নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
মাত্র ১০ মাইল দুরে স্টেশন। এই সময়ে দুইটা আন্ত:নগর ট্রেন চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু একটাও আসেনি। লোকটা হলুদ দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে,
-ঐ বেত্তমিজ বেলেহাজ রেলের মাস্টরেরা, আইজকা কি তোগোরেও মালেকুল মৌত ধরছে?
তেলহীন শুকনা চাঁদিটা ঠান্ডা লাইনে শুয়েও ঘেমে যায়। কানে কড় কড় শব্দ ভেসে আসে।
আশা পায়, ট্রেন কি তবে আসছে? কত দুরে? ডাসা পিঁপড়া পায়ে কামড়াচ্ছে। ট্রেনলাইনে আবার মাকড়সার জাল হয়? কচি লতাপাতা চ্যাপ্টে পাকা ঘায়ের মতো গোড়ালীতে চটচট করছে। কড়া সুর্য যেন ইচ্ছা করেই চোখে আলো দিয়ে তাকে জ্বালাচ্ছে। মেজাজটা আর ঠিক না রাখতে পেরে সে ওয়াক করে থুতু ছুড়ে দিল সুর্যের দিকে।
-ঐ হারামীর পুত, শান্তিতে কি হুততেও দিবি না? যেন সুর্যটা শুনতে পায়, তারপর গলাটা উচ্চগ্রামে উঠিয়ে বলে
-ঐ হারামজাদা মেঘ, বালডার চোউক্ষে ঠুয়া পরাইতে তোর শরম কিয়ের? আমার মরনের পরে তো ঠিকই রইদেরে চশমা পরায়া রাখবি, অহন একটু শান্তি দিলে তোরে কি পাগলা কুত্তায় কামড়ায়?
দুনিয়াটা কোন মতে পার হলে হাশরে সুর্য পিপড়া মেঘ সবগুলাকে লটকানোর জন্য পরওয়ার দেগার কে বলবে।
কিন্তু পরওয়ার দিগারের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ আছে, সেটা কাকে বলবে? রোদ বাড়ছে। ট্রেনের দেরীতে তাকে খুঁজে পঙ্গপালের মতো সব দৌড়ে এসেছে। শুয়ে থেকে অভিজাত গলা খঁাকারির আওয়াজ শুনতে পায়।
মহিষের কোট পরা মুক্তঋণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার নামছে গাড়ি থেকে। পেটে গামছা গামছা চর্বি।
নাম হাদীউল্লাহ। তার এসিস্টেন্ট চোরের নিশান পেয়েছে এমন ভাবে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আর বলে,
-স্যার, ঐ যে ব্যাটা শুয়া আছে লাইনে। ধুরন্ধর। পয়সা দেওনের নাম নাই।
-এর বাড়ি গরু ক্রোক করনের কি হইলো?
-গেরামে খোঁজ নিছি।
এর গরু নাই, জমি যা আছিল, সব বেইচ্যা খাইছে। এ ৩০০০ টেকা নিছিলো, অখন সুদাসলে (ক্যালকুলেটর চাপে) ১৯,৩৯২.৯৩ পয়সা হইছে। এরে গলায় পার দিয়া পয়সা আদায় করন লাগবো। ম্যানেজার হাদী সাহেব মাথা নাড়ে,
-ঠিক বলছেন এইভাবে ঋণ খেলাপী বাড়লে আমাদের চাকরি থাকবে না, কোন ভাবেই ব্যাংকের গলায় লাল বাতি জ্বলতে দেওয়া যাবে না।
মেম্বরের ইলেকশনের লাল মোটরসাইকেলের শব্দ শোনা যায় - ভোঁ।
মিছিলের মাথাটা চলে যাওয়ার সময় রতন নামের চামচা আগায়ে কাছে আসে।
-ঐ পাগলা। ভোটের কইলাম চাইরদিন বাকি। ভোটটা লাগবো কৈলাম। উঠ, উঠ, মিছিলে চল।
চায়ের দোকানে কুড়ি টাকা বাকিতে খেয়েছে বলে ঘুরছে দোকানদার মজন্তালী।
হেড মাস্টার সাহেব ডাকে, ঐ মিয়া তোমার পুলারে ইস্কুলে দিবা না?
বাজারের সারের পাইকার সারের বাকি দামের জন্য লোক পাঠিয়েছে। চারদিকে ঘুর ঘুর করছে।
ঠিক এমন সময় সাড়ে চার বছরের ছেলেটা চিৎকার করে মাকে ডাকছে, আম্মাজা--ন। আম্মাজান, আব্বারে পাইছি...তুমি এই দিকে আসো।
কুলসুম অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়
-কী জয়নবের বাপ, এগুলান কি? কাইলকা ডেঙ্গা সিদ্ধ কইরা চালাইছি। শইলতো মানে না। দুধের মাইয়া কুলে, বুনি চিপ্যা দুধ নাই, খাওন না যুগাড় হইলে রোজ কেয়ামত নামতাছে। কেমন মর্দ আপনে, আমগো ফালাইয়া এইখানে হুইত্যা আছেন ক্যা? উঠেন! বাইত চলেন।
সাড়ে চার বছরের ছেলেটা ছিড়া হাফপ্যান্ট পরে বাপের দিকে ঘুরতে ঘুরতে আসে।
মাথা ঘষতে চায় বাপের উরুর সাথে।
একজন ভীড় থেকে বলে ওঠে, সালাম, পীর সা'বের খাদেম সালাম দিছেন। মাজারের দালানের চান্দা তুলার জন্য উনার শরীক লাগবো। লম্বা লেবাসটা পান খাওয়া মুখে পায়ের কাছে থুক করে পিক ফেলে আর বলে
-ভাইজান, আছ ছালামু আলাইকুম। দুনিয়ার চকমকি দুইদিনের।
আইজ আছে কাইল নাই। আখিরাতের জইন্যে তো কিছু জমানি লাগবো, কী কন? যদি না হয়, অন্তত গতরে খাইটা হইলেও চলেন ঘরটা দাড় করাই।
সে এখন কাঠালের হলুদ ভুতিয়া। চারদিকে শত শত মানুষ ভন ভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাকে খেয়ে শেষ করার আগে ওরা ডানা ঝাপটানো থামাবে না।
একমাত্র আশা রেলের লোহায় ঘো ঘো শব্দটা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে কাছে আসতে আসতে রেলের চাকা লাল ইঁটের উপর পাকা কফের মতো তাকে ল্যাপ্টে দিক। তাহলেই সব সুখ।
প্রতীক্ষার জন্য কিছু শক্তি লাগে। সেটা সে ধরে রাখতে চায়।
চারদিকে ছায়া ছায়া পাওনাদার কাঁটা দিয়ে তাকে খোঁচায়, খেজুর গাছের চুড়ায় উঠে বসে থাকলে যেমন তীক্ষ্ণ শলাকার বিষাক্ত করে, তেমনই। বেপারী বাড়ির একটা ছেলে ধপধপে লুঙ্গী কাছা দিয়ে সামনে আসে। সেও কিছু চায়।
মেলার চরকির মতো তার চারদিকে ঘুরতে থাকে বড় বড় মুখ। সে কাঠের স্লিপারে ভর দিয়ে সিনা টান টান করে হুঙ্কার ছাড়ে,
-ঐ শুয়রের বাচ্চারা, আমারে একটু একলা থাকতে দে।
তোগো চোখ কই? দেখস না ধান নাই, পানি নাই, ভাত নাই, লবন নাই, সানকি নাই, দুধ নাই, ঘুম নাই, শান্তি নাই। দিমু না তোগোর বাকির পয়সা। কী করবি আমারে? মারবি? মার! মারছ না ক্যা? তোগো একজন আমারে গলা টিপা মারলেই তো সবের ঋণ শোধ হয়। ঐ নডীর পুত, গেলি, তোর বালের ভোট দিয়া মেম্বরের শইল তাজা বানা। ঐ পীরের লেঙ্গুর, অভাইব্যা দিনে, আমরা খাইনা, তোর পেডের লুন্ধি(চর্বি) বাড়ে ক্যা? ধান অওনের কুদরতি জানস না তো কীয়ের পীর? মুতি তোর মাজারে।
মাস্টার সাব, আমারে মাফ করেন..বলে তার ছেলের দিকে চায়। (জয়নবের মায়ের দিকে মুখ ঘুরায়া বিরক্ত বলতে চায়, বলতে পারে না)
মুক্তঋণ ব্যাঙ্কের হাদীউল্লাহর এসিস্টেন্ট ভয়ে লাফ দেয়। স্যার, এর শুনছি পাগলার ব্যারাম । মাইনষেরে কামড়ানি দেয়। ইলেকশনের চামচাগুলা মটর সাইকেল ঘুরায় - এর মাথায় তো রাইজ্যের ছিট।
ল, ল যাই গা।
পীরের মুরিদের দাঁতের লালচে পান দাঁতেই থাকে। ছাতাটা বগলে করে ইয়া নফসি ইয়া নফসি বলে ছুটতে থাকে।
জয়নবের মা সামনে আগায়ে আসে। তার গলাটা প্লাস্টিকের পাইপের মতো শুকনা ।
মাথা ঘুরছে। সুর্যের মরা তাপে ঘামের বদলে শীত শীত লাগে জয়নবের বাপের। একটা পিপড়া কানের লতির পাশ দিয়ে বাদামী শরীরে নেমে যায় ।
ট্রেনের শব্দটা ঘন হয়, মনে হয় কাছে আসছে। এতক্ষণে তার চোখে ঘুম ঘুম লাগে।
মরা বুবুজানের ঘুমটাও এমন ছিল। বিয়ার দিনের পর একদিনই জ্যান্ত দেখছিল। বাচ্চা পেটে তার শাশুড়ী ধান টানাইতো। দেড় মনের ধানের সিদ্ধ ডেকচি তুলে ঘরে নেওয়ার সময় ঝড়ে দেবদারু গাছ উপড়ানোর মতো পড়ে যায়। রক্তে একাকার হয়ে মরাবাচ্চা প্রসব করার পর তাকে ঘুম পাড়ায়ে রাখা হয়।
আর উঠে নাই।
এতক্ষণে ভীড় কমেছে। ট্রেনের লোহার লাইনটা বালিশ বালিশ মনে হচ্ছে। গরম গরম রুটি বেলার মতো গলাকে কেন্দ্র করে মাথাকে নাড়ায়। সময় নষ্ট করে।
। ট্রেনের আসার সময় হয় না তবুও। ট্রেনও কি মেম্বরের কাছে পয়সা খেয়ে অন্যপথে ঘুরপথে গেছে? কয়টা বাজে? তার কবজিতে তো ঘড়ি নাই। ঘড়ি দেখতেও জানে না। সুর্যই তার ঘড়ি।
সুর্যটা মেঘে ঢেকে গেছে।
এমন সময় লাল চমচমের মতো রেলের ইঞ্জিনটা সুতানলী সাপের লেজ নেড়ে আসতে থাকে। সামনে দুধের ডিব্বার মুখ। দাঁতের মাজনের গুড়ার মতো মানুষ। বিকট জোরে কু শব্দ হয়।
চাকাগুলা যেন রেবপুলিশের বুট জুতা। ফিনকি দেয়া রক্তের মতো দৌড়ে আসতে থাকে।
তার থেকে তিন খাটিয়া দুরত্বে সাড়ে তিন বছরের জয়নব দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোটে রাজ্যের বিস্ময়। কাছে আসে না।
ঠোটের কোনায় ছেঁড়া। বলে, আব্বা, আমারে রাইখা তুমি ধীতপুরের মেলায় যাইবা না। আর এইবার কইলাম বাঁশিটা কিনুম। কিসমিস-শুকনা মেয়েশিশুটাও অস্ফুট শব্দ করে তার হাতে নাড়ে। জয়নবের মা ডাকে, আপনে এগুলান কী করেন? উইঠা আসেন কইতাছি।
ট্রেনের ইঞ্জিনের মাস্টারটা দুরে আবছা মতো কিছু দেখে অভ্যাসমত হর্ণ বাজায়। প্যাসেঞ্জারদের কয়েকজন নির্লিপ্তভাবে দেখতে থাকে গামছা বাঁধা সেই নিত্যদিনের পাগলটা আজ আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই - আর রেলের পাশের থানকুনি পাতাগুলো কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
হাদীউল্লাহ ব্যাঙ্কের নতুন একতলা ঘরে টেবিলের বেড়ে রাখা খানার জন্য হাত ধুয়েছে। মেলামাইনের প্লেট। সে পাগলাটার প্লেটে চাক্কা খাসীর গোশত তুলে দিয়ে শান্তি পায়।
পাগলাটার নতুন জামার বোতাম ঝিলিক দিচ্ছে। হাদী বলে, আরে সবাই মিলে না খেলে কী করে হবে? আরে খাও খাও। মেম্বরের বাড়ির দুপুরের আয়োজন পুকুরের তেলওয়ালা কাতল আর কচি কবুতর। পাগলার দিকে ডেকে বলে, কী জয়নবের বাপ,তোমার পেটে কী জায়গা নাই? আরেকটু পোলাও নেও, বেগুন ভাজি নেও। এত শরম কীয়ের, তোমরাইতো আমার ইজ্জত।
খাও খাও। আর পীরের খাদেম দস্তর খানায় বসে সুরুয়ায় ভেসে থাকা মুরগীর রানটা জোর করে তার পাতে তুলে দেয়া আর বলে, আরে নেন, বিসমিল্লাহ বলে রানটা চাবান। মানুষের পেটে খানা না থাকলে আল্লাহ নারাজ হয়। আর শুনেন মাইনশের পেটের আরেক নাম জিন্দা পীর!
নতুন জামা কালো রবারের নাগরা পরে জয়নবের বাবা বের হয়। পকেটে আনাম পাঁচশ টাকার নোট।
লুঙ্গীটা মাড় দেয়া, কড় কড় করে। তার টেট্রনের জামাটার বানিয়েছে যে খলিফা সে হাত নাড়ে, ঠিক মতো লাগছে তো? দোকানের ঝাপিতে সারি সারি মানুষ। সবাই দারুণ ফুর্তিতে। গল্প করতে বসলে তাদের হুশ থাকে না। পাগলার সময় নাই।
থাকলে এই চায়ের দোকানে বসে সিনেমার ছবি দেখতো। জয়নবের মা বসে আছে বাড়িতে। হাতে ছেলের জন্য বাঁশী, মেয়েটর জন্য লাল জামা। আর সেই চায়ের দোকানে অন্যদিকে বসে আছে এত আনাড়ী লেখক। সে শিক্ষিত তরুণদের একটা বানানো গল্প বলছে।
গল্পের শেষ অংশটা ভুল করে আসা, নাকি শুধু শেষটাই আসল গল্প, তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি।
-----------
ড্রাফট ১.৫ / নানাবিধ অনুপ্রেরণায় হাসান মাহবুব এবং সবাক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।