ইনাম বিন সিদ্দীক :
ড্রাইভার দ্রুত চালাও। বৃষ্টি এসে যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ার আগে আগেই বাসায় গিয়ে পৌঁছুতে হবে।
জুমআর নামাজ পড়ে শান্তকে নিয়ে গিয়েছিলাম একটা দাওয়াতে। শান্ত আমার ক্লাস মেট।
বন্ধুও বটে। তাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া মানে সারাক্ষন ফুর্তিতে থাকা। ভাল মজা করতে পারে। গান টান গাইতে পারে। কোন কারনে মন খারাপ হলে শান্ত গান পরিবেশন করে মনটা শান্ত করে দেয়।
দাওয়াত শেষে এবার শান্তর আবদার। দোস্ত বাসায় চল। তোর সাথে পরিচয় হওয়ার পর একদিনও আমার গরিবালয়ে যাসনি। আজ মানা করতে পারবিনা।
আসলে, শান্ত এমন একটা ছেলে, কথাগুলো এমন ভঙ্গিতে বলে একদম গলে যাওয়ার মতো।
বারন করা আর সম্ভব হয়না। চলে গেলাম তার বাসায়।
পরিচয় হলাম তার মা, ভাই, বোনদের সাথে।
খুব মিলের মানুষ শান্তর মা। কথা-বার্তা যথেষ্ট ভদ্রতার ছাপ।
-খালাম্মা আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ ভালো। তুমি ভালো আছতো বাবা?
-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
জিজ্ঞাসাটা একদম নিজের সন্তানের মত মনে হয়েছে। আমার মনে হয় অনেক মায়েরা তার আপন সন্তানের বেলায়ও এই ভূমিকা পালনে সচেষ্ট নয়।
আদর আপ্যায়নেতো আমি অবাক! চেনা নেই জানা নেই, হটাৎ করে আসলাম, আর এত ক্বদর! ভালই লাগলো।
শান্তর বাসা থেকে বের হয়ে আসরের নামাজ আদায় করলাম। কিছুক্ষন রিক্সায় চেপে বসলাম। কিছুদুর আসার পর ড্রাইভার বলে উঠলো,
-মামা নামেন।
-কিরে আর যাবানা?
-না মামা।
এদিক গেলে মেলা জেগা ঘুইরা আসতে হয়।
-ও।
হেটে হেটে পার হলাম সুরমার পুরাতন ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে আমার গন্তব্যে আসার জন্য কয়েকটা ড্রাইবারকে ডাকলাম। একটা ড্রাইবারও রাজি হচ্ছেনা।
জায়গাটার নাম শুনা মাত্র যেন ড্রাইবারদের গা জলে উঠে। না হয় আসবেনা কোন দুঃখে?
যাক অবশেষে দাড়িওয়ালা এক চাচাকে পেলাম।
-চাচা যাবেন?
-কোথায়?
-গোটাটিকর।
-দশ টাকা দিয়েন।
ভাবলাম বার্গেডিং করে ফায়দা টায়দা হবেনা।
উঠতেই হবে।
মুহুর্তেই উঠে গেলাম।
চলতে শুরু করল পা ইঞ্জিনের তিন চাকার রিক্সাটা।
কিছুদুর আসতেই শুরু হয় আকাশের পরিবর্তন। অন্ধকারটায় জানান দিচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে বৃষ্টি।
ঘন ঘন বিজলী মনের পরিবর্তনে ব্যস্ত। অবস্থা ব্যগতিক দেখে ড্রাইবারকে বললাম-
‘ড্রাইভার দ্রুত চালাও। বৃষ্টি এসে যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ার আগে আগেই বাসায় গিয়ে পৌঁছুতে হবে’।
ড্রাইভার মনে এক রকম শক্তি নিয়েই বললো-
-বাবারে! বৃষ্টিতো আমি বা কোনো মানুষ দিচ্ছেনা যে, আমি তার আগে আগে চলতে পারবো।
বললাম,
-চেষ্টা করে দেখো, চেষ্টা বলেওতো একটা মাধ্যম আছেনা!
ড্রাইভারের পা দুুটি প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে, শান্ত কন্ঠের আওয়াজ
-বাবা! বললামনা বৃষ্টিতো আর কারো ইচ্ছনুযায়ী আসেনা, শুনেছি আলেম-ওলামারা বলেন, বৃষ্টি এটা আল্লাহর একটা রহমত, আল্লাহ যদি কোনো কিছু করার ইচ্ছা করেন, তখনকি আমি আর তাঁর সাথে মোকাবেলা করতে পারি? এখন যদি বৃষ্টি এসেই যায়! তাহলে তো এটাকে আল্লাহর একটা রহমত মনে করা উচিত! কি ঠিক বলিনাই?
বেচারা ড্রাইভারের দীর্ঘ কথা আমি শুনেই যাচ্ছি। বেটার প্রশ্নবোধক কথায় সম্বিত ফিরে পেলেও কি বলবো তা নিয়ে ভাবছি। ড্রাইভার বেটার কথা শুনেতো আমি অবাক! অবাক হওয়ারই কথা। আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস, নবী-রাসূলের প্রতি তার ভক্তি! একি সাধারণ কথা!
বেটাকে নিয়ে আমি মোটামোটি ভাবনায় পড়ে গেলাম। এতো সাধারণ মানুষ হতে পারেনা! তার কথা বার্তার মধ্যে যেন কি একটা বিষয় লুকিয়ে আছে।
কেমন রহস্য রহস্য মনে হচ্ছে।
রহস্য জিনিষটা আমার আবার খুব প্রিয়। রহস্যের ঝট খুলতে আমি যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে রাজি থাকি। কিন্তু! বেটা ড্রাইভার আমাকে কোন রহস্যে ফেলল!
ড্রাইভার যখন বলেছিলো কি এটা কি আল্লাহর একটা রহমত স্বরূপ না?
আমার ভিতর কৌতুহলের সমীরন। বেটাকে জানার চেষ্টা করছিলাম।
বললাম : বৃষ্টিতে ভিজলেতো শর্দি-জ্বর হয়ে যায়, তাহলে?
তাতে আমার যায় আসে কি? যে শদি-জ্বর দেবে, সেইতো আবার উঠায়া নেবে। ড্রাইভারের জোরালো কণ্ঠ।
সে বলেই যাচ্ছে,
আমি যদি সারাক্ষন আল্লাহর যিকির আজকারে মগ্ন থাকি, রাসূল স.-এর উপর দুরুদ পড়ি, ওলী-আউলিয়াদের জন্যে দুআ চেয়ে দুআ করি, তাইলে কেন আল্লাহ আমারে বিপদে ফালাবে? আমার ঈমানকে যদি মজবুত রাখতে পারি তাইলে আর কিসের ভয়? তাই ঈমানটা মজবুত করার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছি। দুআ কইরেন বাজান।
ড্রাইভারের এসব কথা শুনে আমার চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ স্পস্ট।
যদিও নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু অনুভব করতে পারছি পুরোটাই। কাছে একটা আয়না থাকলে তার কিছুটা হলেও বিবরণ দিতে পারতাম।
ভাবছি এসব হুজুরী টাইপ কথা কার মুখ থেকে বের হচ্ছে। একি আসলেই কোন ড্রাইভার! চেহারা, কথা, আচার ভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে আভিজাত্য পরিবারের কোন সন্তান। আমি মাদরসায় পড়–য়া হয়েও কেমন যানি তার কাছে হেরে যাচ্ছি।
তার দৃঢ় কথার প্রতোত্তরে মনে হয় আমি কুলিয়ে উঠতে পারবনা। কখনো তার যবান থেকে কুরআনের আয়াতের তরজমা, সহী হাদিস, বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নবী-সাহাবাদের দৃষ্টান্ত! সত্যিই আমাকে বিস্মিত করছে।
কথা বলতে বলতে এক সময় রিক্সা থেমে গেল। চেয়ে দেখি আমি বাসার সামনে। এদিকে মেঘের কানফাটা গর্জন।
বিজলীর চমক বেড়েই চলছে ক্রমশ। রিক্সা থেকে নেমে নিজেকে আর সামলাতে পারছিনা। মানুষটাকে জানার জন্যে আগ্রহটা প্রচন্ড ভাবে বেড়ে গেল।
ভাড়া মেটানোর এক ফাঁকে বললাম,
-চাচা আপনাকে দু’টা কথা জিঙ্গেস করবো, মনে কিছু নিবেন নাতো?
ড্রাইভার অত্যন্ত মার্জিত আর নম্র স্বরে বলল,
-কি যে বলো বাবা! আমি আবার কি মনে করবো?
-তাহলে জিজ্ঞেস করতে পারি?
-অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারো।
-আপনার বাড়িটা কোথায়?
-যশোর।
-আপনার কথা-বার্তায় বুঝা যাচ্ছে আপনি খুব শিক্ষিত এবং ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত, কিন্তু!.......
-বাবা! আমি আসলে পেশাগত ড্রাইভার না।
ড্রাইভারের কণ্ঠটা যেন জমে আসছিলো। একটা ঢুক গিলে আবার বলতে শুরু করলো,
-আমার অনেক সম্পদ ছিলো। আমার বাড়ী-গাড়ী, এমনকি আমার ব্যাংক ব্যালেন্সও মোটামোটি চাঙ্গা ছিলো। বলতে পারো লাখপতি।
কিন্তু........
-কিন্তু কি? থামলেন কেন? আমার উদ্বেগ আরো দিগুন।
-কিন্তু, আমার সেই লাখ লাখ টাকা কোনো কাজে আসবেনা। সে টাকায় আমাকে পরকালে মুক্তি দিতে পারবেনা।
তাই যে টাকার মাঝে রয়েছে বরকত, যে টাকার মাঝে কোনো ভেজাল নেই, সেই টাকা উপার্জনের জন্য ছুটে এসেছি সুদূর যশোর থেকে সিলেটে। লোক চক্ষুর আড়ালে।
আত্মীয় স্বজনের আড়ালে।
আমি জানার আগ্রহ নিয়ে বললাম,
-সেই লাখ লাখ টাকা আপনাকে মুক্তি দিতে পারবেনা! কথাটার মর্ম সঠিক বুঝলামনা।
-ড্রাইভার মুখে মৃদু হাসি টেনে বললো, মাদরাসার ছাত্র বুঝতেই পারতেছো কোন সে টাকা মানুষকে মুক্তি দেবেনা।
বুজতে পেরে আমি প্রসঙ্গটা পাল্টে দিলাম।
কিন্তু..............!
কিন্তু, এই প্রসঙ্গের মাঝেই রয়েছে তার আসল রহস্য।
কেউ কি জানতে পারবে, এই লাখ পতির কেন আজ এই পরিবর্তন! কি ছলো সে? আর কিইবা ঘটেছিলো তার অতীত জীবনে!
আর কথা বলতে পারলামনা। শুনতে পারলামনা, জানতে পারলামনা বেচারা ড্রাইভার বেটার জীবন বৃন্তান্ত।
বড় বড় বৃষ্টির ফোটা পড়তে লাগলো শরীরের উপর। ড্রাইবার নামক রহস্যময় পুরুষটাকে আর জানা হলোনা। তবে তার বর্তমান ঠিকানাটা জানতে পেরেছি।
আমার বাসা থেকে উত্তর দিকের একটা কলোনীতে সে থাকে।
আবার দেখা হবে বলেই ড্রাইভার নামের অদ্ভুত লোকটা রিক্সা সমেত চলে গেল।
আমিও আর না দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে দ্রুত ছুটে চললাম বাসার দিকে ।
২৭-০৯-২০১০ ইংরেজী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।