আমরা স্কুল শেষে দল বেধে বাড়ী ফিরতাম। ক্লাস সিক্সের এক দঙ্গল ছেলেপিলে হৈ হৈ করতে করতে বিকেলের শেষদিকে বাড়ী ফিরছে। দৃশ্যটা আমাদের জন্য খুব সুখকর হলেও অন্যদের জন্য তা ছিল না। আমরা বাড়ী ফেরার পথে রাস্তায় হৈ চৈ করতাম, পথে কোন পেয়ারা গাছ পড়লে তা থেকে গণহারে পেয়ারা পাড়তাম, কারও মুরগী ধাওয়া করতাম অথবা কোন একটা ইটের আধলাকে ফুটবল বানিয়ে পায়ে পায়ে চালাচালি করতাম। সময়টা ছিল আনন্দময় এবং প্রাচুর্যে ভরপুর।
আমাদের কারও কাছে হাত খরচের কোন টাকা থাকত না, কারণ আমাদের পরিবারগুলি হাত খরচ বিষয়টাকে ভাল চোখে দেখত না, স্রেফ অপচয় মনে করত। আমরা রাস্তার আশেপাশের দোকান থেকে কোনকিছু কিনতে পারতাম না অথবা স্কুলে যে লোকটা ঝালমুড়ি বিক্রি করে তার কাছ থেকে ঝালমুড়ি কেনাটা ছিল আমাদের নাগালের বাইরে। আমরা এতেই অভ্যস্ত ছিলাম।
আমাদের মধ্যে কোন হীনমন্যতা ছিল না।
আর্থিক সমস্যা আমাদের কাছে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মতই একটা সাধারণ সমস্যা ছিল।
এটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কোন দরকার ছিল না, কারণ, আমাদের পরিবার এ ব্যাপারে যথেষ্ট মাথা ঘামাত। আমরা তাই গাছের পেয়ারা অথবা ইটের আধলাকে ফুটবল বানিয়েই নিজেদের পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করতাম।
কোন একদিন বিকেল বেলায় এরকম হৈ হৈ করতে বাড়ী ফিরছি। নানা বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করছি। এর মাঝে শোয়েব আখতারের বোলিং অথবা চিত্রনায়ক মান্নার মারপিট নৈপুণ্য অথবা নিতান্তই যমুনা সেতুতে কয়টা মাথা দেওয়া হয়েছে নদীর ক্ষুধা নিবারণের জন্য, এই জাতিয় বিষয়গুলো উঠে আসছে, আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে।
কেউ একজন রামসাগরের ফিবছর এক মায়ের এক ছেলের ভোগ নেওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছে। হঠাৎ সাহেদ আমাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে বলল, তরুর মাথা খারাপ হইয়া গেছে। আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, কেন কি হইছে?
ও পকেটে চাক্কু নিয়ে ঘুরে।
কিসের চাক্কু?
একটা ছোট্ট চাক্কু।
কিল্লাইগা?
ওর মার লগে কোন বেটা নাকি আইসা গপ্প করে।
ঐ বেটারে ও খুন করব। এইডা আবার অনেকেরে কৈয়া বেড়াইতাছে। ক দেহি দোস্ত এইরকম বেক্কলামী কেউ করে। কেডা ওর মার লগে আইসা গপ্প করে সেইডা আবার মাইনষেরে কৈয়া বেড়ায়।
আমি সরাসরি তরুর কাছে যেয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম এই ব্যাপারে।
তরু এর সত্যতা নিশ্চিত করল। ওর পকেট থেকে একটা চাকু বের করে দেখাল। আমি চাকুটা দেখলাম। সাধারণ মাঝারি আকৃতির একটা চাকু। বাসায় ফল কাটার কাজে এ ধরনের চাকু ব্যাবহার করা হয়।
আমি চিন্তা করতে লাগলাম এই চাকুটা দিয়ে একটা বড়সড় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে খুন করা সম্ভব হবে কিনা।
আমরা আমাদের চারপাশ সম্পর্কে জ্ঞান রাখতাম। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম তরুর মা কি কাজ করে। কেন করে তাও আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।
তরুর বাবা ছিল, আমরা তার অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে জানতাম, তবে তার অস্তিত্ত্ব সরব ছিল না।
মাঝে মাঝে হঠাৎ তাকে দেখা যেত এবং বছরের বেশীরভাগ সময়ই সে উধাও থাকত। তরুর কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম তার বাবা অনেকদিন আগে যে কারখানায় কাজ করত সেখানে একটা দুর্ঘটনার ফলে আহত হয় এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে সে দেশের বাড়ীতে চলে যায়। দেশের বাড়ীর জমি বিক্রি করে তরুদের সংসার চলে। অন্য সূত্রে পাওয়া গুজব থেকে আমরা আরও জেনেছিলাম তরুর বাবা দেশের বাড়ীতে আরেকটা বিয়ে করেছে।
তরু তার মা, ছোট বোন আর নানীর সাথে থাকত একটা ভাড়া বাসায়। তরুদের বাসায় আমি যে কয়বার গিয়েছি ততবারই তরুর মা আমাকে যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং ভাত না খাইয়ে ছাড়েননি। উনাকে আমি আন্টি বলে ডাকতাম আর উনি আমাকে বাবা বলে ডাকতেন। আমার প্রতি তার মমত্ববোধ সবসমই ছিল অকৃত্তিম।
তরুকে আমি ঘাটালাম না।
আমি পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আমার প্রশ্ন সেখানেই থামিয়ে দিলাম। আমি জানতাম তরু প্রায়ই হাতের লেখা জমা দিতে পারে না, কারণ তার হাতের লেখার খাতা কেনা হত না। স্কুলের পাঠ্যবইগুলোও সে আমাদের থেকে দেরিতে কিনেছিল।
সাহেদ আবার আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং গলা নীচু করে বলতে থাকে, ওর মা যে খানকিগিরী করে এইটা ওয় যে এমনে কয় সেইডা কি ঠিক?
আমি প্রত্যুত্তরে শুধু বলি, হুম।
সাহেদের কথায় আমার নিজের অপমানবোধ জাগে। তরুর মা আমাকে আমাকে যে কয়বার আদর করে ভাত বেড়ে খাইয়েছেন, তরকারির প্লেট থেকে মাছের বড় টুকরাটা আমার পাতে তুলে দিয়েছেন সেই দৃশ্য আমার মাথায় ভাসে। আমি তরুর সাথে এ ব্যাপারে পরে একান্তে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার নিজেরও কিছুটা তখন খুনী হতে ইচ্ছা জাগে। আমি চিন্তা করতে থাকি ঘটনার সমাধান কিভাবে করা যায়।
আমি সবার থেকে সরে একটু আলাদা হয়ে তরুর পাশে পাশে হাটা শুরু করি। তরুকে বলি, "দোস্ত আংকেল কৈ?"
বাবা অনেকদিন বাড়ী আসে না। দেশের বাড়ী সেই যে গেছে এরপরে আর আসে নাই। তরুর মুখটা কিছুটা বিষন্ন দেখায়।
আন্টি যে চাকরী করত তার কি হইছে?
চাকরী শেষ।
এখন চলতাছে কেমনে?
মার কিছু টাকা আছে জমানি, ঐ টাকাডা দিয়া চলতাছে।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কিভাবে চলছে তরুর পরিবার। তবুও আমি ওকে জিজ্ঞেস করি। আমি ওর মুখ থেকে একটা উত্তর চাই যে ওদের পরিবার এখন সেভাবে চলছে না যেভাবে আমি ভাবছি। আমি এই অনর্থক উত্তর থেকে সান্তনা পেতে চাই যে অবস্থা এখনও অতটা খারাপ হয়নি।
আমার কিছু সান্তনা দরকার। মিথ্যে সান্তনা হলেও আমার কিছু সান্তনা দরকার। আমি বিশ্বাস স্থাপন করতে চাই যে জমানো টাকায় সংসার চলছে। আমি প্রবোধ দিই মনকে। মায়ের অপমান দেখতে কোন সন্তানেরই ভাল লাগার কথা নয়।
আমি বলি, হুমম বুঝছি, ঐ বদ বেটায় আইসা আন্টিরে ডিস্টার্ব করে। ঐ বেটা কি তোগর এলাকার নাকি অন্য জায়গা থিকা আহে?
আমাগোর এলাকার না। কোন জায়গা থিকা আহে জানিনা। তয় ঐ শয়তানডা মার সাথে অনেক্ষণ ঘরে বইয়া আলাপ করে, মার হাত ধরে।
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে আলাপ এগুনো যায়।
আমাদের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা ছিল আমাদের হাত পা গুলো ছিল দুর্বল, ছোট ছোট, আমরা ছিলাম কমবয়সী। পৃথিবীর করুণার উপর আমরা তখনও নির্ভরশীল, পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। আমি আমার অক্ষমতা বুঝতে পারি। আমি আরও বুঝতে পারি তরুও অক্ষম। তাই সে পকেটে একটি চাকু নিয়ে ঘুরে একজনকে খুন করার জন্য।
অক্ষমরাই খুন করে।
আমি তরুকে বলি, কাইলকা এই নিয়া তোর সাথে কথা হইব। ঐ হারামজাদারে কেমনে সাইজ করা যায় সেইডা নিয়া চিন্তা করতে হইব। তুই কিছু ভাবিস না, ঐ হারামজাদারে ঠিকই সোজা কইরা ফালামু। তরু অবশ্য কেবল সোজা করার কথায় সন্তুষ্ট নয়।
সে খুন করতে চায়। এ ব্যাপারে সে তার খুনের ইচ্ছার কথা পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। আমি চিন্তা করতে থাকি, একান্তই যদি খুন করতে হয় তবে কিভাবে করা যায়। এই ছোট চাকু দিয়ে খুন করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আরও ভাল অস্ত্র।
সে অস্ত্র কিভাবে জোগার করা যায় আমি তার চিন্তা করতে থাকি। আমি নিজেও এই খুনে অংশগ্রহণ করার কথা ভাবতে থাকি। আমারও খুনী হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। আমি চিন্তা করতে থাকি কতটুকু লম্বা আর কতটুকু ধারাল অস্ত্র হলে আমি আর তরু দুইজনে মিলে খুন পর্বটা সমাপ্ত করতে পারব। আমি চিন্তা করতে থাকি খুন কার্য সম্পাদনের সময় আমাদের পোশাক কি ধরনের হওয়া উচিত।
কতটুকু পোশাক পরিধান করলে আমাদের কেউ চিনতে পারবে না। আমি ভাবতে থাকি খুনের সময় নিয়ে। সন্ধ্যার পরে হলে সবচেয়ে ভাল হয়। আরও ভাল হয় রাত্রের দিকে হলে। যত অন্ধকার তত নিরাপদ।
আমি তরুকে জিজ্ঞাস করতে গিয়েও জিজ্ঞাস করি না যে লোকটা কখন আসে কখন যায়। ভাবি আগামীকাল এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
আমরা অক্ষম ছিলাম। আমাদের হাত পা ছিল দুর্বল ও ছোট ছোট। আমাদের পক্ষে আগামীর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।