শাশ্বত স্বপন এর গল্পগুচ্ছ ‘ভাদ্র ভাসান’ একটি অনন্য প্রকাশনা
---ড. সফিউদ্দিন আহমদ
মানব জীবন অতীব বাস্তবতার আকরে সম্পৃক্ত। জীবনের এই বাস্তবতায় মানুষের আছে দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, প্রেম-ভালোবাসা ও দৈহিক কামনা-বাসনা। এবং এ সবের সাথে আরো বাস্তবতায় সম্পৃক্ত দেশ, কাল, সমাজ-সংস্কৃতি ও যুগ মানসের উত্তাপ। যে সমস্ত লেখক এ সমস্ত বাস্তব অভিধাগুলোকে এড়িয়ে কলাকৈবল্যবাদের প্রশস্তি রচনা করে এবং ‘কেবলই স্বপন করিছে বপন পবনে’--এমন মানসিকতার অলীক কাহিনী তথা এক ধরনের বাণিজ্যিক সাহিত্য রচনার মাধ্যমে আমাদের কিশোর-যুব সমাজকে জীবনবিমুখ ও শিকড় বিচ্যুত করে, বিশেষ করে মাটি, মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের আবহ হতে বেলুনের মতো আকাশে উড়িয়ে দেয় আমি তাদের দেশবিমুখ ও জীবন বিমুখ সাহিত্যিক অভিধায় অভিহিত করি।
এই মাত্র আমার হাতে এসেছে শাশ্বত স্বপনের ভাদ্র ভাসান গল্প গ্রন্থটি।
মোট এগারটি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থের কলেবর। গল্পগুলো হল--আলোকিত অন্ধকারের জনপথ, বেদনাময় সময়ের ভীড়ে, সময়ের লাশ, স্বপ্নের আঙ্গিনায়, ঝরা পাতার গান, সিঁদুর রাঙা স্মৃতি, অনামিকা, সমর্পন, শরতের সরোদ, শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া ও আমাদের রিপন।
উপর্যুক্ত গল্পগুলোর লেখক শাশ্বত স্বপন দেশ, মাটি ও মানুষ এবং জনজীবনের একাত্নতায় সম্পৃক্ত একজন জীবনবাদী ও জীবন শিল্পী। অধিকাংশ গল্পগুলো উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীকতায় রচিত, ফলে আবেগ জড়ানো কথকতা ও বক্তব্যগুলো বেশ শক্তিশালী হয়েছে এবং তার গল্পগুলোতে স্বতস্ফূর্তভাবে এসেছে সমাজের আকাড়া বাস্তবতা, শ্রমে ঘামে সিক্ত নিরন্ন ক্লিষ্ট মানুষের নিরন্তর হাহাকার। গল্পগুলো যখন পড়ি তখনই মনে হয়, শাশ্বত স্বপন কোন গল্প কাহিনী নয়--ধীর স্থির ও স্থিতধী প্রজ্ঞায় মানসিক ও শৈল্পিক উৎকর্ষে আমাদের দেখা সমাজ ও মানুষকেই আলোকিত ঐশ্বর্যের ফ্রেমে বেঁধেছেন।
লেখক গল্প গ্রন্থের নামকরণে নিজেই জবানবন্ধি দিয়েছেন, ‘‘গ্রাম বাংলায় প্রচলিত মিথ আছে যে, ভাদ্র মাসে বিয়ে করতে নেই, ভাদ্র বেলায় দূরে যাত্রা করতে নেই। এ মাসকে অপয়া, অশুভ হিসাবে ধরা হয়। এখানে ভাদ্র শব্দে অশুভ-অপয়া-দুঃখ-কষ্ট-জ্বালা-যন্ত্রণার ছায়াপাত করা হয়েছে। অমানবিকতা, হিংসা, অপ্রাপ্তি--নানাবিধ কষ্টের বিষয়গুলো এই ভাদ্র শব্দের ভেলায়, ভেলা ভাসানোর মত এবারের বই মেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হল। আর তাই নামকরণ করা হল ‘ভাদ্র ভাসান’।
’’
আগেই বলেছি, শাশ্বত স্বপনের গল্পগুলো এসেছে জীবনের ও সমাজের গভীর বাস্তবতা থেকে। বিশেষ করে কাহিনী ও চরিত্রগুলোর মূল আকর আমাদের চিরায়ত গ্রাম বাংলা ও সমাজ এবং আমাদের শিকড় থেকে, জনজীবন থেকে, ফুটপাত থেকে, মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ থেকে। গভীর জীবন বোধ যেমন তার গল্পে আলো ছড়িয়েছে তেমনি স্বার্থ সংঘাতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে ক্ষত-বিক্ষত মানব চরিত্রের অন্তর্লীন রহস্যের চিত্রও তিনি গভীর মমতায় উন্মোচন করেছেন। আমি তার গল্পগুলোর আবহ এখানে উপস্থাপন করছি।
১.‘আলোকিত অন্ধকারের জনপথ’ গল্পে দেখা যায়--সমাজের হেয়, অপাংত্তেয়, ঘৃনিত ও অবহেলিত ছিন্নমূল একজন গলিত দেহের মানুষকে একজন চিকিৎসক ঘৃণা না করে গভীর মমতায় সিক্ত হয়ে তার মানবিকতা বোধের উৎসারনে চিকিৎসা ও সেবা দানে রোগমুক্ত করে তুলেছেন।
এখানে চিকিৎসকের মানবতাবোধ, দায়িত্ববোধ ও মহানুভবতা প্রকাশ পেয়েছে--যা এ যুগে দুর্লভ। বাহিরে আলোকিত অথচ ভিতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষগুলো কত নির্দয়! আবার নানা ছলে, বিশেষ করে ধর্মীয় ছলে বুঝাতে পারলে এই নির্দয় মানুষগুলোকেও আলোকিত না হোক, মানবিক স্রোতে আনা যায়--এ গল্পে তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে বাস্তবধর্মী গল্পের চিকিৎসক নিজেই বলেছেন, পুণ্যের উদ্দেশ্যে তিনি এ কাজ করেননি, করেছেন মানবিকতার টানে, বিবেকের তারণায়। তার নিজের ভাষায়--‘আমি ধর্ম, ঈশ্বর, পাপ-পূন্যে বিশ্বাসী কোন মানুষ নই। আমি ধর্মভীরু নই, বিবেক বিশ্বাসী কর্মভীরু মানুষ।
মানুষ হবার জন্য জ্ঞান হবার পর থেকে চেষ্টা করছি। মানুষ কিছুটা হতে পেরেছি বলে কখনও কখনও মনে করতে ইচ্ছে হয়; পরক্ষণে ভয় হয়, মানুষ হবার অপরাধে মানুষরূপী অমানুষেরা অথবা ভন্ড, ধার্মিকরূপী অধার্মিকেরা আমাকে পদে পদে যদি কাঁটা ছড়ায়ে দেয়...। ’
আজকের এ নির্মমতার যুগে চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি সবাইকে এরকম মানবিক বোধের শিক্ষায় দীক্ষা নেওয়া দরকার। গল্পের নায়কের বেশ কিছু কথা আমার খুব ভাল লেগেছে, যেমন--‘... অফিসে বসে ভাবছি, বিস্তীর্ণ শীতের কুয়াশা অথবা অন্ধকারের পথে আমরা আজো হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি। এত মানুষ, এত সম্পদ, এত কুরবানী, এত আনন্দ, আবার মানুষের কারণে কত যন্ত্রণা, কত দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে।
একজন Diabetic রোগী, সারাদিনে আধা কেজি খাবারও খেতে পারে না অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার। সম্পদ বাড়ানোর জন্য এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, হেন কোন খারাপ কাজ নেই--যা তারা করে না। যদি এরা ধর্মানুযায়ী যাকাত আদায় করত অথবা সরকারী নিয়মে ঠিকমত ট্যাক্স দিত তাহলে এদেশের পথে পথে এ রকম নারীরা পড়ে থাকত না।
কেন যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে না--বুঝি না। মানুষরূপী কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন যাদেরকে খুব সহজ করে পাগল বলি; এরা আমাদের আশে পাশে থাকে বিড়াল কুকুরের মত ছন্নছাড়া হয়ে।
ফুটপাতের সর্বহারারা তো তবুও ভিক্ষা বা কাজ এর মাধ্যমে খাবার চাইতে পারে। এরা তাও পারে না। কেউ এদেরকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
মানুষ, প্রকৃতির এ নির্মম খেলা থেকে কিছুই শিখে না। শিখে না ইতিহাস থেকে, শিখে না এ নিথর পড়ে থাকা মানুষরূপী, এ নারীটির জীবন থেকে।
তবে এ কাজ থেকে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম। সাধারণ মানুষরা কেউ একা একা ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মানবীয় গুণাবলি প্রকাশ করার সুযোগ সবাই চায়, সবাই খুঁজে। চায় একজন নেতা এবং তার নি:স্বার্থ নেতৃত্ব। এই যে আমি, নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি শুরু করেছি, এখন সবাই যার যার সাধ্য মত কাজ করছে।
আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ। ’
২. কোন দেশেই স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগন তথা সাধারন মানুষের অবদান বা স্বতস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা ছাড়া বিজয় অর্জিত হয় না। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামগঞ্জের মানুষের আত্নত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমরা ভুলে গেছি। শাশ্বত স্বপন এ বিষয়টি তার লেখায় শিল্পসৌকর্যে উপস্থাপন করেছেন ‘বেদনাময় সময়ের ভীড়ে’ গল্পে। যুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ঘূর্ণিঝড়ে ছিন্ন পাতার মত হারিয়ে যাওয়া জীবনে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য ট্রেন নামক সময়ের ভেলায় তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার আল্পণার সাথে নায়কের দেখা।
তার ‘না বলা কথা’--না বলার আলো আঁধারীর মাঝেই হারিয়ে যায়। এখানে লেখকের জীবনবোধ গভীরভাবে ফুটে উঠেছে--‘... ঝিক্-ঝিক্...ঝিক্-ঝিক্...করে ট্রেন চলছে দৃশ্যমান গতিতে আর আমার জীবন চলছে অদৃশ্যমান গতিতে--যে গতির গতিময়তা কখনো আমি উপলব্ধি করি না--করতে পারি না...। ’ গল্পে নায়কের মামার আদালতের জবান বন্ধতে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি এখানে বড় নির্মমভাবে প্রকাশ পেয়েছে--‘ ...উকিল আইনের ভাষায় মামাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে লাগল,
-- আপনি কেন সরকারের হাতে অস্ত্র জমা দেননি। আপনি তো জানতেন, অবৈধ অস্ত্র রাখা আইনের চোখে অপরাধ।
-- জানতাম।
কেন জমা দেব? ’৭১ আমাকে কি দিয়েছে? আমি মুক্তিযোদ্ধা, ঘৃণা করি ভাবলে। আমি এ স্টেনগান ছাড়া ’৭১ এর মহাকাল থেকে কিছুই আনতে পারিনি। পারিনি কামালের বাবাকে ফিরিয়ে আনতে। পারিনি ওর মাকে বাঁচাতে। পারিনি ওদের পড়াতে, খাওয়াতে।
এ অস্ত্র ছাড়া আমি কামালকে কিছু দিতে পারিনি। আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সাহায্য দেন, তারা বলেন, ’৭১--এ আপনারা কে, কোথায় ছিলেন? সেদিন রিলিফ অফিসে গিয়ে দেখি আলবদরেরা কাজ করছে। আমাকে দেখে বলছে, আমি নাকি দেশের বোঝা স্বরূপ...। ’
জীবন যুদ্ধে বিধ্বস্ত, পরাজিত নায়ক গল্পে নিজেকে বৃথা সান্তণা দিতে চেষ্টা করছেন--‘...বৃষ্টি ঝরা কালো আকাশ, রাতের আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছছে। মনে হয়, এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে পড়বে কঠিন এই পৃথিবীর বুকে।
ট্রেন চলছে আর বলছে, “আমি থেমে থাকি না। আমি চলি যখন যেখানে যতটুকু থামতে হয়, ততটুকু থামি, আর ফিরে তাকাই না পিছু। আমাকে অনুসরণ কর, তুমিও জীবনের সামনের পথগুলো পার হতে পারবে অনায়াসে। মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিয়ে আমাকে বলছে, বনিয়া চলে গেছে, থেমে থাকেনি। এই দেখ, আমিও চলছি তোমাদের পৃথিবীর চারপাশে।
আমি স্থির নই। তুমি কি মনে কর, বনিয়া তোমার স্মৃতি স্মরণ করে থেমে থাকে? মোটেই না। এ তোমার দুুর্বলতা...। ’
৩. ‘সময়ের লাশ’--গল্পে বৃদ্ধ বয়সে উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে নায়িকা নায়কের সাথে তার প্রেমের কাহিনী এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভুমির কিয়দংশ বর্ণনা করেছেন। এখানে নায়ক ’৫২ সালের সময়ের ধারক, নায়িকা মাতৃভূমির ধারক অর্থাৎ গল্পটি যেন, ’৫২ এর সময়ের সাথে লাজুক মাতৃভূমির ভালোবাসা-লুকোচুরি-মিছিল-আন্দোলন-যুদ্ধ-মৃত্যুর খেলা।
মহান ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃত পটভূমি সহ একদিকে দেশপ্রেম, অপরদিকে মানবিক প্রেমের একটি মনস্তাত্বিক সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে সময়ের লাশ গল্পে।
উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে রচিত গল্পে নায়িকা বৃদ্ধ বয়সে তার আত্নজীবনীর কিয়দংশের শেষে বলেছেন, ‘‘ভালবাসার শিকলে, সময় অথবা যৌবন কাউকেই বেঁধে রাখা যায় না। সময়ের কি মৃত্যু হয়? হয় না? সুমাদ চির জ্যোতির্ময় সময়, তাইতো সুমাদের মৃত্যু হয়নি। ভালোবাসার শিকলে বাঁধা সেই সময়টাকে ষাট বছর ধরে হৃদয়ের হাজার ফুট গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। এতদিন লুকিয়ে রেখেছি নারী বলে, যদি পাছে লোকে কিছু বলে।
আজ আমি বৃদ্ধা। সকল বয়সের বাইরে আমার জীবন। জীবনের এই ভাদ্র বেলায়, সকল মানুষের কাছে সেই সময়টাকে করুণ সুরে শঙ্খের আওয়াজে না পারলেও বাঁশের বাঁশিতে বাজিয়ে দিলাম। সুর ভেসে যাক, প্রত্যেক নারী-পুরুষে। হাজার মানুষের স্মৃতির ভীড়ে, এ স্মৃতি হোক সকলের আপন ।
’’
৪. ‘স্বপ্নের আঙ্গিনা’--গল্পে ছেলে সন্তানের জন্য পুরুষের তথা সমাজের যে আকাঙ্খা--তা বাস্তবায়নের জন্য হাজার বছর ধরে কত নারী যে দুঃসহ জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে জীবন-যাপন করেছে; কিংবা গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে; আজও করছে--তার হিসাব মিলানো সম্ভব নয়। হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে এমনি ধারণা ও মানসিকতার চলে আসছে যে, নারী শুধু পুত্র সন্তান জন্ম দেবার একটি আধার মাত্র। সামাজিক রুদ্ধ রথচক্র ও প্রথাবদ্ধ এই অন্ধবিধান এবং নারী জীবনের নিরন্তন যন্ত্রনার চিত্র তুলে বৃত্ত ভাঙ্গার সূচনা করেছেন লেখক তার স্বপ্নের আঙ্গিনায় গল্পে।
৫. দুইটি গল্প বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমের দাবী রাখে, একটি হল ঝরা পাতার গান, আরেকটি শরতের সরোদ। গল্প দুটিতে চরিত্র বা কাহিনী প্রাধান্য পায়নি, পেয়েছে প্রকৃতি; বিশেষ করে শীত ও শরৎ কালের বাংলার প্রকৃতি কিভাবে সৌন্দর্য পিয়াসু মানুষকে বাউল করে, পাগল করে--তা লেখকের নৈসর্গিক বর্ননায় এবং নানা উপমায় ধরা পড়েছে।
‘ঝরা পাতার গান’--গল্পে নায়ক খোকা এমনি প্রকৃতি প্রেমিক যে, স্ত্রীর গর্ভকালীন সময়ের দায়িত্বের কথা ভুলে প্রকৃতিতে হারিয়ে যান; ফিরে এসে দেখেন, সন্তান রেখে স্ত্রী না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সন্তানের মুখও নায়ককে প্রকৃতি থেকে ফেরাতে পারেনি। শীত তথা প্রকৃতির টানে নায়ক স্ত্রী তথা আত্নীয় পরিজন ভুলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিভাবে নদী-নালা-খাল-বিল বাঁওর-হাওর-বন জঙ্গল এ পড়ে থাকতেন, তা প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে বাংলা মাটি আর শিকড়ে কথা, লেখকের ভাষায়--‘ আমার নানী আমার ভবঘুরে জীবন মাটির ঘরের ধঞ্চে-পাটখড়ি বেড়ার ভিতরে বাঁধার জন্য শীতকালের সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন। দুই নানীর বকা খেতে খেতে শীতের এক রাতে বীনাকে ‘কবুল’ করে কাঁশ আর নাড়া দিয়ে নতুন ছাউনি করা ধঞ্চে-পাটখড়ি বেড়ার মাঝে মুলিবাঁশের দরজা ঠেলে দু’জনে ঢুকলাম।
ঢুকলাম না বলে, বলা যেতে পারে, দুই নানী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং বলে দিয়েছে, এই শীতেই যেন, নাতির গন্ধ পাওয়া যায়, আচারের ব্যবস্থা তারাই করবে..। ’
শীতের ত্রিমাত্রিক বর্ননার আরেক জায়গায়--‘ শীতের বনতল; শীতের সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা; শীতের জোৎস্না রাত্রির চাঁদ, দিনের সূর্য; শীতের নির্জনতা আর স্থান কাল-পাত্র ভেদে সৌন্দর্যের বৈচিত্রতা; নির্জন আকাশতলে দিগন্তব্যাপী কত রূপে, কত সাজে যে শীত কন্যা সাজে, এ বাংলার প্রকৃতিতে! সৌন্দর্য পিয়াসীর চোখ অথবা কবির মন হারিয়ে যায় বারে বারে প্রকৃতির নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড়-বাঁওড়-মাঠে-ঘাটে অথবা অন্য কোথাও, কোন কুয়াশার বাঁকে...। ’ এ গল্পে নায়কের দৃষ্টিতে এবং তার আতেœাপলব্ধির কিয়দংশে বাংলার শীতকালীন প্রকৃতির রূপ ফুটে উঠেছে।
‘শরতের সরোদ’ গল্পে নায়ক কবি মন নিয়ে ভরা যৌবনের জলতরঙ্গে শরতের কোন এক পড়ন্ত ভাদ্র বেলায় ভালোবাসার প্রবাসী সঙ্গীকে নিয়ে গ্রাম বাংলার রূপ সাগরে হারিয়ে যায়। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া প্রেম-ভালোবাসার বন্ধনে বাস্তবতার সূর্য জ্বলে উঠে; প্রবাসী সঙ্গী আবার চলে যায়।
লেখকের কথায়--‘...না, শরৎ কিবা আমি কেউ উপমাকে এ দেশের ঘাস-ফুল-নদীর সাথে বেঁধে রাখতে পারিনি...। ’
কাব্য গল্পের মধ্যে শরতের বিকাল-গোধূলী-সন্ধ্যা-রাতের সুনিপূণ বর্ণনা পাওয়া যায়--‘নিস্তরঙ্গ জলরাশি--দু’পাশে সারি সারি সাজানো কাশবন--নির্মল আকাশ--জলে নীল আকাশের ছবি--সাদা মেঘের কাঁচুলী নগ্ন আকাশের বুক ঢেকে আছে। আকাশের নীলাভ নরম বুকে কখনও কখনও খণ্ড খণ্ড কিছু মেঘকে ভেজা ভেজা তুলা, পাহাড়, দ্বীপ অথবা মানচিত্রের মত মনে হয়। সন্ধ্যায় জোনাকীর নিভু নিভু প্রদীপ--ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম ডেকে চলা--ছলাৎ করে জেগে ওঠা দু’একটা জলঢেউ যেন, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। উপমা আমার সাথে থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, কেউ আমার সাথে নেই।
সৌখিন মাঝি, সৌখিন জেলে অথবা বিকালটুকুর সৌন্দর্য ভাগ করে নেওয়া অতিথি মানুষগুলো অথবা শেষ বিকালের ঘরে ফেরা পাখিরা জলপোকা মুখে নিয়ে উপভোগ করে জলডাঙ্গার জলবেষ্টিত দোয়াল্লীর চরের প্রকৃতি। জলাঙ্গীর স্নিগ্ধ ভেজা বাংলার লালিমা মাখা গোধূলীবেলায় বলাকারা সারা দিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে নীড়ে ফিরে যায়। আঁধার নামে ধীরে ধীরে, দিগন্তে ঘুমাতে যায় ক্লান্ত সূর্য। বাঁকা চাঁদ সূর্যের আলো ধার করে রাখে দিনের বেলা; রাতে জোৎস্ন্ায় ভরে দেয় জল আর কাঁশফুলে ঘেরা মাঠ, ঘাট আর গল্পে ভরা আঙিনা। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে শিমুলের ডালে অথবা নিমপেঁচা বসে থাকে নিমডালে।
এমনি শরতের পূর্ণিমার রাতে যদি দুজনে চাঁদের বুড়ির কাছে বেড়াতে যেতে পারতাম। আবার অমাবশ্যায় গায়ের জলপথে ধীরে ধীরে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জল পথের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠে খালের দু’পারে বনপোকা, ইঁদুর, শিয়ালের ছোট-বড় নানা আকারের গর্ত। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আঁধার প্রকৃতিকে করে আরো ভীত সন্ত্রস্ত। যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির এই অন্ধকারে অনন্তের পথে দু’জনে চলেছি শরতের এই জল পথ ধরে...।
’ ব্যতিক্রমী এই পদ্য গল্পে লেখক নায়কের ভাষায় শরৎকালের নিখুত বর্ণনা দিয়েছেন--যা বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখায় দেখা যায়।
৬.‘সমর্পণ’--গল্পে পূজারিণী জাত-পাত, বর্ণ বিভেদ না বুঝেই নিজের অজান্তে স্বহৃদয় পূজার অর্ঘ হিসাবে পূজারী দান করে ধ্যান করতে থাকে ব্রাক্ষণ বর পাবার আশায়। ধর্মীয় উন্মাদনার ফলে সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগ হাজার বছর ধরে চলছে। দেশ ত্যাগ পরবর্তী সংখ্যালঘুদের করুণ স্মৃতিগুলো মানবতা বোধের মানুষগুলোকে কাঁদায়। গল্পের ভাষায়--‘...মন্দিরের পুরাতন দালানের প্রায়ই ইট খসে পড়ে।
তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। তাই ওরা ওখানে থাকে না। এক সময় পুরো ঠাকুরবাড়ী লোকে পরিপূর্ণ ছিল। ঘরে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার, রান্না ঘরে রাধুনীর চিৎকার, উঠানে বউ-শ্বাশুরীর খোশগল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের সশব্দ কথোপকথন। আজ আর সেই কোলাহল নেই।
সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। সবার মাথায় যবন ভূত চেপেছে। ক্রমাগত সবাই কোলকাতা চলে যাচ্ছে অথচ কোলকাতার যবনদের মাথায় হিন্দু ভূত চাপা সত্ত্বেও কোন যবন আমাদের গ্রামে এসেছে বলে শুনি নাই...। ’ সনাতন ধর্মীয় কিছ ুমানুষ এখনও এ দেশে আছে বলে লেখক উপমা করেছেন, ‘... পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে...। ’
ঠিক একই রকমভাবে ‘সিঁদু রাঙা স্মৃতি’--গল্পে নাহিদ তার পুতুল খেলার সময়ের ভালোবাসার বউটির দেশ ত্যাগ তার ছোট বেলার স্মৃতি উগড়িয়ে করুণভাবে বর্ণনা করেছেন--...হিন্দুদের অনেকেই কলকাতা চলে গেছে।
ছোটবেলায় হিন্দু-মুসলমান বুঝিনি। আমাদের ঈদ আর ওদের পূজা আলাদা করে আমরা ভাবিনি। দু’টাতেই সমান আনন্দ করতাম আমরা। মনে হয়, পূজাতেই আমি বেশ আনন্দ করতাম...। ... আমি জানতে চাই, কেন ওরা কলকাতা চলে যায়? কেন দেশ বিভাজন হল? এরই মাঝে শুনলাম, সিঁদুর এর মা-বাবা সবাই কলকাতা চলে গেছে।
এই বাংলাদেশে স্মৃতি ছাড়া সিঁদুরের আর কিছু রইল না। ও আর কোনদিন মাতৃভূমিতে আসবে না...। ’ এ দুটি গল্পে একটি ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠীর জনজীবন, তাদের মন্দির, তাদের হাজার হাজার বছরের শাশ্বত ধারার প্রবাহমান ধর্ম, সংস্কৃতি বিলুপ্তি বা শেওলার মত বানের জলে দেশান্তর এর বিষয়টি উঠে এসেছে।
৭. ‘শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া’--গল্পে সমাজের মানুষ সৃষ্ট বিধি-নিষেধ তোয়াক্কা না করে, আবেগ দিয়ে সময়ের উল্টোস্রোতে শত বাঁধা পেরিয়ে, নিজেদের স্বপ্ন পূরণের অভিলাশ নিয়ে, ভিন্ন ধর্মের দু’টি নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীর ভালোবাসা গন্তব্যহীন পথে অনন্ত যাত্রায় ছুটে চলেছে। গল্পের ভাষায়Ñ‘অতীতের পূত-পবিত্র ভালোবাসায় তারা সন্মূখের বর্তমানকে টেনে নিয়ে চলছে ভবিষ্যতের দিকে।
বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে তারা; দেখছে, শত শত কিবা হাজার বছরের পুরানা, ধ্রুব মসজিদ আর ধ্রুব মন্দির তাদের পিছু নিয়েছে কিনা; দেখছে, সমাজের যুক্তিহীন কঠোর নিয়মের বৃত্তাকার শিকলগুলি হাত-পা বাঁধার জন্য ছুটে আসছে কিনা। দুক্ দুক্ করে দুই হৃদয় কাঁপছে। ছেলেটি যত দ্রুত দৌড়াচ্ছে মেয়েটি তত দ্রুত পারছে না। তবুও প্রাণপণ ছুটছে আর ছুটছে। মেয়েটির মনে হচ্ছে, শত শিকল যেন, তার পা জড়িয়ে ধরছে--তাকে সামনে যেতে দিতে চায় না--তাকে ফিরিয়ে আনতে চায় বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের মন্দিরে।
এ সমাজ, এ ঘটনা না জানার আগেই শত শিকল তাকে হিন্দুত্বের মন্দিরে ফিরিয়ে আনতে চায় নতুবা কোনদিন আর তার প্রবেশাধিকার থাকবে না। কারণ সনাতন হিন্দুত্বের বেড়াজাল বড় কঠোর। এখান থেকে (কষ্ট হলেও) বের হবার দরজা আছে। কিন্তু (শত কষ্ট করলেও) ঢুকার দরজা নেই...। ’
এভাবেই গল্পগুলোতে লেখক যেমন বাংলা ছোট গল্পের ক্ষেত্রে মৌলিক অভিধার সৃষ্টি করেছেন, তেমনি কাহিনী বিন্যাস, চরিত্র সৃষ্টি ও মানবিক আবহ রচনায় এবং নান্দনিকতায় সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।
তবে আলোচনার প্রান্তিকে একটি গল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, গল্পটি হচ্ছে ‘অনামিকা’। গল্পটির কাহিনী ভিন্ন্ প্রকৃতির ও মেজাজের হলেও রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’ ও ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে যেমন পিতৃহৃদয়ের চিরন্তন আবেদন ও অনুভূতি তথা বিশ্বানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তেমনি কুড়িয়ে পাওয়া পথশিশু ‘অনামিকাকে দিয়ে উন্মোচন করেছেন পিতৃহৃদয়ের এক চিরন্তন আবেদন, অনুভূতি। ‘অনামিকা’ গল্পে কুড়িয়ে পাওয়া অনামিকা নামক এক নারী শিশুকে নিয়ে চিরকুমার পিতার হৃদয় বিদারক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অজানা এক রোগে অনামিকার মৃত্যু এবং জনস্বার্থে হাসপাতালে মৃত কন্যা দান--চিরকুমার পিতাসহ আরো অনেককে চোখের জলে ভাসিয়ে যায়। গল্পটিতে লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মানব মনের সূক্ষ্ন অনুভূতি পরিস্ফূটিত হয়েছে ।
আমাদের গল্প তথা কথা সাহিত্যের আসরে ‘ভাদ্র ভাসান” নামক গল্প গ্রন্থের মাধ্যমে শাশ্বত স্বপনের উজ্জ্বল উপস্থিতিকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং আমি মনে করি, আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে যেভাবে অলীক কাহিনী ও ভূতের কাহিনীর ধ্রুম্রজালে কিশোর-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা জাতির গর্ব, গৌরব ভুলে যাচ্ছে এবং শিকড় বিচ্যুত হচ্ছে--সেখানে দেশ, মাটি ও মানুষ এবং বাস্তব ভিত্তিক কাহিনী নিয়ে শাশ্বত স্বপনের গল্পগুচ্ছ ‘ভাদ্র ভাসান’ একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনন্য প্রকাশ। আমি আবার তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ
গাজী ভবন, ৬-সি
৪১, নয়া পল্টন (ভি.আই.পি রোড)
ঢাকা-১০০০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।