অনেক হতাশার মধ্যেও একটু আশার আলো। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের রূপকল্প নিয়ে কথা বলেছেন। ভবিষ্যতে কোন কোন খাত তাঁদের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে, সেসব তিনি জানিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, মুখে যা-ই বলুক, বিএনপি হয়তো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন ও তারপর সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই অগ্রসর হচ্ছে। মাঝেমধ্যে যে ওরা এক দফার কথা বলে, সেটা হয়তো একেবারে শেষ উপায়।
এর আগে বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের সব রকম চেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে ধরে নেওয়া যায়। একে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে দেখা চলে।
রূপকল্প ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যে নতুন কিছু আছে কি? সাধারণত সব দলই নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর অবধারিতভাবে সব ভুলে যায়।
ক্ষমতায় যাওয়া বা না যাওয়ার সঙ্গে এসব রূপকল্পের কোনো সম্পর্ক থাকে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় ঘটা করে ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। অনেক অঙ্গীকার ছিল তাতে। কিছু নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু সংসদ কার্যকর করার জন্য কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ছিল, সেটি হয়নি।
ক্ষমতায়এসে তারা বিরোধী দল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নেওয়ার কথা বলেছিল, তা-ও করেনি। ফলে পাঁচ বছর বিএনপি হাতে গোনা মাত্র কয়েক দিন সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিল। ডেপুটি স্পিকার পেলেই যে সংসদ বিরোধী দলের পদচারণে গমগম করত, তা নয়। কিন্তু এক ধাপ অগ্রগতি তো হতো। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার শুভ সূচনা ঘটত।
কিন্তু বাস্তবে এখন সরকার ও বিরোধী দল আগের মতোই রাজনীতির দুই মেরুতে অবস্থান করছে।
অন্যদিকে বিএনপি তাদের ইশতেহারে জোর দিয়েছিল সংসদ অধিবেশনে উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়ে। এমন কথাও লেখা হয়েছিল যে কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমোদন ছাড়া ৩০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সদস্যপদ শূন্য হবে। অথচ নির্বাচনের পর ওরা একের পর এক সংসদ বর্জন করে চলেছে। বর্তমান সংসদে ৩৭০ কার্যদিবসে বিএনপি অনুপস্থিত ছিল ৩১৬ দিন ও দলের চেয়ারপারসন অনুপস্থিত ছিলেন ৩৬২ দিন! শেষ দিকে এসে মাত্র কয়েক দিন নিয়মিত অধিবেশনে যোগ দিলেও কথায় কথায় ওয়াকআউট চলছে।
ওরা সরকার গঠন করেনি, ঠিক আছে। কিন্তু যেখানে ৩০ দিনের বেশি অনুপস্থিতি উচিত নয় বলে মনে করে, সেখানে নিজেরা কীভাবে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকে? শুধু সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য একটানা অনুপস্থিতির ৯০ দিন পূরণের আগে দু-এক দিনের জন্য সংসদে যায়। এটা কি তাদের নীতিগত অবস্থানের বরখেলাপ নয়?
তার পরও বলব, বিএনপির রূপকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা একটি ভালো উদ্যোগ। একটা দলিল থাকলে চলার পথ সহজ হয়। দলিলই যদি না থাকে, তাহলে মানুষ দলের জবাবদিহি করবে কীভাবে?
কিন্তু রূপকল্প তো বাস্তবায়ন হবে নির্বাচনের পর।
তাই আগে নির্বাচন করতে হবে। তারপর রূপকল্প। সে জন্য নির্বাচনের বিষয়টি দ্রুত পরিষ্কার করা দরকার। বিএনপি যখন বলে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ছাড়া ওরা কোনো নির্বাচনে যাবে না, তখন মনে হয় নির্বাচনের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। কারণ, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত দলীয় সরকারের’ অধীনে ছাড়া অনির্বাচিত কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ক্ষমতাসীন সরকারি দল আওয়ামী লীগ রাজি না।
সামনে তো সংঘাত ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান নয়। তাহলে রূপকল্প দিয়ে কী হবে?
তার পরও কালো মেঘের রুপালি পাড়ের কথা আমরা বলি। বর্তমান অবস্থার অভিনবত্ব হলো, এই দুঃসময়ে আশঙ্কা ও সম্ভাবনা একই সঙ্গে বিরাজমান! বিএনপির নির্বাচন বর্জনের আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি আবার তাদের অংশগ্রহণসমৃদ্ধ নির্বাচনের সম্ভাবনাও কম নয়। যেমন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে যাবে। বিরোধী দলের মনোনীত সাংসদদেরও নির্বাচনকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সংসদ নিয়ে বিএনপির যে সংশয় ছিল, সেটা দূর হয়েছে। উপরন্তু নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপির আস্থা অর্জনের জন্য এসব যথেষ্ট নয়। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে নির্বাচনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বহাল থাকলে ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এবং রাজনীতির যা অবস্থা, তাতে এ রকম আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যত আশ্বাসই দিন না কেন, কোনো কাজ হবে না। যুগ যুগ ধরে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছে, কেবল মুখের কথায় তাকে সরানো যাবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন নিয়ে এই অচলাবস্থা কীভাবে দূর করা যাবে? স্পষ্টতই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথম প্রস্তাব দুটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তার পরও আওয়ামী লীগ বলছে, আলোচনার পথ খোলা! বিএনপিও আলোচনায় আগ্রহী। কিন্তু এসব কথা তো অন্তঃসারশূন্য।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই এখন বলা দরকার, তাদের ঝুলিতে আর কী আছে। না হলে ২৪ অক্টোবরের পর আলোচনার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়বে। কারণ, যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী ২৫ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। এর আর কোনো ফাঁকফোকর আবিষ্কার করা যাবে না। তখন কি বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন করবে? তাতে কি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব হবে? বর্তমান সংবিধানে তো সে রকম কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
এগুলো হলো কিছু বাস্তব সমস্যা। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা ছিল, কিন্তু এখন তো কমিশন নিজেই নিজেকে আরও দুর্বল করছে। তাই বিএনপির সন্দেহ আরও প্রবল হচ্ছে। আওয়ামী লীগ কীভাবে আশা করে যে তাদের নির্বাচনী তেতো বড়িটা বিএনপি গলাধঃকরণ করবে? এখানে আর কোনো ছলচাতুরী চলবে না। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে সেগুলো দূর করার সদিচ্ছা আছে কি না, আওয়ামী লীগকে তা স্পষ্ট করে বলতে হবে।
এগুলোই হবে সম্ভাব্য আলোচনার জন্য দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তাবের বিষয়বস্তু। যদি আওয়ামী লীগ আরও ছাড় দিতে চায়, তাহলে আলোচনার নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর যদি না চায়, তাহলে কথা নেই।
অন্যদিকে বিএনপিকেও পরিষ্কার করে বলতে হবে, ওরা ‘নির্দলীয়’ নামক বিশেষণটি কতটা ফিকে করতে রাজি। নির্বাচন করার গরজটা কিন্তু আওয়ামী লীগের যেমন, বিএনপিরও তেমন।
না হলে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার সঙ্গে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে কথা বলা বা রূপকল্পের প্রসঙ্গ তোলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা বিএনপির চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে?
২০০৭ সালের জানুয়ারির প্রথমার্ধ পর্যন্ত সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগও প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। সে সময় একপর্যায়ে মন্দের ভালো হিসেবে বিএনপিদলীয় রাষ্ট্রপতিকেই প্রধান উপদেষ্টা মেনে তাঁর অধীনেই নির্বাচনে রাজি হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কার্যত নির্বাচন কমিশন এরশাদকে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করায় আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। এই গ্যাঞ্জাম না হলে হয়তো এক-এগারোর অবকাশ থাকত না এবং সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ ও গণতন্ত্র এগিয়ে যেত।
আজও প্রায় সে রকম অবস্থা। বিএনপিকে যেমন ভাবতে হবে নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাব্য বিকল্প উপায়। তেমনি আবার আওয়ামী লীগকেও ভাবতে হবে সংবিধানের মধ্যে থেকেই কতটা সুযোগ সৃষ্টি করে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার শর্ত সৃষ্টি করা যায়।
যদি সে রকম কিছু করা যায়, আর যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে, তাহলে তা হবে দেশের জন্য এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।