১. নেয়ামতপুর গ্রামের গল্প। এটি বাংলাদেশের আর পাঁচ দশটা গ্রামের মত নয়। ভারতীয় সীমানা ঘেঁষে এর অবস্থান। উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগে নি। মানুষগুলো খুবই সাধা-সিধা, সহজ-সরল।
এক জনের হাড়িতে চাল না থাকলে, আরেক জন যতটুকু পারে সাহায্য করে। এক জনের দুঃখে আরেক জন এগিয়ে আসে। এক জনের আনন্দ সবাই মিলে উপভোগ করে। মানুষগুলো সবাই কমবেশি অভাবি, কিন্তু সুখি।
গ্রামে ভাঙাচোরা বেড়ার একটা প্রাইমারি স্কুল আছে।
বৃষ্টির দিনে টিনের চাল দিয়ে পানি পড়ে, ভিজে জুবুথুবু হয় ছাত্র ছাত্রীরা। ঝড়ের দিনে ভাঙা দড়জা জানালাগুলো যেন আর্তনাদ করে উঠে। আর শীতের দিনে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসে। গ্রামের একমাত্র কাঁচারাস্তাটায় হাঁটু সমান কাদা হয় বর্ষাকালে। ইলেক্ট্রেসিটি তো দূরের কথা, খাম্বারও দেখা নেই।
বটগাছ তলার করিম সরকারের একটা বহুমুখি মুদি দোকানই (চা এর স্টল থেকে শুরু করে সব পাওয়া যায়) গ্রামের মানুষের বাজার, বিনোদোনের জায়গা। করিম সরকারের একটা ১৭ ইঞ্চি সাদা কালো টিভি আছে, ব্যাটারির সাহায্যে চলে। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই ভিড় বাড়তে থাকে দোকানটায়। টিভির দর্শক ছেলে বুড়ো সবাই।
দোকানটায় চায়ের অর্ডারটা যেন আজ একটু বেশিই হচ্ছে।
গ্রামের মানুষের বুক গর্বে ভড়িয়ে দিয়েছে সিরাজ মঝির বেটি সুফিয়া। সরকার প্রাইমারিতে কী যেন একটা পরীক্ষা চালু করল এবার, সেই পরীক্ষায় বড় পাশ দিয়েছে সিরাজ মাঝির বেটি। গতকাল বড় বড় গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছিল। ফটো তুললো, ভিডিও করলো, কী সব যেন লিখে নিল।
করিম সরকারের টিভিতে সুফিয়াকে যতবারই দেখাচ্ছে, ছোট বড় সবাই খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠছে।
কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে, ওই দেহ আমাগের সুফিয়ারে দেহাচ্ছে। আহা! এমন আনন্দ গ্রামের মানুষ কত দিন পায় নি।
২. আজকের সকালটা কেন যে গত চার পাঁচ দিনের মত হত হল না, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না আট বছর বয়সের সুহেল মাঝি। কুয়াশা যদি থাকতো, সূর্যটা যদি না উঠত, শীতের দোহাই দিয়ে আরেকটু ঘুমানো যেত। অথচ এখন উঠানে পাটি বিছিয়ে পড়তে বসতে হয়েছে তাকে।
সে ভেবে পায় না, তার দিদি এমন নিষ্ঠুর হয় কি করে? সুহেল ক্লাস টুতে পড়ে, আর তার দিদি ফাইভ পাশ দিয়ে মাত্র সিক্সে উঠেছে। সুহেলের পাশেই বসে তার নিষ্ঠুর মাস্টার মশাই তার নিজের ক্লাসের বই মনযোগ দিয়ে পড়ছে। সুহেল মনে মনে বলে, দিদি তর পড়া তুই পড়েগ গে, এই কালের মদ্দি আমারে ক্যান ডাকপের গেলি? উঠানে তিনটা চড়ুই পাখি কী যেন খুঁজ়ে খুঁজে খাচ্ছিল। পড়ার চেয়ে সুহেলের মনোযোগ সেদিকেই বেশি।
হঠাৎ খেয়াল হতেই মাস্টার মশাই সুফিয়া খাতুন ধমকে উঠল।
-কিরে পড়স না ক্যান? ওই দিকে তাকাইয়ে কী দ্যাখস?
-না দিদি! কিছু না। আতকে উঠে সুহেল।
-তালি পরে পড়।
ওদের মা, হালিমা খাতুন দুই জনের কান্ড কারখানা দেখে একটু হাসল। তারপরে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিল।
ভাঙা চুলাটা কাদা দিয়ে মেরামত করছে সে। হালিমা খাতুনের মনে আজ খুব আনন্দ। গতকাল সুফিয়ার বাপ আতপ চাল আর খেজুরের গুড় কিনে এনেছে ছেলে মেয়েদের পিঠা খাওয়ানোর জন্য। আহারে! কতদিন যে ওরা ভাল মন্দ খায় না। সিরাজ মাঝির তিন কানি জমি আছে।
যে ফসল আসে, এতে বছরের ছয় মাসও যায় না। বাকিটা সময় যায় অভাব অনটনে। এখানে ওখানে কামলার কাজ করে দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে দিন চলে যায়।
-মা, বাপজান কনে গেছে? বিয়ান বেলা থিকাইতো দেখতেছি না? উত্তর পাওয়ার আশায় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সুহেল।
-তর বাপে বিয়ান বিয়ান কাম খুঁজপের জন্যি বাইর হইছে।
-ও। সুহেল আবার পড়ায় মনযোগ দিল।
সুফিয়ার খুব সখ মায়ের সাথে থেকে ভিজানো চাল পাটায় বেটে বেটে আটা বানাবে। তারপর পিঠা বানাতে বসবে। সুফিয়ার ধারনা, তার মায়ের মত ভালো করে পিঠা বানাতে এই গ্রামের অনেকেই পারে না।
-মা, চাল গুড়া কইরবে না?
-হ। চুলাডা ভালো কইরে লেইপে নেই আগে।
সুফিয়া আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুহেল বই এগিয়ে দিয়ে বলল,
-দিদি পড়া হইছে। ধর দেহি।
-ঠিক আছে।
ক।
সুহেল মুটামুটি নির্ভুল ভাবেই পড়া বলে যায়। খুশিতে মনটা ভরে যায় সুফিয়ার। তবুও কৃত্তিম অখুশির ভান করে বলে,
-বেশি ভালা হয় নাই। আরো পড়েক।
সুহেলের মুখটা কালো হয়ে যায়।
-দিদি!
-কী কবি, কলিই তো পারিস।
-তরে একটা কথা কই, রাখপি?
-পাড়লে রাখপোনে, ক দেহি একবার?
-বড় পিলারডার ওই হানে ম্যালা কাশ ফুল ধরছে। চলেক কাইটে নিয়ে আসি।
-খবরদার না! ওই হানে ভারতি মেলেটারি আছে।
গুলি করি মাইরে ফেলাবেনে।
দিদির না শুনে সুহেল ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। খুব মায়া লাগলো সুফিয়ার ভাইটির জন্য।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই দূরে দাড়াইয়ে থাকিস আমি কাইটে নিয়ে আসপানে।
দিদির আশ্বাস পেয়ে যেন সুহেলের খুশি আর ধরে না।
৩. দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের পঞ্চম পাতায় সপ্তম কলামে ছোট্ট একটা রিপোর্ট-
‘বিএসএফের গুলিতে বার বছরের একটি মেয়ের মৃত্যু। মেয়েটি কাশফুল কাটতে গিয়েছিল। বিএসএফের দাবী, মেয়েটি ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু মেয়েটির লাশ বাংলাদেশের সীমান্তেই পাওয়া যায়’।
১০ জানুয়ারি, ২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।