(হ্রদয় ছোয়ার মত ঘটনাটি পুরো পড়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ রহিল। অনুগ্রহ করে রাজনৈতিক মন্তব্য না করে গঠনমুলক মন্তব্যর প্রত্যাশা করছি)
প্রবাসী রহমান ভাই ২৫ বছর যাবত সৌদি আরবে থাকেন। রহমান তার নামের দ্বিতীয়াংশ। সামাজিকভাবে হেয় না হবার জন্যই এটি ব্যবহার করেছি।
প্রথমে তিনি মক্কায় থাকতেন।
৬ বছর হোটেলে চাকুরী করার পর নিজেই হোটেল ব্যবসা শুরু করেছেন। বিয়ে করেছেন। এখন তিনি দু'সন্তানের জনক। মক্কায় পড়ালিখার ভাল সুযোগ সুবিধা না থাকার কারনে রহমান ২০০৫ সালে জেদ্দায় একটি ইংরেজী স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করিয়েছেন। স্কুল বাসে মক্কা আসা যাওয়া সন্তানদের জন্য কষ্টের বলে অবশেষে স্কুলের পাশেই ছড়া দামে বাসা নিয়েছেন।
জেদ্দায় বাসা নেয়ার কারনে এখন আর নিয়মিত মক্কা যাওয়া হয়না। বাংলাদেশী কর্মচারীদের উপর আত্মবিশ্বাসের কারনে এখানে বসেই প্রায়ই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতেন। এক বছর না যেতেই বাংলাদেশী কর্মচারীরা প্রলোভনে পড়ে, অন্য বাংলাদেশীর সাথে ফন্দি করে তার সৌদি স্পন্সারকে দিয়ে হোটেলটি আত্মসাত করে ফেলেছে। এমনকি, মালিক তার ব্যক্তিগত গাড়ীটিও ছিনিয়ে নিয়েছে। এ নিয়ে কোট কাছারি অনেক হলেও পরিশেষে ক্ষতিটাই বেশী হয়েছে।
কয়েকমাস পর সৌদি মালিক পাসপোর্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তার পাসপোর্ট জমা দিয়ে বলেছে, সে পালিয়ে গিয়েছে। অনেক প্রচেষ্টা করেও আজ অবদি এর কোন গতি হয়নি।
রহমানের পরিবার চালানোর জন্য এখন আর কোন পথ বাকী থাকলোনা। আকামার মেয়াদ শেষ হলেও আর নবায়ন করতে পারেনি। বাসা ভাড়া, দুই সন্তানের স্কুল খরচ মিলিয়ে মাসে ৪ হাজার রিয়াল খরচের বোঝা বইতে গিয়ে তার অনেক দেনা হয়ে গিয়েছে।
এ দিকে স্কুলে ৬ মাসের বেতন বাকী থাকাতে স্কুল কতৃপক্ষ সন্তান দুটিকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দেয়নি।
দু'মাস পর সেপ্টেম্বরে আবার নতুন ক্লাশ শুরু হযেছে। বাসার জানালা দিয়ে অন্য ছাত্রদের আনাগোনায় এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। বড় ছেলেটি অনেকটা বুঝের হলেও, ছোটটি সবেমাত্র ক্লাশ ত্রি (৩) তে পড়ে। ছোট ছেলের অবুজ মন যেন কোন কিছুই মানতে চায়না।
সে শুধু বুঝে, আমি স্কুলে যাবো। মায়ের হাজারো যু্ক্তি তাকে আরো বেপরোয়া করো তুললো। সকাল হতেই বাচ্চাদের আওয়াজে সে জেগে উঠে। জানালা দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। আর বলে, মা প্লীজ... আমাকে স্কুলে যেতে দাও।
ঐ যে দ্যাখ, আমার সাথে সবাই স্কুলে এসেছে।
কলিজার টুকরো অবুজ ছেলেকে স্কুলে যেতে দিতে না পারার বেদনা একজন মায়ের জন্য মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত। তাই নীরবে নিভৃতে "বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই .. কবিতার মত মুখে আঁচল দিয়ে মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে । যখনই বাসায় যেতাম ভাবীকে দেখতাম চোখ দুটি লাল হয়ে আছে।
সেদিন ছিল শূক্রবার।
বাসায় গিয়েছি আমার স্ত্রীকে নিয়ে। হাজারো কথার ফাঁকে বাচ্ছাদের পড়ার কথা বলতে গিয়ে ভাবী বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত ফ্যাল ফ্যাল করে কেঁদে ফেললেন। বললেন,
বুধবার সকাল। স্কুলে সপ্তাহের শেষ দিন। ছোট ছেলে সকাল ৭.৩০ মিনিটে উঠেছে।
তার আজ মনে অনেক বেদনা। সে আজ স্কুলে যাবেই। কতদিন হলো মা তাকে স্কুলে যেতে দিচ্ছেনা। তাই সে নিজে নিজেই সংগোপনে স্কুলের পুরোনো ড্রেস আর পানির ফ্লাক্স, অযত্নে ফেলে রাখা স্কুলের পুরোনো ব্যাগটি কাঁধে নিয়েছে। ব্যগে বই নেই।
তবুও সে যাবে। দরজা দিয়ে বের হবে, এমন সময় মা জেগে উঠেছে। ড্রইং রুমে এসে সন্তানের এ অব্স্থা দেখে ছেলেকে জড়িয়ে মা আহত পাখির মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
মা কাঁদছে। আর ছেলে স্কুলে দেরী হবার তাড়ায় বার বার ছুটতে চাচ্ছে।
মায়ের এ অব্যক্ত বেদনার চেয়ে তার স্কুলে যাওয়া অনেক জরুরী। তাই মায়ের আদর মাখা হাত দুটি হতে ছুটে যাবার জন্য ছেলে কার্পেটের উপর বসে মায়ের পা দুটি জড়িয়ে ধরেছে। আর খুব অনুনয় বিনয় করে মাথা উচু করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো -
"মা, প্লীজ, আমাকে একটি বারের জন্য স্কুলে যেতে দাও ! আমি আমার ব্ন্ধুদের সাথে অন্ততঃ একটি দিন ক্লাশ করে আসি। আমি পড়তে চাই মা। কথা দিচ্ছি, এখন থেকে আমি আর দুষ্টামি করবোনা।
ভালো করে পড়ালিখা করবো। "
ছেলেটি স্কুলে গেলে তাকে ক্লাশে ঢুকতে না দেয়া আরও অপমানি। কিন্তু কে বোঝাবে এতসব এ অবুঝ শিশুকে? একজন পাষন্ড মায়ের মত ছেলেকে স্কুলে যেতে বারন করতে গিয়ে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। .....এর পর মা আর জানেনা কি হয়েছিল।
দু'ঘন্টা পর হুশ ফিরে এলে শুধু দেখলো, ছোট ছেলে তাকে জাড়িয়ে কাঁদছে, আর বলছে, মা আমাকে মাফ করে দাও।
আমার জন্য তুমি বেঁহুশ হয়েছ। এখন থেকে আমি আর স্কুলে যাবোনা।
"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...", বাবা রহমানকে এ প্রিয় গানটি আর কখনো বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাতে দেখা যাযনি।
ছেলে দুটোকে নিয়ে এখন আর অন্য দশটি বেড়ে উঠা সন্তানের মত ঘুম পাড়ানো গান শোনানো হয়না। স্কুল হতে ভেসে আসা সকাল বেলার পাখিদের গান ওরা এখন আর শুনতে পায়না।
ওরা এখন রাত জেগে টেলিভিশন দেখে। সকাল বেলায় মসজিদের মিনার হতে মোয়াজ্জিনের আওয়াজ ভেসে আসলে ঘুম পাড়ানো গান শোনানো ছাড়াই চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘূম ভাঙ্গে বিকেল ৪টায়। উঠে সকালের নাস্তা করে।
রাত দুপুরে ওদের লান্স হয়, ভোর ৫টায় ওরা রাতের খাবার খায়।
এভাবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হাজারো হ্রদয় ছোয়া ঘটনায় এখানকার বাতাস দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে। কে শুনবে সে কাহিনী? আমরা জীবন দিয়ে ভাষা চিনিয়ে আনলাম, এক সাগর রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনা হলো। ক্নিতু সে স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিকদের কচি খোকাদের ভাষা শেখা হলো কি হলোনা, কে সে খবর রাখে?
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী জেদ্দা এলেন। শুক্রবার বিকেল ৪টায় "জামেয়া"য় একটি হল রুমে জেদ্দা প্রবাসীদের সামনে মত বিনিময় করবেন।
দুপুর ২টায় গিয়ে কোট-টাই পরে হাজার হাজার বাংলাদেশী অধীর আগ্রহ নিয়ে জড়ো হলো। হঠাৎ দুর থেকে দেখতে পেলাম, পুলিশের লাঠিচার্চ। তার পর লাথি খাওয়ার দৃশ্য... । তবুও প্রতীক্ষার প্রহর গুনলাম। প্রধানমন্ত্রী আসলেন।
অনেক আশার বানী শোনালেন। তার পর চলে গেলেন। আমরা আবারও অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা শুরু করলাম। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। কিন্তু প্রতীক্ষার সে প্রহর আজো শেষ হয়নি?
আমাদের সন্তানদের বয়স ১৮ বছর হলেই অসম্পুর্ন পড়ালিখা রেখে দেশে চলে যেতে হয়।
আমরা কত ভালো চাকরি হারিয়েছি। কত সম্ভাবনাময়ী সুযোগ খোয়েছি। কত ব্যবসায়ী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এতসব ঘটনার পর ও যখন কোন "টিভি টক শোতে" মন্ত্রী-এমপিদের মুখে বলতে শুনি, সৌদি আরবে কোন সমস্যা নেই...তখন আমরা বলার মত ভাষা খুঁজে পাইনা।
মাননীয়া প্রধান মন্ত্রীর নিকট আমার প্রশ্ন - আমাদের এ প্রতীক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে জানতে পারি কি.........?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।