ঢাকাই মশার গিরিঙ্গি'ও হতে পারতো। বইটির ছড়াগুলো সুখপাঠ্য। ছড়াগুলো পড়ে মালটা যে ভাল এটা বোঝা গেছে।
আবদুল কুদ্দুস ফরিদী বলেন, খুব সহজ করে কঠিন কথা বলেছেন মোস্তফা। তার অন্ত্যমিলগুলোও চমৎকার। তার লেখায় আমাদের সমাজ-সংসার ও জীবন-সংসার চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিকদারের একান্ত ভাব-ভাবনাগুলো। বইটি প্রকাশের জন্য যারা কাজ করেছেন তারা একটি যথার্থ সময়োপযোগী কাজই করেছেন।
তৌহিদুর রহমান বলেন, বইটির প্রকাশনা মান চমৎকার। কিন্তু বইটির নাম দেখে বোঝা যায় না এর ভিতরে যে অসাধারণ সব ছড়া আছে।
মুহিব নেছার বলেন, শিকদার মোস্তফা লোকশব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে ছড়ার মূল বিষয়টির কোন ক্ষতি হতে দেননি। তার ছড়া ফাঁকা নয়, ভিতরে পর্যাপ্ত রসদ আছে। লেখায় সময়কে ধরতে পারা, সময়কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারা সবচেয়ে বড় বিষয়।
এটা শিকদার মোস্তফার বইতে আছে।
বইটির প্রকাশক রেদওয়ানুল হক বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে গত কয়েক মাস ধরে টানা পরিশ্রম করে অবশেষে আল্লাহর মেহেরবাণীতে বইটি বের করতে পেরেছি। কবি-সমালোচক খালিদ সাইফ, কবি আহমদ বাসির, কবি আফসার নিজাম, আমি এবং লেখক শিকদার মোস্তফা সবাই বইটির জন্য লেগে পড়েছি। বারবার ছড়া রদবদল হয়েছে, সংশোধন হয়েছে, অবশেষে আজই বইটি প্রেস থেকে বের হয়ে আসলো। আর আজই বইটি নিয়ে এ অনুষ্ঠান হচ্ছে।
এ অনুষ্ঠানে অপ্রতিদ্বনদ্বী ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানসহ বিশিষ্ট লেখক ও কবি, সাহিত্যিকগণ উপস্থিত আছেন। আশা করি শিকদার মোস্তফার পরবর্তী কবিতার বইও খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ পাবে।
বইটির লেখক শিকদার মোস্তফা তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ১৯৯৩ সালে আমি লেখালেখি শুরু করি। প্রথমে একটা কবিতা লিখে ফেলি, কয়েক মাস পর আরেকটা। ১৯৯৬ সাল থেকে মোটামুটি নিয়মিত।
বিপরীত উচ্চারণ সাহিত্য আড্ডার মধ্য দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়। ২০০০ সালে বিপরীতের আড্ডায় প্রথম যাই। আমার লেখার পরিমাণ আসলে কম। ভিতর থেকে একান্ত তাগিদ না আসলে লিখি না। এ বইটির পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করার পর মনে করেছিলাম আর লিখব না।
একদিন রিকশায় চড়ে আসছি নাখালপাড়া থেকে ফুলকুঁড়ির অফিসে। আসার পথেই হঠাৎ একটি লেখা মাথায় চলে আসলো। নিজেকে নিয়েই লেখাটি। পরে এ লেখাটিও বইতে দিয়ে দিলাম। বইয়ের সর্বশেষ ছড়া এটি।
মোস্তফা আরও বলেন, ছড়ায় আমি আনন্দ পাই, প্রশান্তি পাই কবিতায়। ছড়ার আনন্দ মনে হয় লিখেই শেষ। কবিতার প্রশান্তি অনেক দিন পর্যন্ত থেকে যায়। তবে কবিতা, ছড়া- দু'টিই চলবে। তিনি বলেন, নিয়মিত সাহিত্য আড্ডার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম।
আসলে সাহিত্য আড্ডার কোন বিকল্প নেই। সাহিত্য আড্ডায় গিয়েই আমি জীবনানন্দ দাশ ও ফররুখ আহমদকে জানতে পেরেছিলাম। এ দু'জন আমাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি লিখতাম কবিতা। একদিন বিপরীতের সাহিত্য সভায় একটি ছড়া পড়ি।
কবি নাঈম মাহমুদ সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, শিকদারের এখন থেকে ছড়াই লেখা উচিত, কবিতা লেখার দরকার নেই। আমি আহত হয়েছিলাম, নাঈম ভাইকে বললাম, আমি তো কবিতাই লিখতে চাই, হঠাৎ একটা ছড়া আসলো বলে লিখলাম, তিনি বললেন, দু'টোই লেখ, তবে ছড়াও গুরুত্বের সঙ্গে লেখ। সেই থেকে ছড়ায় অধিক মনোনিবেশ করতে শুরু করলাম। তবে কবিতা ছাড়িনি। যখন যেটা আসে সেটাই লিখব।
অবশেষে আমার একটি বই প্রকাশ পেল; এ জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করি। অনুষ্ঠানে শিকদার মোস্তফা তার বই থেকে ‘বাতাসা সুন্দরীর হিয়া' ছড়াটি পুঁথির সুরে পাঠ করে শোনান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।