আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প : সেখানে সুলভ মূল্যে কবর বিক্রি হতো

পাখি এক্সপ্রেস

(১) এ হচ্ছে আমার হাঁটু। এখানে জমে আছে পাবলো পিকাসোর জীবনে আসা সর্বশেষ নারীর অপ্রকাশিত হাসি। পায়ের পাতায় ভর করে মাথা থাকে। মাথার ভেতরে রাফায়েলের অর্ধসমাপ্ত সুদর্শন যুবক। তার পাকস্থলী আঁকা যায়নি।

আমারও পাকস্থলী নেই। হাতের যে ব্যাগ দেখা যাচ্ছে তা কিছুক্ষণ পর কাঁধে যাবে। তিনশ টাকার রেভিন্যু স্ট্যাম্প আর একটি ঝর্ণা কলমের খোসা। বিবিধ যা আছে তা ভুলে গেলাম অথবা বললাম না। এর বাইরে আর কিছু নেই।

এখন বেরুবো। না, আপনারা কেউ যাবেন না। শেষ যাত্রা বলেই যাবেন না। ভিনসেন্ট ভ্যানগগ ১৮৯০ সালে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। সুযোগ পেলেই নিজের প্রতিকৃতি আঁকতেন।

কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন। মৃত্যুর কোন চিত্র আঁকতে পারেননি। গুলি খাওয়ার পর যতক্ষণ বেঁচে ছিলেন, ততক্ষণ বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু চেষ্টা তার ছিলো! অথচ একবারও মনে পড়েনি যে তিনি একজন শিল্পী। আমার জন্ম নিয়ে তখন ঈশ্বরের সভায় হট্টগোল হচ্ছিলো। একদল বুদ্ধিমান কর্মচারী পরবর্তী শতাব্দীতে পৃথিবীর মানুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাবে বলে চিৎকার করে ঈশ্বরকে বলছে জন্ম বাড়িয়ে দেয়ার জন্য।

তবেই বাতাসের সাথে মানুষের অনুপাত সহ্যক্ষমতার মধ্যে থাকবে। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো আমার আত্মা বানানো হবে কাপড় দিয়ে। ড্রাপারি হবে ঋতু বদলের সাথে সাথে। ওপরে পল্লী গীতিকার ক্যালিগ্রাফি থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে সাধারণ জন্ম হলো বাংলা মাস ভাদ্রে।

সেদিন রোদের ওপর রোদ ছিলো। জল জল বলে চিৎকার করছিলাম। অথচ জলে শান্তি ছিলো না। জলের ওপর থেকে জল উড়ে গিয়ে আকাশ ছুঁ'তে চাইছে। তারপর পুরো ক্যানভাসে আমি অ্যাবস্ট্রাক্ট।

জীবনকে বাতিল করার সাহস যোগানোর আগ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখার পক্ষে আমি না। জীবনী লিখতে লেগেছে একদিন। সকালে বাতিল করে ভোরের আগে গুছিয়ে নিতে পারলাম। পুরো জীবনে কেবল এ কাজের সফলতা শতভাগ। মায়ের সামনে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিলাম।

তিনি বুঝতে পারেননি। তারপর সারাদিন তার আঁচল ধরে ঘুরলাম। মানুষটি অহেতুক ঋণী করে রাখলেন। যদিও তাকে ক্ষমা করতে কষ্ট হয়নি। (২) আমার কবর হবে পৃথিবীর সবচে সুদর্শন কবর।

প্রথাবিরোধী কবিদের বুকের হারমোনিয়াম রীডে ঘেরা থাকবে নিরাপত্তা প্রাচীর। বর্ষায় ডুবে যাবে এবং বসন্তে গোপন হবে। সূর্যরাশির কয়েকটি আরশোলা গভীর রাতে বিলাপ করবে আমার মায়ের জন্য। যিনি ঘুমানোর আগে নিয়ম করে মন খারাপ করবেন। উদ্ভিদ হিসেবে কেবল সুগন্ধি লতাপাতাকে অনুমতি দেয়া যাবে।

কোন কাঠ এবং রসালো ফলের গাছ জন্মাবে না। আর কোন নির্মাণ কিংবা বিশ্রাম এখানে হবে না। অগাস্ট রডিন যেদিন দ্যা থিঙ্কার ভাস্কর্যের সমাপ্তি ঘোষনা করেন, কেবল সেদিন কিছু অন্যমনস্ক পাখি রাতে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিতে পারবে। তাদের জন্য গজে উঠবে হলুদ পাতার ডালহীন গাছ। পাতাগুলো আমার স্বপ্নের ওপর ভর করে শুয়ে থাকবে।

এসব বিষয় নিয়ে দরকষাকষি চলছে। পুরো জীবনে অর্জিত সমস্ত শিল্পের দামে এ অধিকার কিনতে চাই। আমি এখন শবাচ্ছন্ন নদীর কিণারে। ব্যাগের ভেতর পুরোনো দিনের গানগুলো বেজে যাচ্ছে। তারপর লোকটি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন - ◄ মেসোলিথিক ► অর্থ বলো ◄ এ সময় মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করতে শেখে।

বেঁচে থাকার গুরুত্ব বুঝার প্রাথমিক কাল। ► একটি প্রশ্নের জবাব দাও। তোমার জন্ম কিভাবে হয়েছে? ◄ তারও কয়েক শতাব্দী আগে কিছু আলোর কণিকা পথ হারিয়েছিলো। সেদিন তাদের মিলনের আনন্দে আমার জন্ম হয়। ► তবে তোমার মা এবং বাবার প্রেমের ফল কি? ◄ পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ পূণ্য করার তাগিদ পেলো।

► দু:খিত এটি হচ্ছে লাভ ম্যারেজ এ জন্ম হওয়া মানুষদের জন্য। তুমি যাবে সামাজিক বিয়ের বুথে। লোকটি হাত বাড়িয়ে যেদিকে ইশারা করলো, সেদিক থেকে জলের শব্দ আসছে। আমি শবাচ্ছন্নের দিকে এগুচ্ছি। পথে পথে ব্যর্থ মানুষদের প্রায়শ্চিত্ব অথবা বিমূর্ত চিত্র।

কয়েকজন পাখি আর কয়েকটি শিশু কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে। অথচ তারা এখনও জীবনী লিখেনি। আশ্চর্য তাদের জীবনবোধ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখানে ভিড় করে আছে। আবার একদল কবিকে দেখছি নদী পাড়ের গোল গোল পাতায় প্রশ্ন লিখে যাচ্ছে।

ভোর হলেই একেকটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়ে উঠবে। অবিশ্বাস্য সব প্রশান্তিকে দু'পাশ করে জলের বুকে পা রাখতেই রাত তার স্থায়িত্ব নবায়ন করে। কৃতজ্ঞতায় এক লাইন কবিতা আবৃত্তি করলাম। জলের গন্ধ আর আমার স্ত্রীর ঘাঁড়ের গন্ধ একই। সে আমার খুব পরিচিত।

মানুষ নিজেকে কত ভালোবাসতে পারে, তাকে না দেখলে বুঝবেন না। তার কাছ থেকে শিখেছি সন্তান জন্ম দেয়ার পর তার প্রতি বিস্তর মমতা যেমন খুবই দরকারি, জন্মের পূর্বে তার ভ্রুণ নষ্ট করার ঘটনা ততটাই স্বাভাবিক। আঁকড়ে ধরার অসাধারণ ক্ষমতার এসব মানুষের জীবনে খুঁটির পরিমান বেশি বলে জীবনের স্থায়িত্বও বেশি। আর বেঁচে থাকার শেষের দিনগুলো অহেতুক অনর্থক। তারা তখন নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমের আন্দোলন করে।

(৩) ► মৃত্যু বলতে কি বুঝো? ◄ জন্ম নেয়ার ঋণ শোধ করা। ► জীবনীটা টেবিলের ওপর রাখো। ◄ আমার কিছু কালি দরকার। খুন করতে যাবার আগে মানুষের রক্তের যে রঙ হয়, সে রঙের। ►তোমার কোন কবিতারই সমাপ্তি নেই।

◄ আমার দেহটাও সম্পূর্ণ না। অসম্পূর্ণ দেহ নিয়ে কবিতা শেষ করা যায় না। ► আশ্চর্য! তোমার পাকস্থলী কোথায়? ◄ যেদিন শুনেছি কবিদের পাকস্থলী থাকতে নেই, সেদিন ফেলে দিয়েছি। ► কিন্তু পাকস্থলী ছাড়া মানুষদের জন্য কবর বিক্রি করার কোন নিয়ম নেই। ◄ অথচ রাফায়েল তার সর্বশেষ চিত্র দি ট্রান্সফিগারেশন শেষ না করেই মৃত্যুবরণ করেন।

এসব নিয়ে ঈশ্বরের সভায় অনেক বাকবিতন্ডতার পর আমাকে জন্ম দেয়া হয়। আর আমি ব্যর্থ হলাম। ভালো করে পড়ে দেখুন আমার জীবনী। শাদা পোশাকের মানুষটির গায়ে ড্রাপারির নীচে কোন পাকস্থলী নেই। রাফায়েল আমার কোন প্রতিকৃতি এঁকে যাননি।

শাদা পোষাক পরিহিত মানুষটিই আমি। এ দাবী করছি। আপনি তা মেনে নিন। ► তুমি আমাকে অস্থির করো না। আমাদের এখানে গত কয়েকদিনে একটি কবরও বিক্রি হয়নি।

◄ দেখুন, কাঁধের ব্যাগে পৃথিবীর সব প্রথাবিরোধী কবির বুকের রীড, সূর্য রাশির আরশোলার প্রাণ এবং হলুদ পাতার বীজ আছে। আমি সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। রাত আর তার স্থায়িত্ব নবায়ন করবে না। সুতরাং সূর্যোদয়ের আগে চুক্তিনামা লিখে ফেলুন। কারণ আমার স্ত্রী এতক্ষণে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো।

তার গর্ভের ভ্রুনটি আমার ভুলে সৃষ্টি হয়েছে। ► এখনো তোমার নি:শ্বাস তীব্র হয়নি। মৃত্যুর কোন শর্তই মানছো না। ◄ আপনি অহেতুক বিশৃঙ্খলা করছেন। এখন আর পাকস্থলী ফিরে আনানো সম্ভব না।

ওই স্থানে বেড়ে উঠেছে গ্রহের সবচে বড় বৃক্ষ। যাকে কেন্দ্র করে নতুন সভ্যতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। ►একটি মাত্র সুযোগ আছে। আবার পৃথিবীতে ফিরে আসার অঙ্গীকার করতো, চুক্তিনামা লিখতে পারি। - আমি না....আ বলে চিৎকার করে উঠলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।