আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিএনপির যত ভুল

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত একটা বড় ভুল ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, নির্বাচনে অংশ নিলে দলটির জয়ের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেলিফোনের ডাকে সাড়া না দিয়েও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি। প্রয়োজনে হরতাল স্থগিত করে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করা জরুরি ছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের রাজনৈতিক ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়াসহ দলের নীতিনির্ধারকদের বাস্তবতার নিরিখে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম মনিরুজ্জামান মিঞা, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর।

বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বেগম জিয়ার সাক্ষাৎ না করাও বিএনপির কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় আওয়ামী লীগের প্রচারণার বিপরীতে বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। আগামী নির্বাচনমুখী আন্দোলনে কৌশলগতভাবে হলেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করা উচিত।

অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ত থাকায় আওয়ামী লীগ দেশে-বিদেশে এমন প্রচারণা চালিয়েছে এবং এতে সর্বস্তরের মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

কৌশলগতভাবে হলেও আগামীতে নির্বাচনমুখী আন্দোলনে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক শিথিল হওয়া উচিত। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে সহিংসতা, মানুষ হত্যাকে সাধারণ মানুষ নেতিবাচকভাবে নিয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়টিও বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে। কারণ, কে বা কারা আগুন দিয়েছে, পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যা করেছে কিন্তু তার দায়দায়িত্ব বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সব চিন্তা বাদ দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

সেভাবে তৃণমূলে সংগঠনকে গোছানো জরুরি বলেও মনে করেন তিনি। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মতে, প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে বিএনপির সমসংখ্যক পছন্দসই মন্ত্রণালয় নেওয়া উচিত ছিল। সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় চাইতে পারত। এর মধ্যে দরকষাকষি করে যে মন্ত্রণালয়গুলো পেত, তাতে সরকার যত চেষ্টাই করুক, কারচুপি করতে পারত না। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশে শান্তি চাই।

সঙ্গে সঙ্গেই এ বক্তব্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের সংলাপে বসা উচিত ছিল। কিন্তু বেগম জিয়া তা করেননি। বিএনপির মাঠে কোটি কোটি ভোটার রয়েছে। কোনো কারচুপি হলে তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সম্ভব ছিল। তা ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের কারণে ইচ্ছা থাকলেও ক্ষমতাসীনরা সেভাবে কারচুপি করতে পারত না।

আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নেতাদের আত্দগোপনে থাকাও ঠিক হয়নি। বিশেষ করে ঢাকা মার্চ কর্মসূচিকে ঘিরে নেতাদের আত্দগোপনে তৃণমূলে চরম হতাশা চলে আসে।

ড. শাহদীন মালিকের ভাষায়, সহিংসতার কারণে যেভাবে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমেছে, নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে অনেক বেশি। আমার মূল্যায়নে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেউ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। বিএনপি দ্বিতীয়, আওয়ামী লীগ তৃতীয়, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ফেল করেছে।

আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিএনপি জোট থেকে বাদ দেওয়ার যে শর্ত দিয়েছে তাতে সংলাপ-সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। শর্তের বেড়াজালে না গিয়ে দুই দলকেই এখন সংলাপে বসা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। আমানুল্লাহ কবীর বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পর বিএনপি চেয়ারপারসনের একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল_ 'দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই' এমন একটি স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থান করেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির সাংগঠনিকভাবে ও নেতৃত্বে ব্যর্থতা লক্ষ্য করা গেছে।

ফলে আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যায় জোটের একটি শরিক দলের হাতে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন করে তাতে বিএনপির নেতারা মাঠে ছিলেন না। যদিও তৃণমূলের কর্মীরা আন্দোলন করে গেছেন। বিগত পাঁচ বছরে বিএনপির কূটনৈতিক ব্যর্থতাও কম ছিল না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নয়া দিলি্ল সফরে গিয়ে সেখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয় তাদের দিলি্ল মিশন সফল। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। হরতালের অজুহাত দেখিয়ে বেগম জিয়া তার সঙ্গে বৈঠক করেননি। এটাও বিএনপির কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এতে প্রতিবেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের জনগণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

তা ছাড়া চীনের সঙ্গেও বিএনপির কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের মতো আর নেই।

তিনি বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া উচিত ছিল। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সমসংখ্যক মন্ত্রণালয় নিয়ে কতগুলো কৌশলগত শর্ত দিয়ে নির্বাচনে গেলে ইতিবাচক ফলই বয়ে আনত। প্রয়োজনে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনও পরিবর্তন করতে পারত। এর পরও গড়িমসি করলে সরকারের ঘাড়েই সব দায়দায়িত্ব পড়ত।

নির্বাচন বর্জন করা সঠিক হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।

আমানুল্লাহ কবীরের মতে, সংলাপের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনার টেলিফোনের আহ্বানে সাড়া না দেওয়া আরেকটি ভুল ছিল। হরতাল স্থগিত রেখে আলোচনায় গিয়ে নিজের দাবিগুলো তুলে ধরা উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া না দিলে দায় সরকারের ওপরই বর্তাত। বিএনপি নির্বাচনে গেলে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়ত।

নির্বাচন বর্জনের পর সহিংস আন্দোলনও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটি আর জামায়াতের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল আরেক; যে কারণে জামায়াতের সহিংসতার দায়ভারও বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে। জামায়াত ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশি কূটনীতিকরা বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ভাষায়, ২৯ ডিসেম্বর 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি' কর্মসূচিতে রাজধানীর নয়াপল্টনে কিছু করতে না পারলেও ঢাকার প্রবেশমুখেও নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি।

এটাও আন্দোলনে একধরনের ব্যর্থতা। এ থেকে উত্তরণের উপায় বেগম জিয়াকেই খুঁজতে হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ ছলেবলে কৌশলে পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির আন্দোলনের ধরন কী হবে, সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে কীভাবে সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে, তার উপায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকেই খুঁজে বের করতে হবে। বৈধ, অবৈধ যাই হোক দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের ভয়ভীতি কেটে গেছে।

বিভিন্ন দেশের অভিনন্দনও পাচ্ছে তারা। তাই দশম জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ায় তৃণমূলের হতাশা কাটাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। এতে অধিকাংশ উপজেলায় বিএনপির জেতারও সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে সংসদ নির্বাচনের আন্দোলন আরও বেগবান করা সম্ভব হবে।

মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিএনপি ওয়ান-ইলেভেনের কারণ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে; যার কারণে অপ্রস্তুত অবস্থায় ওই নির্বাচনে যেতে হয়েছে।

নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াও বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর দলকে না গুছিয়ে পথচলা শুরু করে বিএনপি। পরে নতুন প্রজন্মকে দলে স্থান দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গ সংগঠনগুলোয় গতিশীলতা আনতে পারেনি। ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএনপির নতুন জেনারেশনে গ্যাপ পড়েছে।

এ কারণে রাজপথে বিএনপি তার নিজস্ব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তথাকথিত নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে নেতা-কর্মীরা খোলামনে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারেন না। অরাজনৈতিক লোক দিয়ে গুলশান কার্যালয় নিয়ন্ত্রণের কারণে দলের রাজনৈতিক নেতারা বেগম জিয়ার কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। ঢাকার রাজনীতির ব্যর্থতাও কম নয়। এ ক্ষেত্রে শুধু ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ও সদস্যসচিব আবদুস সালামের ওপর দলের নির্ভরশীলতাও বড় ধরনের ভুল।

এ থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, চেয়ারপারসনের পদ থেকে পদত্যাগ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি করে সব কমিটি ভেঙে দিতে হবে। ৫০১ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বাছাই করে কেন্দ্র পর্যন্ত স্বচ্ছভাবে দক্ষদের দিয়ে কমিটি গঠন করবে। তাহলেই বর্তমান সরকারকে মোকাবিলা করে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.