মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ
সাজুবীর। নামে থাকলেও চলনে-গঠনে বীরের ছোঁয়া নাই। হ্যাংলা- পাতলা। তালগাছের মত লম্বা। পড়ালেখা সাধারন।
একমাত্র বীরত্বের জায়গা মোবাইল আলাপে। সোহরাব-রুস্তম এর বিখ্যাত লড়াইয়ের উত্তেজনা তার কথার জাদুর কাছে পানসে।
সাজু কিন্তু আগে এমন ছিলনা। মুখচোরা ছিল। উন্নতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে।
সত্যি বলতে ডি-জুস ম্যানিয়ার সময় বাইশ বছরের তরুনটির এই ঈর্ষনীয় গুনের প্রকাশ পায়। এর আগে বন্ধু মহলে, আড্ডায় তার উপস্থিতি ছিল নীরবতায় ভরপুর।
শ্যামলা বর্ণের লাজুক ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ পর্যন্ত পড়ালেখা কো-এডুকেশন বর্জিত। বয়েজ স্কুল, বয়েজ কলেজ ।
তরুনীরা ছিল তার কাছে অচেনা জগৎ। প্রাইভেট পড়তে গেলে ওখানে জনা কয়েক ছাত্রী পড়ত। কিন্তু ওর চালবাজ বন্ধুরা তাদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকত যে, সাজুরা কাছে ভিড়তেই পারত না। দু-একবার যে সে চেষ্টা করেনি তা নয়। বহুবার মনে মনে রির্হাসেল করে প্রস্তুিত নিয়েছিল।
কিন্তু পরদিন কথা বলতে গেলেই ওর গলা দিয়ে আওয়াজ আর বেরুত না। নারী তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এক রহস্য ঘেরা জগৎই ছিল সাজুর কাছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সাজুর যে রাতারাতি পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। সেই একই সমস্যা। সরাসরি কথা বলতে গেলে তোতলামি আসে।
খালি শংকা। না জানি ও যুবতী কি মনে করে? দুবারের জায়গায় তিনবার কথা বললেই সহপাঠীদের ঠাট্রা। ক্যাম্পাসে জুটিদের দেখে লম্বাটে মুখের ছেলেটির বিশাল হৃদয়ও কেমন জানি করে। কোন সহপাঠিনীর সাথে কথা বললেই কল্পনা শুরু হয়ে যায়। মরুভূমিতে এক ফোঁটা পানি পড়লে যা হয়।
কিন্তু ও পর্যন্তই। আর কিছু করার মত সাহস বা অভিজ্ঞতা দুটোরই কমতি ছিল তার ।
ফাস্ট ইয়ার- সেকেন্ড ইয়ার চলে যায়। সাজু একা হতে থাকে। বিশাল ছেলে বন্ধুদের আড্ডা ছোট হতে থাকে।
কেউ প্রেমে, কেউ টিউশনিতে, কেউবা রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ ফটোগ্রাফী, সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে। কেউ রক্তদান, কাপড় দানের মত স্বেচ্ছাসেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোতে যে ওরা কি মজা পায় তা সে বুঝে না। তবে মাঝে মাঝে ওদের হিংসা হয়।
মোষ তাড়ানো দলের ভেতরের ভাব-ভালবাসার জুটির পরিসংখ্যান ঈর্ষণীয়।
সাজুর মত ছেলেরা এসব দেখতে দেখতে এক সময় চাকুরীর পড়ালেখায় ব্যস্ত হতে থাকে। মধ্যবিত্ত সমাজের অংশ হতে ওদের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রেম আর ওদের জীবনে আসে না। কল্পনা পিছু ছাড়ে না।
এরই মধ্যে ছোট হতে থাকা পৃথিবীর প্রভাব তার জীবনে আসতে থাকে। মোবাইল আসে। ইন্টারনেট তার আগমনের জানান দেয়া শুরু করে। সাইবার ক্যাফেতে আনাগোনা বাড়তে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা বিশ টাকায় সারা পৃথিবীর সাথে পরিচিতি বাড়ার উন্মাদনা।
বৈধ-অবৈধ জিনিসের উন্মাদনা। সাজুর আজ বন্ধুর অভাব নাই। ছেলে থেকে মেয়ে বন্ধু বেশী। হোক না তারা ভারচুয়াল জগৎতের মানুষ তবু নারী তো। ইন্টারনেটে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী আর তার ভাই - ব্রেদারদের নাটক ফ্রিতে পাওয়া যায়।
কেবল ডাউনলোড দেয়া আর দেখা। ওদের মত করে কথাবার্তা বলা। ছেলেদের রাতের আড্ডায় সাজুর কদর বাড়তে থাকা।
তারপর মোবাইল ম্যানিয়ার যুগ। কত কথা বলেরে - এর যুগ।
যার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল কেবল মিসকল, তার শ্রবন অঙ্গে মোবাইল ফোনের সরব উপস্থিতি আজ এক পরিচিত দৃশ্য। ফ্রি ডি-জুস আর অন্যান্য অফার রাতের ঘুম কেড়ে নিল। সারা রাত কথা উৎসব। একই কথা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনকে ওর উপস্থাপন সবাইকে চমৎকৃত করতে লাগল। সামনে স্বীকার না করলেও মনে মনে সবাই স্বীকার করল নাহ, ছেলেটা কথা বলতে পারে।
মোবাইলে প্রেমের কায়দা, নতুন নতুন নম্বরের খোঁেজ সবাই আসে সাজুর কাছে। ছোট-বড় সকলের তীর্থস্থান।
চারদিকে প্রেমের ছড়াছড়ি। আজ সে প্রেমিক মানুষ। যুবতীরা আজ কানের কাছে অনবরত ফিসফিস করে।
নাটকের নায়কদের ছায়া তার কল্যাণে আজ পথে ঘাটে দেখা যায়। তরুনীরা নাটক দেখে আর ওদের চারদিকে সাজুদের মিলিয়ে নেয়। ওদের জীবনে সাজুরা ঘোরাঘুরি করে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক ধাঁচের কিংবা শরৎবাবুর মত শত দুঃখ সহ্য করা পারু-দেবদাস এর সুখ বির্বজিত ভালবাসায় তাদের ভরসা নাই। কেন থাকবে? রূপালী পর্দার উত্তম-সুচিত্রারাও তো আজ অধৈর্য্য।
ফাউন্টেন কলম বিদায় নিয়েছে। এখন বলপেনের যুগ। কষ্ট করে কালি ভরতে হয় না। গায়ে কালিমা লাগার ভয় নাই। ফুরিয়ে গেলে, সমস্যা হলে ছুড়ে ফেলে দিলেই হয়।
ঠিক করার তাড়া নাই। সস্তা জিনিস নিয়ে কেউ ভাবে নাকি!
ছাত্রজীবন শেষ হল। চাকরী আসে ব্যাচেলর লাইফে। জীবনের উপভোগ শুরু হয়। সারাদিন কর্মব্যস্ত দিন।
দম ফেলবার সময় নাই। দিনে কাজ, রাতে মোবইলে আলাপ। দ্রুত অপর পাশের পার্টনার পরিবর্তন হয়। যাওয়া আসার মধ্যেই থাকে ওরা। আলাপ কিন্তু একই রকম থাকে।
পানীয় একই, কেবল বোতল পরিবর্তন হয়। তারপরও ভাল লাগে। কারও সাথে দেখা হয়, খুনসুটি হয়, বন্ধু লিটনের ফ্ল্যাটে বেড়াতে যাওয়া হয়। কারও সাথে কখনওই দেখা হয় না। কিন্তু নিত্য নতুন আলাপের ভিড়ে সকলেই হারিয়ে যায়।
না হারালে মজা কই?
অনেকদিন সহপাঠীদের সাথে দেখা হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সে সুযোগ করে দেয়। রাতে কত গল্প, আড্ডা। কেউ কেউ বিয়ে করেছে। কেউবা পাত্রী খুঁজছে।
এ নিয়ে কতই না দুষ্টামী। লোডশেডিং এ আলাপে ছেদ পড়ে।
ছাদে যায় তারা। একটু বাতাস, একটু আলাপের জন্য। এখন আর এত আলাপ ভাল লাগে না।
কিন্তু একক বিশ্বস্ত সঙ্গী না খুঁজে পাবার ভয়ে আলাপ ছাড়তেও পারে না। ছাদে গিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জোনাকীর আলো খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ছয়তলা উঁচু ছাদকে। বড়ই সুন্দর তার শোভা। কিন্তু এত উপরে জোনাকী আসল কিভাবে?
একটু পর সাজুর চমক ভাঙ্গে।
ওগুলো জোনাকী নয়। মোবাইল ফোনের মিটমিটে আলো। জুনিয়র ছেলেদের আলাপের আসর চলছে। এখন ফ্রি অফার নাই। বরং রংয়ের যুগ।
আলাপ চলছে। লজ্জা-শরমের বালাই নাই। যে শালীনতার মাত্রা সাজু রুমের ভিতরে পার করত আজ তা খোলা জায়গায় পার হচ্ছে। বাতাসে ময়নাদের মালা নিয়ে উড়াউড়ি। কথার মালা।
যায়, আসে।
এ জোনাকী পোকার আলোগুলো সেই থেকে সাজুদের মাথায় বসত গড়ে। বারবার চেষ্টা করেও তারা ওই ছবি তাড়াতে পারে না। লাইটহাউজের মত অষ্টপ্রহর মাথার ভিতরে জ্বলজ্বল করে। কেবলই জীবনের ডুবোচরের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে।
নারী তাদের কাছে আজ আবার রহস্যময়। ভবিষৎতের সংসারে জোনাকীরা আলো ছড়াচ্ছে। সে আলোয় অন্ধকার জমাট বাঁধছে। জমাট অন্ধকারে সাজুরা আলোবিহীন অন্ধকার খুঁজে ফিরছে।
(লেখাটা এর আগেও একবার পোষ্ট করেছিলাম।
ড্রাফট করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত মুছে যাওয়ায় আবার দেয়া হল। আগেরটা থেকে কিছুটা পাল্টে নিয়েছি। ভুল যদি করে না থাকি তবে এটাই মনে হয় সামুতে আমার প্রথম পোস্ট ছিল । )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।