আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসুন কৃষকদের বাঁচাই



চারদিকে চোখ বুলালে বোঝা যায়, এবার বুঝি কৃষকদের রক্ষে নেই। বিশাল আয়োজনযজ্ঞ চলছে তাদের ধ্বংসের চূড়ান্তসীমায় পৌঁছানোর। কৃষক বলতে আমরা কৃষি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনকে বুঝবো। যারা কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের তো বাঁচিয়ে রাখছে হাড় জিরজিরে কৃষক সমাজ। গুঁড়া মসলা আমাদের রান্নার নিত্যদিনের সঙ্গী।

আবহমানকাল থেকে আমাদের পূর্ব বংশধররা পাথর, পাটা-শিল বা মেশিনে ভেঙে খাবারে স্বাদবর্ধক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করে আসছে। কিছুদিন ধরে আমি বিভিন্ন টেলিভিশনে কিছু গুঁড়া মসলার বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হয়ে গেছি। অনেকটা চোরের মায়ের বড় গলার মতো। তারা বোঝাতে চাচ্ছে বিশাল মসলা শিল্পে তাদের প্রোডাক্টই ভালো। অন্যদিকে যারা এতোদিন ধরে পাটায় বেটে বা মেশিনে ভেঙে মসলা ব্যবহার করছে, তাদেরটা খারাপ।

তাদের মসলা আসলেই ভালো, নাকি শুধুই গলা ফাটিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা, তা জানার জন্য আমি গিয়েছিলাম একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি আমাকে যা বললেন তার সারমর্ম হলো, বাজারের প্যাকেটজাত মসলার বেশিরভাগই আটা বা ময়দামিশ্রিত। আটা বা ময়দার মিশ্রণের মূল কারণ নাকি রাঁধুনিদের আকৃষ্ট করা। বাড়িতে যেসব মহিলা রান্নাবান্না করেন, তারা চান তাদের রান্না করা তরকারির ঝোলটা যেন আঠালো হয়। অন্যদিকে ব্যবসায়িক মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তরকারি আঠালো করতে মসলায় ব্যবহার করছে আটা বা ময়দা।

শতভাগ খাঁটির কথা বলে এভাবে আটা বা ময়দার ব্যবহার প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। তারা নিজেরাই একটি প্রতারণার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র মসলা শিল্পের উদ্যোক্তা ও চাষীদের ব্যবসার বারোটা বাজাচ্ছে। এতে করে আমাদের সবার চোখের সামনে মার খেয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র মসলা চাষী ও ব্যবসায়ী শ্রেণী। আরেকটি নারিকেল তেলের বিজ্ঞাপনও কৃষকদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। ওই বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে, আমাদের গ্রামগঞ্জে যে পদ্ধতিতে দীর্ঘকাল ধরে নারিকেল তেল তৈরি হয়ে আসছে তা অস্বাস্থ্যকর।

আপনি একবার ভাবুন নারিকেল চাষী ও তাদের নারিকেল দ্বারা গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা। আমরা সবাই জানি, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত দেশীয় উদ্যোক্তাদের দ্বারা তৈরি। ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিলে প্রত্যক্ষ আঘাত আসবে কৃষকদের ওপর। অন্যদিকে কৃষিঋণ সহজলভ্য না হওয়ায় কৃষকরা আশ্রয় নিচ্ছে ফড়িয়া, মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীর কাছে। উচ্চ সুদের কারণে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে, যার ফলে তারা ফসলের সঙ্গে সঙ্গে শেষ সম্বল টুকরো জমি ও বসতবাড়িও হারাচ্ছে।

অন্যদিকে নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র কৃষকদের ধানি জমি হারিয়ে যাচ্ছে সুদ কারবারি ও নগরায়নের ঝাপটায়। অন্যদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাইনাশকের যথেচ্ছার ব্যবহারে একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। এসব রাসায়নিক পদার্থের অপকারিতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে এমনও দেখা গেছে, সবজি ক্ষেতে প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সবজি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। বেগুনের কা- ও ফল আক্রমণকারী পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কৃষক ২০ থেকে ২৫ বার কীটনাশক ব্যবহার করছে।

সার, কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবসায়ীরা শুধু নিজেদের স্বার্থ মুনাফাই দেখছে। জমির উপকারী অনুজীবের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক যে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, এ ব্যাপারটি দেখার কেউ নেই। ভালো বীজে ভালো ফসল। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি মাত্র আট ভাগ বীজ কৃষকদের সরবরাহ করছে। অবশিষ্ট বীজের জন্য কৃষকরা নির্ভরশীল।

বীজ সেক্টরে বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন সুখকর নয়। কৃষকরা উচ্চফলনের আশায় চড়া দামে বীজ কিনছে। এতে করে একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকের জমিতে দেখা দিচ্ছে ভিনদেশি পোকামাকড় ও রোগবালাই। বিদেশি বীজ কিনে প্রতারিত হলেও কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কেউ নেই। নিম্নমানের বীজে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীজ ব্যবসায়ী শ্রেণী কৃষককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবেÑ কৃষিমন্ত্রীর এমন হুশিয়ারিও কাজে আসছে না।

যশোরের যে কৃষক জমিতে উৎপন্ন বেগুন চার টাকা কেজিতে বিক্রি করেন, সেই বেগুন ঢাকা শহরে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। একজন কৃষক যখন এ ব্যাপারটি নিজ চোখে অবলোকন করেন, তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয় তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেন কৃষকের একটি স্বপ্ন। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সব দেশই কৃষিতে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। আমেরিকা, জাপান, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ মোট বাজেটের ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ।

আমাদের দেশে কৃষিতে ভর্তুকি মোট বাজেটের ৩.৬ শতাংশ মাত্র। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এ ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধির বিপরীতে হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কৃষিতে পড়তে শুরু করেছে।

পানির অভাবে উত্তরাঞ্চল শুকিয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চল নাকাল লবণাক্ততার আক্রমণে। তাছাড়া বন্যা, ঘূর্ণিঝড় যেন নিয়তির পরিহাস। কৃষিঋণ পেতে নানা হয়রানির কথা পত্রপত্রিকায় দেখি। কঠিন শর্ত ও উচ্চ সুদের হার কৃষকদের দিশাহীন করে ফেলে। চতুর্মুখী সমস্যায় রয়েছে কৃষকরা।

তারপরও খরা, বন্যা, লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে ফলিয়ে যাচ্ছে ফসল। বাঁচিয়ে রাখছে দেশকে। এ দেশের কৃষকরা সারা বছর মেতে থাকতে চায় নবান্ন, পিঠা-পুলি, জারি-সারি-মুর্শিদি ইত্যাদি উৎসবে। সে সঙ্গে কৃষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসছে কৃষিঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। শেষ করার আগে একটি সুসংবাদ দিয়ে শেষ করি।

সরকার ১ কোটি ৮৬ লাখ কৃষককে আইডি কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে। এতে করে আইডি কার্ডপ্রাপ্ত কৃষকদের সঙ্গে সরকারের যোগসূত্র স্থাপিত হবে। ম্লান মুখের কৃষক আমরা আর দেখতে চাই না। নতুন বছরটি হোক কৃষকের অধিকার আদায়ের বছর। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার বছর।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.