কৃষকের কথা বলিতে গেলে বুকে লাগে ব্যাথা
লোকসান থেকে কৃষকদের বাঁচাতে হবে
শাহাদাৎ হোসেন
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও দিন দিন এই অবদানের হার হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু এই হার কমার কারণ কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া নয় বরং অন্যান্য খাত যেমন শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবদান বেড়ে যাওয়া। এ কথা সত্য যে মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির অবদানের পরিমাণ না কমলেও কৃষিতে রয়েছে ব্যাপক সমস্যা। অতি সম্প্রতি শেষ হলো ২০০৯ সালের বোরো মৌসুম। দেশে এ বছর প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে প্রতি কেজি ধানে কৃষকের খরচ পড়েছে ১৩ টাকা ৭৩ পয়সা। সরকার ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ১৪ টাকা। এতে কৃষকের কেজিপ্রতি ২৭ পয়সা লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু ক্রয়মূল্য ১৪ টাকা নির্ধারণ করলেও সরকারের ক্রয়ের পরিমাণ খুবই সীমিত এবং অধিকাংশ কৃষকের পক্ষেই সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে ধান বিক্রয় করা সম্ভব হয় না। ফলে কৃষকেরা ধান বিক্রি করার জন্য বাজারে যেতে বাধ্য হয়।
বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী কৃষকের ধানের বিক্রয়মূল্য মণপ্রতি ৪০০ টাকা বা কেজিপ্রতি ১০ টাকা ৭০ পয়সার বেশি নয়। সেই হিসাবে ধান চাষে কৃষকের কেজিপ্রতি লোকসান হচ্ছে তিন টাকা তিন পয়সা এবং সারা দেশের কৃষকদের লোকসান হচ্ছে পাঁচ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।
মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির যে অবদান তার মধ্যে বোরোর অবদান ৩১ শতাংশ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলে কৃষকের এই ক্ষতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কৃষককে এই লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্লেষকেরা সরকারের ধান সংগ্রহের মূল্য এবং পরিমাণ উভয়ই বাড়ানো উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু ধান সংগ্রহের মূল্য বাড়ালে তার সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মুনাফা ও মূলধনের সুদ যুক্ত হয়ে চালের মূল্য এমনভাবে বেড়ে যেতে পারে যা নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য অধিক চাপ সৃষ্টি করবে। প্রকৃত পক্ষে কৃষককে লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যেটি প্রয়োজন তা হলো শস্যের উৎপাদন খরচ হ্রাস করা। এটি দুভাবে করা যেতে পারে। একটি হলো উপকরণের মূল্য হ্রাস করে এবং অপরটি হলো শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
প্রথমেই আসা যাক বীজের প্রসঙ্গে।
উন্নত ও মানসম্মত বীজ অধিক উৎপাদনে সক্ষম। বাংলাদেশে বর্তমানে যে বীজ ব্যবহার করা হয় তাতে প্রতি হেক্টরে ৩.১০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। পক্ষান্তরে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এর পরিমাণ যথাক্রমে ৯.৫০, ৬.৬৭ ও ৬.৯৩ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের জমি অধিক উর্বর হওয়া সত্ত্বেও এই পার্থক্যের মূল কারণ মানসম্মত বীজের অভাব। সুতরাং উন্নত বীজ ব্যবহার করে প্রতি হেক্টরে জাপানের মতো ৬.৬৭ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব না হলেও অন্ততপক্ষে হেক্টরপ্রতি পাঁচ মেট্রিক টন হলেও সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে প্রায় ১১ হাজার ৩২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে সারের ঘাটতি, মৌসুমে সারের মূল্য বৃদ্ধি, সার সংগ্রহের জটিলতা কারও অজানা নয়। সার সংগ্রহ করতে কৃষককে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু সারের এই ঘাটতি বা মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সারের সংকট যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী সরকারের অব্যবস্থাপনা বা যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব। এক তথ্যে দেখা যায়, গত মৌসুমে টিএসপি এবং এসএসপি সারের বেশ অভাব এবং ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি পেলেও চিটাগাং টিএসপি কমপ্লেক্সে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের ৩০ হাজার টন টিএসপি সার খোলা আকাশের নিচে ছিল এবং কিছুটা নষ্ট হয়েছে।
পক্ষান্তরে এক জরিপে দেখা যায়, জমিতে প্রয়োজনমাফিক সার ব্যবহার করতে না পারার কারণে দেশে প্রায় ১০ শতাংশ বোরো কম উৎপাদিত হয়েছে।
আবার মৌসুমে সারের মূল্য বৃদ্ধি এবং সারের বিপরীতে সরকারের প্রদত্ত ভর্তুকি সঠিকভাবে কৃষকের হাতে না পৌঁছানোর দরুন কৃষকের ধান উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। সুতরাং সার বণ্টনে সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ মনিটরিং এবং ভর্তুকির টাকার সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা গেলে কৃষকের আয় বাড়ানো এবং উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব। মধ্যস্বত্বভোগী এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাংলাদেশে কৃষি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এক জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষক কৃষি পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যই প্রধান কারণ। দেশে সর্বত্রই কৃষক মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি।
এক হিসাবে দেখা যায়, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে এক মৌসুমে কৃষক তার ধানের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকা।
বোরো চাষে সেচের জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেলের। সরকার ডিজেলের মূল্যের বিপরীতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে ডিজেলের ভর্তুকির ২৫০ কোটি টাকার ৫০ কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। অনেক এলাকাতেই ভর্তুকির টাকা ডিজেল ব্যবহারকারী কৃষকেরা পায়নি।
কৃষির ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা, সেচ সংকট, বাঁধের অভাব ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক জমি জলাবদ্ধতার কারণে বছরের পর বছর চাষের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক স্থানে সেচ সুবিধার অভাবে বিল এবং হাওরাঞ্চলের জমিতে ধান চাষ করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় বাঁধের অভাবেও অনেক স্থানে জমি চাষ না করে ফেলে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, জলাবদ্ধতা, সেচ সংকট এবং প্রয়োজনীয় বাঁধের অভাবে প্রায় চার লাখের বেশি একর জমিতে ধান চাষ করা হচ্ছে না।
কৃষি ক্ষেত্রে চাষাবাদের জন্য কৃষকের প্রয়োজন মূলধনের। দেশের অধিকাংশ কৃষকই কৃষিকাজে তাদের নিজস্ব মূলধন ব্যবহার করে থাকে। আবার অনেকে নিজের মূলধন না থাকায় ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকে। কৃষি ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকও কৃষি ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে এমন সব নিয়ম-কানুন পালন করতে হয়, যা কৃষকের পক্ষে পালন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ফলে ঋণের জন্য কৃষক অধিকাংশ ক্ষেত্রে এনজিও বা মহাজনী ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এনজিও বা মহাজনী ঋণের বড় সমস্যা হলো অত্যধিক সুদের হার। সুতরাং দেশের কৃষি ঋণের শর্তগুলো আরও সহজ করে ব্যাংকগুলো যদি সরাসরি কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত কৃষি ঋণ সরবরাহ করতে পারে, তাহলে দেশের কৃষকদের পক্ষে অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব হতো।
কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হলে কৃষকেরা লোকসানের বদলে লাভবান হতে পারবে। তাই কৃষি পণ্যের সরকারি ক্রয়মূল্য বৃদ্ধির চেয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে ওপরে উল্লিখিত সমস্যগুলো সমাধান করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মো. শাহাদাৎ হোসেন: ভাইস প্রেসিডেন্ট, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।