আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি!
১
বোশেখের খরতাপে প্রকৃতি উত্তপ্ত। ভ্যাপসা গুমোট ভাবটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সারাদিন বিভিন্ন কাজে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দুপুর দুইটার দিকে বাসায় ফিরলাম। এসেই বাথরুমে শাওয়ারের নিচে মিনিট দশেক বসে থাকলাম। সারা শরীরে কিছুটা শীতলতা বয়ে গেল।
বের হয়ে নাকেমুখে কিছুটা খাবার গুজে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর টা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে কানে একটা শব্দ বাজতে লাগলো। ভাবলাম, এই অবেলায় কে আসলো আবার। আব্বু আম্মু অফিসে গেছে।
তারা তো এই সময়ে আসার কথা না। হতে পারে ললিতা আপু। কিন্তু ললিতা আপু আসলে তো আগে ফোন করে জানাবে। কোন অতিথি তো আসার কথা না। আবার কেউ কোন বিল নিতে এসেছে কিনা? ইত্যাকার ভাবনায় ছেদ পড়লে শব্দটাও বন্ধ হয়ে গেল।
যাক, শেষ পর্যন্ত উঠতে হলো না। কেউ এসে থাকলে ব্যর্থ মনোরথে চলে গেছে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।
আবারও ঠকঠক শব্দটা শুরু হলো। এবার আর থেমে থেমে নয়, একেবারে ছন্দময় শব্দে বাজতে লাগলো।
এই ক্লান্ত দুপুরে লো ভলিউমে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজলে ঘুমটা মন্দ হতো না। কিন্তু শুধুমাত্র ঠকঠক শব্দ কানে লোহাপেটা শব্দের ন্যায় লাগলো। একান্ত বাধ্য হয়ে বিছানা ছাড়তে হলো। মেইন দরজা খুলে এপাশ ওপাশ চাইলাম। কারো টিকিটি পর্যন্ত চোখে পড়লো না।
দরজা বন্ধ করার পর শব্দের উৎস সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া গেল। এতক্ষণ ঘুমঘোরে সঠিক উৎসটা অনুমান করতে না পেরে মেইন দরজাকেই মনে হয়েছিল।
লতিতা আপুর রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম। একটা চড়ুই পাখি তার ড্রেসিং টেবিলের উপর বসে আছে। আয়নার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তার প্রতিবিম্বটাকে দেখছে।
আর পিটপিট করে এপাশ ওপাশ চাইছে। তার প্রতিদ্বন্দী ভেবে মল্লযুদ্ধের পর বেশ শ্রান্ত বোধ হচ্ছে তাকে। এই অবুঝ পাখিটিকে বুঝানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়ার শক্তি ও সামর্থ্য এই মুহুর্তে অবশিষ্ট নেই। যতজোড়ে সম্ভব ডান হাতটা ঝাঁকুনি দিয়ে রাগ প্রকাশ করলাম। আমার রাগের মাহাত্ম্য সে কতটুকু বুঝলো জানিনা।
বেশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে বারান্দার গ্রিলে বসে পড়লো। অনাকাঙ্খিত এই আক্রমনের জন্য সেই উল্টো রেগে গেছে বোধয়। থাক বাবা অবুঝ পাখি আমি যাই ঘুমাতে। বিকেলে আবার টিউশনী আছে। এই যে ঘুমাতে গেলাম।
তুই তোর বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্ঠির সাথে যুদ্ধ কর।
আয়না আবিস্কার হওয়ার প্রথম দিকে মানুষের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটনাই নাকি ঘটেছে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ হয়নি। পৃথিবীর বোকা মানুষগুলো প্রথম আয়নার টুকরোটা খুঁজে পেলে, তাদের গোত্রে রীতিমত ঝড় বয়ে যায়। সেই ঝড়ে কেউ নিজের প্রতিচ্ছবিকে দাদা, কেউবা পরদাদা, কেউবা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলে ঠাওড়ানো শুরু করে।
ভুলোমনা লতিতা আপু প্রায়ই এই গল্পটা করতো। আপু, আয়না ছাড়া পানিতেও তো প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। পানি নিয়ে এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি? জিজ্ঞেস করলে, ধূর বোকা! আগে তো পানি ঘোলা ছিল। ঘোলা পানিতে কি আর চেহারা দেখা যায়? খাঁটি সমঝদারের হাসি তার চোখে মুখে। ঐ যে দেখিস নি গাধারা জল ঘোলা করে পানি খায়।
থাক বাবা হয়েছে। গল্পকে আর ডালপালা মেলতে না দিয়ে অন্য কাজে মনোনিবেশ করি। এই গল্পের কখনো সমাপ্তি হয়নি। হওয়ারও নয়। ললিতা আপুর থেকে অন্যদের মাঝে বিস্তার ঘটে গল্পের।
বিস্তার হতে হতে হয়ত একটু পরিমার্জিত হবে। যেভাবে পরিমার্জিত হতে হতে ললিতা আপুর কাছে পৌঁছেছে। বিয়ের পর ললিতা আপু তো এই ড্রেসিং টেবিলটাই শ্বশুরবাড়ি নিতে চেয়েছিল। পুরনো বলে বাবা তাকে একই মত দেখতে আর একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে দেয়ায় সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে।
২
আমরা স্কুলে পড়ার সময় আমাদের সংসারটা খুব বেশী টেনেটুনে চলতো।
বাসায় মোটে দুইটা বেডরুম ছিল। ডাইনিং ড্রইং মিলে ছোট্ট একটা জায়গা। এক রুমে আব্বু আম্মু। আর এক রুমে দুটো ছোটখাটে আমি আর আপু থাকতাম। এ রুমেই ড্রেসিং টেবিলটা এবং এর পাশে ছোট্ট পড়ার টেবিল নিয়ে আমাদের কতই না দৈনন্দিন গল্প রচিত হত! সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা ঘন্টাখানেক পড়াশুনা করতাম।
আপু বেণী দুলিয়ে, আমি হেরে গলায় অধ্যাবসায় চালাতাম। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ললিতা আপুর সাথে প্রায়শই লঙ্কাকান্ড বেঁধে যেত।
অনেক দিন আগের একটা ঘটনা। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ঘুম থেকে উঠে দেখি সে পড়ার টেবিলে পড়াশোনায় ব্যস্ত।
অন্যান্য দিন সে আগে উঠলেও তার সাজসজ্জাকালীন সময়ে আমি ত্বরিত বিছানা ছেড়ে উঠি। পাছে টেবিলটা না আবার বেদখল হয়ে যায়। কিন্তু আজকে কি এমন ঘটনা ঘটলো যে আমি কুম্ভকর্নের মত ঘুমিয়ে আছি। সেই ফাঁকে টেবিলটা দখল হয়ে গেল। এখন তো বিছানায় বসে পড়তে হবে।
বিছানায় পড়তে যাওয়া মানে রাজ্যের ঘুম চলে আসবে। অর্ধ সমাপ্ত পড়াশুনা নিয়ে স্কুলে গেলে স্যারের প্যাদানী খেতে হবে। বিছানা ছেড়ে উঠে আসল রহস্য উদঘাটন করলাম। আজকে সে বডি স্প্রে মাখেনি। আমার গন্ধ আকর্ষী নাসিকা তাই ঘুম ভাঙ্গাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আপুটা দেখতে যেমন সুন্দরী পড়াশুনায়ও যথেষ্ঠ পারদর্শী। সে প্রতিদিনের মত দু'বেনী দুলিয়ে পড়ছে। তার বেনী দুলানো দেখে চিড়িয়াখানার বানরের লেজের কথা মনে পড়লো। এখন তার অধ্যাবসায়ে কিভাবে বিঘ্ন ঘটানো যায় তার পথ খুঁজছি! টেবিলে পড়ে থাকা কলমটা নিয়ে তার বাংলা খাতার মধ্যে ঘ্যাচ করে একটা দাগ টেনে দিলাম। কোন কিছু বুঝে উঠার আগে ধপাধপ কয়েক মুষ্ঠি কিল পিঠের মধ্যে পড়লো।
এরপর সে চেয়ার টেবিল ছেড়ে আম্মুর রুমে ভোঁ দৌঁড়। আমিও নাছোড়বান্দা। পিছে পিছে ছুটলাম। আব্বু আম্মু প্রাতভ্রমণে বেড়িয়েছে। আম্মু আমার ঢাল স্বরূপ।
মায়েরা বোধয় ছোটদের পক্ষেই থাকে। এই মুহুর্তে নিজেকে অসহায় মনে হলো। তারপরও হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্ঠা অব্যাহত থাকলো। সে লুকিয়ে আছে আলমিরার পাশে। তার একটা বেণী খপ করে টেনে ধরলাম।
তুই আবার আমার চুল ধরেছিস, এই বলে সেও হিংস্র হয়ে উঠলো। বাঘে মহিষে যুদ্ধ বেঁধে গেল। যুদ্ধ এলোপাথাড়ি চলতে চলতে আম্মুর ঘাটের উপরে শুরু হলো। দু'পক্ষের বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ অপচয়ের পর বিধ্বস্ত। এখন পায়ের নিচে আম্মুর তসবীর পুঁথি গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এখন শান্তিচুক্তি ছাড়া উপায় নেই। আপু বললো শোন,'আম্মু ফিরে আসলে তসবীর ব্যাপারটা বলিস না যেন। যে করে হোক কাল সকালের মধ্যে আমি গেঁথে দিবো। ' যুদ্ধ যেহেতু করেছি দোষী হিসেবে শর্ত মেনে নিতে হলো। আপু তসবীর পুঁথি আর সুঁই সুতো নিয়ে স্কুলে গেল।
টিফিন পিরিয়ডে বসে সেটা গেঁথে বাসায় নিয়ে আসলো। নচেৎ এই ঘটনা আম্মুর কানে গেলে কোন প্রকার অনুকম্পা অবশিষ্ট না রেখে পিঠের মধ্যে কয়েক প্রস্থ বেত্রাঘাত পড়তো।
৩
ললিতা আপু আমার চেয়ে চার বছরের বড়। একাডেমীক্যালিও তাই। পিঠাপিঠি ভাই বোনদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা বোধয় অবধারিত।
তবে তার সাথে যে শুধু যুদ্ধ বাঁধতো তা নয়। শুধু যুদ্ধটুকু বাদে বাকীটা সময় আমরা হাসি আনন্দে মেতে থাকতাম। সে, সময় অসময়ে অনেক গল্প শোনাতো। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে টুকিটাকি আবদার মেটাতো। আবার ঝগড়া লাগতেও কোন কারণ লাগতো না।
আর একদিন সকাল বেলার ঘটনা। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে। ঐদিনও আপু টেবিলে আমি জানালার ধারে আমার খাটে বসে পড়ছি। মনোযোগ সহকারে পড়ার সময় পিঠের মধ্যে কিছু একটা টুপ করে পড়লো। পিছন ফিরে দেখি আপু একটা কাগজের দলা দিয়ে ঢিল ছুড়েছে।
দলাটা ছুড়ে ভাল মানুষের মত মাথা দুলিয়ে পড়ছে। আসলে সে পড়ছে না। কারণ হাসির দমকে তার শরীর কাঁপছে। আমিও টুপ করে ছুড়ে মারলাম দলাটা। তার পিঠে গিয়ে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর সেটা আবার আমার পিঠে। এভাবে দলা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকলো কিছুক্ষণ। শেষবার আমার পিঠে পড়েছে। এখন আমার পালা। কিন্তু কাগজটা আর ধারেকাছে পাওয়া গেল না।
হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট ছিল। ওটাই তুলে নিলাম। এই ভারী বস্তু দিয়ে ঢিল ছোড়া ঠিক হবে না। তাই তার আশেপাশে ঢিল ছুড়ে ভয় দেখানোর চেষ্ঠা করলাম। কিন্তু সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একদম ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় গিয়ে লাগলো।
অমনি সেটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। আম্মু বাসায় ছিল। ছুটে আসলো মুহুর্তে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম এতক্ষণ। আম্মুর হাতের কিল থাপ্পরে বাক ছুটে গেল।
বরাবরের মত আমি ছোট বলে কিছুটা কম জুটলো। এরপর এমন ছুট দিলাম বাসা থেকে। দুপুরের নাওয়া খাওয়া পর্যন্ত ভুলে ছিলাম। বিকেল বেলা কিছুটা পরিণত মনমানসিকতা নিয়ে ফিরে এসেছি যেন।
এই ঘটনার পর আস্তে ধীরে আমরা মারামারিতে সংযমী হয়ে উঠি।
পরবর্তীতে বড় ধরনের কোন সংঘাত বাঁধেনি। বিশেষ করে পরে যখন তিন বেড রুমের বাসা হয়ে গেল। ললিতা আপু আর আমার আলাদা রুম হয়ে গেল, পড়ার টেবিল হয়ে গেল।
৪
ভাতঘুমে বিকেল হয়ে গেছে। শরীরটা তেমন ভাল ঠেকছে না।
টিউশনীতে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। এই ব্যাপারটাতে আগে কিছুটা উৎসাহ ছিল। মাস শেষে অতিরিক্ত কাঁচা টাকার সংযোগ মনে আনন্দ এনে দিতো। আব্বুর দেয়া সীমিত বরাদ্ধ কাটিয়ে সুন্দর স্বচ্ছল গতিতে জীবন চলছিল। ইদানীং আর আগের মত কোন প্রকার উৎসাহ পাচ্ছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ বলে মনে ভারিক্কি ভাব এসে গেছে। সামান্য ক'টা টাকার জন্য অন্যের বাসায় গিয়ে দরজার কড়া নাড়া ভাল ঠেকছে না। কিন্তু উপায়ও তো নেই। বাবা মায়ের স্বল্প বেতনের চাকুরী। চারিদিকে সব বিষয় বস্তুর ক্রম মূল্যস্ফীতি।
এর সাথে পাল্লা দিতে টিউশনী না করে এই মুহুর্তে কোন উপায়ন্তর দেখছি না। অবশেষে যেতেই হলো।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে দেখলাম দুটো চড়ুই। হয়ত সেই আগের চড়ুইটার পরিবার। তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে হাজির।
নির্বোধের মত যুদ্ধ না করে খুটে খেতে গেলেও অনেক লাভ হতো। এই অবুঝ চড়ুইদের কে বোঝাবে এই কথা। পথে পাবলিক বাসে ঝুলে যাচ্ছি। যেতে যেতে মনে হচ্ছে, আমিও হয়ত এদের মত একটা যুদ্ধ করছি। এত পড়াশুনা করে কি হবে।
বড় ভাইদের অনেককেই তো দেখছি। পড়াশুনা শেষে স্বল্প বেতনের চাকুরী। অভাব অনটন লেগেই আছে তাদের সংসারে। অনেকেই এখনো ব্যাচেলর আছে। বিয়েই করতে পারছে না।
ধূর শালা! জীবনটাই একটা যুদ্ধক্ষেত্র! তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে এক তৃতীয় মহাযুদ্ধের সমিল।
৫
রাতে ফিরে খেতে বসেছি। আম্মু বললো, কালকে গ্রামের বাড়িতে যাতো। জিজ্ঞেস করলাম, কেন আম্মু হঠাৎ গ্রামের বাড়িতে?
জানিস না বুঝি, তোর ললিতা আপু সন্তানসম্ভবা। কাল পরশু বাচ্চা হবে।
সেতো জানি, কিন্তু সেটা এত কাছে! আর তুমি, হাসপাতালে না গিয়ে গ্রামে যেতে বলছো যে?
তোর দাদীর শরীর তো খুব ভাল যাচ্ছে না। বয়স অনেক হয়েছে। আল্লাহ বোধয় ললিতার বাচ্চার মুখ দেখানোর জন্য এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি তো এখানে আসতেই চান না। ললিতার বাচ্চা হওয়ার কথা শুনলে এবার নিশ্চয়ই আসবেন।
পরদিন সকালেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বাসে চার ঘন্টার পথ। যেতে যেতে মনে পড়লো, ললিতা আপুর এই বিয়েতে আমার অমত ছিল। বিশেষ করে এত সুন্দর আপুর সাথে দুলাভাইয়ের দাড়ি গোঁফের কারণে সম্পর্কটি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ছোট মানুষের মতামতের কিইবা গুরুত্ব থাকতে পারে! বিয়ে হয়ে গেল।
এজন্য অনেক দিন পর্যন্ত আপুর বাসায় যাওয়া হয়নি। পরবর্তীতে দেখা গেল, মানুষটা অনেক ভাল মনের অধিকারী। আপু দুলাভাইকে নিয়ে অনেক সুখী। এরকম সুখী পরিবার খুব কমই চোখে পড়ে। কিন্তু তাদের দু'জনের মাঝে একটা দুঃসহ বেদনা ছিল।
বিয়ের বেশ কয়েক বছর হয়ে যাওয়ার পরও তাদের সন্তান হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিধাতা তাদের উপর সদয় হয়েছেন।
আম্মুর ফোনে ভাবনায় ছেদ পড়লো। আম্মু মোবাইলে জানালো, তোর আপুর একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। দাদীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লাইন কেটে দিল।
একটু পর বিভিন্ন ভাবনায় মনের অজান্তে আমার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরা শুরু করলো।
৬
গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। পৌঁছে দেখি বাড়িতে বিশাল জটলা। সবাই আকাশ বাতাস ভারী করে কাঁদছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না।
একটা সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসলাম। অথচ এখনকার এই পরিস্থিতিতে সেটা প্রচার করা অমানবিক ব্যাপার মনে হচ্ছে। ছোট চাচ্চুর সাথে এই বাড়িতেই দাদী থাকেন। অন্যান্য চাচা-ফুফুরা বিভিন্ন জায়গায় সেটেলড। আমি আসার কথা শুনে ছোট চাচ্চু ছুটে আসলেন।
এসেই আমার গলা জড়িয়ে কান্না শুরু করে হড়বড় করে বলা শুরু করলেন,''সকালে তোর বাবা ফোন করে জানালো ললিতার বাচ্চা হয়েছে। এই খবর শোনার পর মা যেন আনন্দে আত্মহারা। তুই নিতে আসছিস শুনে তার আনন্দ আরও বেড়ে গিয়েছিল। কেমন তাড়াহুড়ো করে ঈদে পাওয়া নতুন শাড়ী বের করলো। কল পাড়ে গোসল করতে দৌঁড়ালো।
একটু পড়ে ধূপ করে একটা শব্দ হলো। তোর চাচী ছুটে গিয়ে দেখে মা কল পাড়ে পা পিছলে চিৎ হয়ে পড়ে গেছে। তার চিৎকারে আমিও ছুটে গেলাম। মার মুখ দিয়ে ফেনা ছুটছে। আঙ্গিনায় মাদুর পেতে শোয়াতে না শোয়াতেই শরীরটা নিশ্চল হয়ে গেল।
'' এ পর্যন্ত বলার পর তার কান্নার দমক আরও বেড়ে গেল। এরকম শোক সন্তপ্ত কোন মানুষকে সান্তনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। আমিও চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। এক সময় সবাই ধাতস্থ হয়ে লাশের সৎকার কাজে লেগে গেল। যে মানুষটি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত এই পৃথিবীর একটা অঙ্গ ছিল।
সে আজ ঝরে পড়লো। এখন দুর্গন্ধ থেকে রক্ষার জন্য বা অদৃশ্য মঙ্গল কামনার্থে মাটিচাপা দিতে হবে!
শেষ কথাঃ বাসে ফিরতে ফিরতে মনে হয়, জন্ম এবং মৃত্যু দুটো সময়েই মানুষ ছোট্ট অবুঝ শিশু হয়ে যায়। সে জন্মের সময় হাসতে হাসতে, সবাইকে হাসাতে হাসাতে বের হয় একটা বিস্ময়কর গহবর থেকে। মৃত্যুর সময় হাসতে হাসতে, সবাইকে কাঁদাতে কাঁদাতে সেই নিকষ কালো গহবরে প্রবেশ করে।
কিংবা
একটা জন্ম হচ্ছে একটা বৃন্ত থেকে ফুল ফোটা।
জীবন ভর সৌরভ ছড়ানো। একটা সময় মৃত্যু রুপে ঝরে যাওয়া। পৃথিবীর সব ফুল সবাই দেখে না। এজন্য বোধ করি সবার মনে অতৃপ্তিবোধ রয়েই যায়।
আজকে ফোন করে ললিতা আপু তার সদ্য আগত ফুলের সুন্দর একটা নাম দিতে বলেছে।
মনে মনে একটা নাম অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি। সেটাই আওড়াচ্ছি এখন। আর ফুলটা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কখন পৌঁছাবো গন্তব্যে...
ছবিঃ নিজস্ব এ্যালবাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।