চুপ!
বিরাট একটা রুমের ঠিক মাঝখানে বসে আছে বহ্নিশিখা। চারপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যন্ত্রাংশ আর কেজো জিনিসগুলোকে বিশ্রাম দিচ্ছে, ওর নিজেরও উদ্দীপিত হওয়ার সময় এখন। দুটো বাজে, আধা ঘন্টা সময় ওর হাতে এখন। নিজেকে সমস্ত কাজের বেড়াজাল থেকে বের করে যেন একটু ভ্রমণ করে আসতে চায় অতীতে বা ভবিষ্যতে, স্বপ্ন দেখতে চায় সামনের সময়টুকু নিয়ে বা মিলিয়ে দেখতে চায় মগজে সাজানো স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পেয়েছে কী না।
ভাবতে ভাবতেই যেন ও ওর খুব কাছের ভবিষ্যতটাকে দেখতে পায়, মোটরসাইকেলে করে ঠিক ওই মানুষটার (যার প্রতি ওর ইনফেচুয়েশন ছিল!) মতো দেখতে একজনের পিছনে বসে ও চারুকলার গেটের সামনে এসে থামে, তারপর...
দৃশ্যপট ১
হাতে হাত রেখে অগ্লিলা আর ধীরাজ যায় জয়নুল গ্যালারীর ভিতরে নামী বা অনামী কারো চিত্র প্রদর্শনী দেখতে।
যেন না ছুটে যায় এজন্যেই হয় তো অনেক বেশী শক্ত করে পরস্পরের আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে থাকে কিন্তু কেন মনে হচ্ছে এই যে বাইরের ভালোবাসার প্রকাশ, তার পুরোটা সত্য নয়! অনেকটাই যেন অভিনয়-পরস্পরের মধ্যে প্রেম জাগিয়ে তোলার জন্যে, অনেকটা বছর যে হরমোনটাকে বেরুতে না দিয়ে তার দুয়ারটাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, তার খিলে পড়া মরিচাটাকে ঘষে পরিষ্কার করার প্রাণপন চেষ্টা।
হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে থাকে, অফিসের বসের সামনে বসে ত্রিশোর্ধ অগ্নিলা- কাজ আর কাজ করে যে জীবনের অন্য দিকগুলো দেখার অবকাশ পায় নি বা দেখেই নি।
বস রিয়াজ ভূমিকা না করেই বলেন-জীবন নিয়ে কী ভেবেছ অগ্নি?
অগ্ন অবাক- নুতুন কী ভাবব রিয়াজ ভাই, কাজ করছি, চলছি-ফিরছি-বেশ আছি।
এবার রিয়াজ শক্ত হয়- নাহ! এই মেয়েকে তো বুঝানো গেল না কিছু! দেখ অগ্নি, অনেক দিন থেকেই আমরা একসাথে কাজ করছি, তোমার ভালো-মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব। জীবনটা তো মানুষের, রোবটের না।
সামাজিক জীবনের দরকার আছে। অনেক কাজ করেছ, সারা জীবন আরো করবে; আমি জানি খুব শীগগিরই তুমি এই প্রফেশনের একজন প্রতিভূ হয়ে যাবে কিন্তু জীবনের এই মোক্ষম সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করা বোধ হয় সমীচীন নয়।
বসের কথাগুলো ভাবায় ওকে, সেই সূত্র ধরেই বোধ হয় বিয়ে করে অগ্নিলা। যে আবেগ-অনুভূতির দরজাটাকে ও নিজের অজান্তেই কাজকে বেশী ভালবেসে অবহেলায় পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে আজ তার দুয়ারে মাথা ঠুকছে যখন ধীরাজ ওকে বলে রস-কষহীন একটা জড় পদার্থ। ধীরাজের ভালবাসা আর প্রাণের সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যাচ্ছে ও, ডাক্তার ওকে বলেছে এক সময়কার অতিরিক্ত পরিশ্রমের শোধ নিচ্ছে ওর শরীর।
হঠাৎ যেন অগ্নিলার চেহারা বদলে যেতে থাকে, সেই রিবন্ডিং করা সোজা চুলগুলো কোকড়া হয়ে যায়, লম্বাটে মুখটা হয়ে যায় গোলপানা- এ কাকে দেখতে পাচ্ছে বহ্নিশিখা, এ তো অগ্নিলা নয়-এ তো ওকেই দেখতে পাচ্ছে। ধড়ফড় করে জেগে উঠে বহ্নিশিখা!
কেমন একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি হয়, নাহ! উদ্দীপনাটা কেমন উল্টোদিকে কাজ করল। ও ফিরে যেতে চায় অতীতে, আবেগ থাকলে নিশ্চয়ই তা অন্যরকম হতো। সেই যে অনিলা যে বহ্নিশিখাকে বলতো তার আয়না, চেহারায় আর আচার-আচরণে প্রচুর সাদৃশ্য তাদেরকে কাছাকাছি এনেছিল কোন সম্পর্ক না থাকা সত্বেও। ওর ভিতরে একটুখানি প্রেম থাকলে ও নিশ্চয়ই অনিলার মতোই ওই ম্যাগী নুডুলসের মতো লম্বা চুলওয়ালা ছেলেটিকেই ভালোবাসত।
দৃশ্যপট ২
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে অনিলা, অভিমানে নাক ফুলিয়ে আছে, ফোলা ফোলা চোখদুটো জলে টলমল; সামনে অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে জ্যোতি, কীভাবে এই জ্বলন্ত আগুনকে ঠান্ডা করা যায় তাই ভাবছে; জেনেশুনেই তো এ আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে এখন নেভানোর উপায় খুঁজছে। মাথা গরম প্রকৃতির অনিলা, একটুতেই রাগ হয়ে যায় বলে ওকে রাগিয়ে আরো মজা পায় জ্যোতি, কিন্তু এখন মোটেও মজা করার অবস্থা নেই, বিস্ফোরণের আগের মুহূর্ত!
খুব সহজেই বলে দেওয়া যায় পরের অংশটুকু, রেগে-মেগে স্পট ত্যাগ করে চলে যাবে অনিলা; তারপর দু-একদিন চলবে রাগ-অনুরাগ-পাল্টারাগ, শুভাকাংক্ষীরা ভাববে- আহা! এই বুঝি গেল এদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে! কিন্তু দুদিন পর হয় তো আবার অনিলার ভালোবাসাপূর্ণ স্ট্যাটাস দেখা যাবে- সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, ভাববে দুজনকে মানায় বেশ!
রাগ ভাঙ্গার পরের দিনটা খুব মধুর; সেটা নিশ্চয়ই কোন ছুটির দিন হবে, জ্যোতির অফিস বন্ধ থাকবে। অনিলাকে সময় দেয় না বলে যে অভিযোগ তা পুষিয়ে নিতে শাড়ী-পাঞ্জাবি পরে দুজন সেজেগুজে হয় তো ঢাকার কাছাকাছি কোন সুন্দর জায়গায় চলে যায়। নতুন প্রোফেশনের উঠতি অবস্থায় জ্যোতি, তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যে একটু বেশীই সময় দিতে হয় তাকে; নইলে অনিলাকে নিয়ে সংসার সাজানোটা আরো দেরী হয়ে যাবে! দুজনের শেয়ার করা টাকার ক্যামেরার তোলা ছবি নিয়ে যুদ্ধ চলে- কে বেশী ভাল ছবি তোলে! হলের নির্বান্ধব ধু ধু জীবনের চেয়ে বিয়ে করে জ্যোতির সাথে থাকাটা বেশী লোভনীয় হলেও এ মুহূর্তে ওকে আরো ভারবাহী না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়- যখন দুজনে মিলে তাদের স্বর্গ রচনা করতে পারবে!
হায় রে মানুষ!-ভাবে বহ্নিশিখা, রূপকথার রাজপুত্র-রাজকন্যার মিলনের মতো হ্যাপী এন্ডিং যে এ পৃথিবীতে নেই বুঝতেই পারে না! অনিলার চরিত্রে নিজেকে দেখে কেবল সাময়িক সুখ পায়, অনাগত ভবিষ্যতের হাজারো ঝামেলা আর বিয়ের আগের এই সুমধুর খুনসুটির পরের কুৎ সিত ঝগড়াময় পরিণতির রূপ দেখে শিউরে উঠে তন্দ্রা ভেঙ্গে যায় ওর!
আবেগ আর বুদ্ধি দুইয়ের সংমিশ্রণে যদি ও একজন মানুষ হতো তাহলে নিশ্চয়ই উজ্জ্বলার মতো হত। উজ্জ্বলার সময়টা যেন ও অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়!
দৃশ্যপট ৩
ওরা একই জায়গায় কাজ করে- ওই ভারী চশমা পরা ছেলেটা, যে ভাব দেখায় দুনিয়ার কিচ্ছু দেখে না কিন্তু চশমার আড়ালে খেয়াল রাখে উজ্জ্বলা কোন রঙের শাড়ী পরে আসে কোন দিন।
ওদের কাজে অনেক মিল, চিন্তা-ভাবনায়ও ফারাক কম; বিশ্বভ্রমণের আগ্রহ লালন করা দুজনের ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠার মাঝেও অনেক সাদৃশ্য। কাজপাগল দুজনই আর তাই অফিস খালি হয়ে গেলেও দুই বিপরীতমুখী কিউবিকলের কী-বোর্ডে শোনা যায় খটখট শব্দ, তার ফাঁকে নিতান্তই টুকটাক কথা-বার্তা।
দুজনের সামনেটা অনেক পরিষ্কার দেখা যায়- একই সাথে দেশের বাইরে যাওয়া, ঘোরা-ফেরা, দেশে ফিরে আসা, দিনের প্রত্যেকটা ছোটখাট কাজে শেয়ারিং। আর তারপর গোল্লুগাল্লু ভারী চশমা পরা জ্ঞানী একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নিজেকে দেখতে পায় বহ্নিশিখা। বিস্ময় আর অদ্ভুত আনন্দানুভূতি নিয়ে তন্দ্রা ভাঙ্গে তার।
বাস্তবতাঃ
আড়াইটা বাজে। জীবনটাকে ছাব্বিশ বছরে স্থির করে রাখা এক যন্ত্রমানবী স্টিমুলেটরের মাধ্যমে তার কপোট্রনে কিছু আবেগানুভূতির চাষ করে উদ্দীপিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে বিশাল কন্ট্রোলরুমের মাঝে তার কাজের জায়গাটাতে, আধঘন্টার এ উদ্দীপনায় আরো আটঘন্টা কাজ করে যাবে সে অনলস।
--------------------------------------
অস্থির, অগভীর, অল্প সময়ের গল্প
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।