সুরঞ্জনা, বলো নাকো কথা ঐ যুবকের সাথে.. :)
ক্লাব হাউসে ভাঙ্গা বেড়ার ফাক দিয়ে ঢোকা মাত্র ঝাঝালো ধোয়ায় চোখে মুখে যখন অন্ধকার দেখতে লাগলাম , বুঝলাম বন্ধুবর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাজা টানতে বসেছেন । ক্লাব হাউস অবশ্যই সকল প্রকার নেশাদ্রব্য ও ধুমপান হতে মুক্ত থাকবে, প্রতিষ্ঠাকালীন এই ১ নম্বর শর্তটিকে আমাদের এই কবিগুরু সকাল বিকেল দুবেলা নিয়ম করেই ভাঙ্গেন । দরজার উল্টোদিকে অন্ধকার কোনায় একটা তিনপায়ের চৌকি আছে, রবিমশাই সেখানেই আধশোয়া হয়ে আরাম করে হাতে পাকানো বিড়িটায় টান দিচ্ছেন । চৌকিটা এনেছিলো মুকুল , ওর ছোট ভাইটা খুন হবার পর ওর মাথায় প্ল্যানচেটের ভুত চেপেছিলো, ভাইয়ের আত্মাটা ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলো সত্যি সত্যি ওকে দাশু কবিরাজের জিনটাই মেরেছিলো কিনা।
দরজার পাশে জানালা, জানালার পাশে একটা টেবিল ।
আমি জানালা খুলে দিয়ে টেবিলটা ঝেড়ে নিয়ে তাতে আমাদের পত্রিকাটার ড্রাফট কাগজ গুলো বিছালাম । পাহ্মিক একটা জাতীয় পত্রিকা বের করি আমরা, আমরা মানে আমি আর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বিজ্ঞান সাহিত্য পত্রিকাটার নাম , ইনিয়ে বিনিয়ে বলা গালভরা নাম না দিয়ে স্ট্রেইট যা নিয়ে আলোচনা হয় তাই । পত্রিকার আমি সম্পাদক স্ল্যাশ চিত্রকর স্ল্যাশ প্রধান প্রতিবেদক স্ল্যাশ বিজ্ঞান লেখক স্ল্যাশ প্রুফ রিডার । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানান জ্ঞান ভয়াবহ , তাই সে হলো প্রধান কবি স্ল্যাশ ঔপন্যাসিক স্ল্যাশ ধারাবাহিক নাটকের নাট্যকার স্ল্যাশ জনমত জরিপের একমাত্র মতামতদাতা !
আমি পুরোনো টাইপ রাইটারটাতে কাগজ তুলে ড্রাফটগুলো দেখে দেখে টাইপ করতে শুরু করলাম ।
- এহহ হ্যাক থু উ উ । এগুলা কি রাখছিস ?
আমি ঘাড় না ঘুরিয়েও বুঝতে পারলাম চৌকির নিচে রাখা আমার কাচের বয়াম গুলোতে ওর চোখ পড়েছে । বয়াম গুলোতে ফরমালডিহাইডের দ্রবনে ডুবিয়ে রেখেছি বিভিন্ন পোকা মাকড় আর প্রানির মৃতদেহ । বায়োলজি আমার অসম্ভব আগ্রহের বিষয় , আমার ফিউচার প্ল্যান অনেক গুলো, তবে সবগুলোই খ্যাতিমান জীববিজ্ঞানী হওয়ার সাথে সম্পর্কিত । ছোট চাচা আমাদেরই স্কুলের বায়োলজি টিচার , সেসুত্রে স্কুলের বায়োলজির যে ছোট্ট ল্যাবটা আছে তাতে আমার প্রায় অবাধ যাতায়াত ।
বয়াম গুলো হরলিক্সের , কিন্তু ক্যামিক্যাল গুলো চাচার ল্যাব থেকে না বলে সরিয়ে আনা ।
- এগুলা তুই কাটছিস?
কবি অবাক এবং ঘৃনার মিশ্র চোখে তাকায় । আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে হাতের কাজে মন দিলাম । কথা আমি খুব কম বলি, যে কটা বলি তা অপ্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য না।
বন্ধু রবীন্দ্রনাথ চৌকি ছেড়ে আমার দিকে আসতে লাগলো কিছু একটা আবৃত্তি করতে করতে , বুঝলাম এটা সদ্যই কবির মগজে এসেছে ।
'বিজ্ঞান জয়যাত্রার এই স্বর্ণ যুগে
কেহ যেনো নাহি মরে কলেরাতে ভুগে !'
- বাহ বাহ কি দারুন ছন্দ , লিখে দে এটা । লিখে দে এহ্মন ।
আমি আমতা আমতা করছিলাম ,কিন্তু কুইজের নিচে এখনও জায়গা অনেকটা খালি আছে । কথা না বাড়িয়ে টাইপ করতে লাগলাম ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ভাঙ্গা গালের দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে চোখ মুখ কুচকে বসে থাকে , ভাব দেখে বুঝলাম কবিতা আনার চেষ্টা চলছে ।
- কিরে পরাগ , কি করস ? পেপার বানাস ? সম্বাদিক ওইছোস , সম্বাদিক ? হেহেহে..
জানালার বাইরে বিশু এসে দাড়ায় । স্কুলে বিশু আমাদের সাথেই পড়ে ক্লাস টেনে, কিন্তু বয়সে বোধহয় একটু বড়ই হবে । সারাহ্মন একটু খোচানোর চেষ্টা করতে থাকে , তবে লোক খারাপ না।
বিশু ঘরের ভেতরে উকি দিলো, ভিতরে কে? টিপলু নাকি?
- হুম ।
বিশু এবার জানালা দিয়ে শরীরের অর্ধেক ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে, কি রে টিপলু, চুরি করস নাকি? চোরের পো ।
হেহেহে...
টিপলু ওরফে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগুন দৃষ্টিতে বিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে , কিছু বলে না। পারলে ও এতহ্মনে বিশুকে কাচাই খেয়ে ফেলতো, কিন্তু ওর সাথে শক্তিতে পারবে না। তাছাড়া এই ধরনের কথাবার্তা তাকে প্রায়ই শুনতে হয় বলে টিপলুর সহ্যশক্তিটাও মনে হয় বেশীই ।
- তোর বাপ গরু চুরি করতো, তোর যে চেহারা তুই তো মুরগীর বাচ্চাও চুরি করতে পারবি না ।
জ্বালাস না বিশু ।
- তোর বাপে মরছে পাঞ্জা খায়া, তুই মরবি গাঞ্জা খায়া । হেহেহে..
ভাগ ব্যাটা ভাগ এখান থেকে। আমি ধমকে উঠি ।
যাওয়ার আগে হাতের পেয়ারাটায় শেষ কামড় বসিয়ে শুধু শুধু সেটা টিপলুর দিকে ছুড়ে মারলো । ব্যাটা আজ বেশীই বাড়াবাড়ি করছে ।
অত্র এলাকার কুখ্যাত গরু চোর লালু চোরার একমাত্র ছেলের যেদিন জন্ম হয় লালু সেদিন পুর্ব পাড়ার লোকদের হাতে ধরা পড়ে বিচারের অপেহ্মায় । লালুর স্ত্রী পর্যন্ত ছেলেকে জন্ম দিয়েই স্বামী শোকে মাতম শুরু করেছিলো কারন ততহ্মনে খবর চাউর হয়েছিলো লালুকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে মোল্লাবাড়ীর মানুষজন ।
এই গোলমালেই সদ্যজাত শিশুটির একটা ভালো নামও রাখা হলো না । কেউ হয়তো ঠাট্টা করে শিশুটাকে ডেকেছিলো টিপলু, ব্যাস সেটাই রয়ে গেলো ।
গরীবের ঘোড়া রোগ হয় , চোরের ছেলের হলো কবি হবার রোগ ।
ক্লাস ফাইভ ,সিক্সেই ওর খেয়াল হলো দুটা শব্দের মধ্যে ছন্দ কিভাবে হয় সেটা সে বোঝে। মাথায় চেপে বসলো কবি হবার ভুত । কিন্তু কবি হবার পহ্মে টিপলু নামটা ঠিক জুতসই না । নিজেই নিজের নাম ঠিক করলো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । পদবীসহ নাম নেয়া য্য় না, মুসলমানের ছেলের হিন্দু নাম হয় না, এতো বিখ্যাত লোকের নাম কেউ নেয় না ইত্যাদি কোনো যুক্তি ই তার কাছে আমল পেলো না, নাম সে এটাই নেবে।
কবে কোন কালে রবি ঠাকুরের আমাদের ছোট নদী আবৃত্তি করেই তার কাব্যে অনুরাগের সুচনা, সে অবদানের প্রতিদান সে দেবে কবির নামটাই মেরে দিয়ে !
একটা মানুষও তার কবিতার প্রশংসা করে না, কোথাও ওকে আবৃত্তি করতে দেয় না কেউ । তবু সেই ক্লাস ফাইভ থেকে এই ক্লাস টেন পর্যন্ত সে তার কবিতার মোহে অন্ধ।
আমি ই ওকে টিটকারী ফিটকারী দেই না, তাই আমার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে ।
খেয়াল করিনি টিপলু থমথমে মুখে বসে ছিলো এতহ্মন । এবার হনহন করে বেরিয়ে গেলো ।
আমিও কাগজ গুছিয়ে উঠে পরলাম ।
বাসায় ঢুকেই রাস্তায় যে কোলা ব্যাঙটাকে ধরেছিলাম সেটাকে ফরমালডি হাইডের দ্রবনে ডুবিয়ে দিলাম । তার পর গতকালের একটা ঘাসফড়িংকে আস্তে আস্তে ব্যবচ্ছেদ করতে লাগলাম ।
-ছোড বাই ।
কাশেম এসে দরজায় টোকা দিলো ।
দরজা খোলার প্রশ্নই আসে না, সবাই আমার এই মিনিয়েচার বায়োলজি ল্যাব দেখে আতকে ওঠে । খুব দরকার ছাড়া আমি ঘরে কাউকে ঢুকতে দেই না। বাড়ির কামলার আমার কাছে খুব দরকার হওয়ার কথাও নয় ।
- ছোড বাই ।
- হুম , বল ।
- বাজারে মারামারি লাগছে ।
- তাই নাকি ? আমি আগ্রহের সাথে ঘুরে বসলাম এবার । আমাদের মফস্বলটা খুব ছোট ,তাই যারা এখানের বাসিন্দা আহ্মরিক অর্থেই তাদের অধিকাংশ একে অন্যের আত্মীয় । কথা কাটাকাটি হয় এদের মাঝে প্রায়ই , কিন্তু শারীরীক আক্রমনটা তেমন হয় না । যখন সত্যি সত্যি ভরা জমায়েতে দুই চারজন মানুষ ধুন্ধুমার মারপিট শুরু করে , আমাদের মত কিশোরদের মাঝে তখন উত্তেজনার জোয়ার বয়ে যায় ।
- ওই পাড়ার বিশু আর আমাগো টিপলু । টিপলুর নাক ফাটায়ে দেছে ।
ফাটারই কথা, সাইজে তিনগুন পালোয়ানের সাথে লাগতে গেলে নাকের মায়া তো ছাড়তে হবেই । কিন্তু আমি হতাশ হলাম । বড়রা না, সেই ছোটদেরই মারামারি ।
সন্ধ্যার আগে আগে ঘর থেকে বের হতেই আব্বার সাথে দেখা । বাইরের ঘরের ইজি চেয়ারে বসে দুইতিন লোকের সাথে কথা বলছিলেন । আমাকে দেখলেন উঠান পার হবার ঠিক আগ মুহুর্তে ।
- পরাগ ।
- জি আব্বা ।
- সন্ধ্যা বেলা কই যাও ?
- বাজারে যাই।
- হাতের ব্যাগে কি?
আমি হাতে থাকে বাজারের ব্যাগের দিকে তাকালাম । ‘
- পুরানো খাতা আর বই’ ।
আমার আব্বা খুবই ব্যস্ত মানুষ । হবেন না কেনো, তিন বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান , তারও আগের চারবার ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ।
মানুষ তার কাছে তো আসবেই পরামর্শের আশায় । আব্বা তার ইজি চেয়ারে বসে সন্ধ্যা থেকে পরামর্শের ঝুলি খুলে বসে, মানুষজন এসে বসে । ওজন অনুসারে কেউ পায়ের কাছে, কেউ পাশের কাঠের চেয়ারে । মুখ পাংশু করে বসে থাকে, কেউ কেউ কাদে । অনেক রাতে আস্তে আস্তে বাড়ি ফেরে ।
পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গলো মানুষের হুড়োহুড়ি আর কান্নার শব্দে । কিছুহ্মন চুপ করে বসে বুঝতে পারলাম কেউ একজন মারা গেছে । মানুষ মারা যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজন যখন চেয়ারম্যানের বাড়ী আসে তার একটাই মানে । মানুষটি অপঘাতে মারা গেছে ।
পুকুর পাড়ে গিয়ে দাত মাজতে মাজতেই সব খবর পেয়ে গেলাম ।
বিশুর লাশ পাওয়া গেছে ভোরে জঙ্গলের পাশে । কেউ একজন প্রচন্ড ক্রোধে তার শরীর হ্মত বিহ্মত করেছে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে ।
এবং সকাল থেকে টিপলুর কোনো খোজ নাই ।
ঘরে ফিরে খেতে বসলাম । আব্বা আগে থেকেই খাওয়ার টেবিলে বসে ছিলেন ।
আমাকে দেখি সামনের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলেন ।
- তোমার টেস্ট পরীহ্মা যেনো কবে?
- সামনের মাসে ।
- পড়াশুনা চলছে ঠিক মতো?
- জি আব্বা ।
আব্বা হাত ধুতে ধুতে হাক দিলেন । মারুফ কোথায় ? ওর ক্লাস নাই?
ছোট চাচা আমার স্কুলেরই টিচার ।
আমি আর ছোট চাচা একসাথে স্কুলে যাই ওর মোটর বাইকে ।
চাচা ঘরে ঢুকলেন সাথে সাথেই । বললেন , লালুর ছেলেটার খোজ পাওয়া গেলো ?
আমার বিধবা মেঝ ফুপি আমাদের সাথেই থাকেন অনেক বছর হলো। ফুপি আব্বাকে রুটি দিচ্ছিলেন পাতে । আব্বা হাত নেড়ে তাকে আর দিতে মানা করলেন।
চাচাকে বললেন, না পাওয়া যায় নাই। পুলিশ চলে আসছে, তারাই খুজবে এখন ।
- খুন করে ফেললো পোলাটা ! আসলে রক্ত যেমন ।
আব্বা আমার দিকে ফিরলেন, তোমার সাথে পোলাটার চলাফেরা ছিলো এটা সবাই জানে। তাই তোমার সাথে সে দেখা করতে আসলে অবশ্যই ঘরে আটকে রেখে আমাকে খবর দিবা ।
মনে থাকবে?
আমি একটা দম নিলাম , আব্বা একটা কথা বলতে পারি?
বল
ও খুন করতে পারে এইটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। ও খুব নরম মনের ছেলে , কবিতা টবিতা লেখে । ও এমন কাজ করতেই পারে না।
আব্বা ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমিও বিশ্বাস করতে পারি না মানুষ ভার্সিটির বড় ডিগ্রী নিয়েও গ্রামের স্কুলে এসে পরে থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে সেটা মিথ্যা তো হবে না । আর এইসব ভয়ঙ্কর কাজ গুলা নরম মনের মানুষরাই করে ফেলে , কঠিন মনের মানুষরা পারে না ।
আমি একজন কঠিন মনের মানুষ, কিন্তু আমি কাউকে খুন করতে পারবো না। বুঝতে পারছো?
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন । আমি মাথা নামাই খাবার প্লেটের দিকে । আমার মা যখন আত্মহত্যা করেন তখন আমার বয়স পাচ । আব্বার সাথে ঝগড়া চলছিলো বেশ কিছুদিন থেকেই ।
পৌষের সেই দুপুরে আব্বার ডাকেই সবাই এসে লাশ নামায় সিলিং থেকে । আব্বা আবার বিয়ে করেছিলেন এর মাত্র একমাস পরেই । সেই মহিলা এক মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে একসপ্তাহ পর নিজেও মারা যান ।
সামনা সামনি কেউ বলবে না কারন সেই সাহস কারো নাই , কিন্তু এটা সত্যি যে অনেকেই বিশ্বাস করে আব্বাই মাকে মেরে ফেলেছেন । আব্বার ভয় এই দলে হয়তো আমিও পরি ।
আমি প্লেটে ভাতের দলা ভাঙ্গতে থাকি ।
ভেবেছিলাম সারা স্কুল থমথমে হয়ে আছে বিশুর খুন হওয়া এবং টিপলুর খুনি হওয়া নিয়ে । বাইক থেকে নেমে ক্লাস পর্যন্ত যেতে যেতে বুঝলাম আংশিক সঠিক আমি । সারা স্কুল ঠিকই থমথমে হয়ে আছে বিশুর খুন হওয়া এবং টিপলুর খুনি হওয়া নিয়ে, কিন্তু সাথে আরেকটা সম্ভাবনার কথাও মুখে মুখে ফিরছে, দাশু কবিরাজের জিন ।
টেস্ট পরীহ্মার্থিদের ক্লাস আলাদা ।
আমি ক্লাসে ঢুকতেই দুতিনজন চুপ করে গেলো । টিপলুর বন্ধু বলতে শুধু আমি ই , আমাকে দেখে কথা বন্ধ করার তাই একটাই মানে । আমি চুপচাপ এককোনে গিয়ে ব্যাগ খুলতে থাকি । শিহাব এগিয়ে আসে, টিপলুর সাথে তোর যোগাযোগ হয়েছে ?
- না।
- তোর কি মনে হয় ? ওর মতো তাল পাতার সেপাই বিশু গুন্ডাকে মারতে পারবে?
- কহ্মনোই না ।
শিহাব ঘুরলো বাকি জটলাটার দিকে, শুনলি? লিখে রাখ , আমি বলে দিলাম এটা দাশু কবিরাজের জিনটাই । প্রতি বছর একটা করে বাচ্চা মারে না জিনটা?
- কিন্ত সেগুলাতো বাচ্চা। জিনটা কখনো এর আগে বড় ছেলেদের মেরেছে?
শিহাব লাফিয়ে ওঠে , কেনো গতবছর জিনটা আমাকে মারার চেষ্টা করে নাই? বল , মিথ্যা বললাম ?
আমাদের মধ্যে একমাত্র শিহাবই দাবি করে জিনটাকে স্বচহ্মে দেখার । গত বছর এক সন্ধ্যায় জিনটা নাকি ওকে ধরার চেষ্টা করছিলো । কোনোমতে সে প্রান বাচিয়ে পালায় ।
তবে সে সারাহ্মনই মিথ্যা বলে তাই কেউ তাকে সিরিয়াসলি নেয় না।
আমি রুম থেকে বের হতে হতে শুনি শিহাব বলছে, প্রতিটা বাচ্চাকে যেমন কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রেখে যায় জিনটা প্রতি বছর , বিশুর লাশটাও তেমনি ছিলো । আগেরদিন বাজারে মারামারিটা না হলে সবাই তো জিনটার কথাই বলতো ।
পুরো দিনটাই গেলো নানা আগডুম বাগডুম শুনে ।
ক্লাস কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয় ।
হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে আমি আমার ঘরের দিকে রওনা হলাম । মুল বাড়িটা থেকে একটু বাইরের দিকে আমি থাকি । ফুপুরা বলে জায়গীরের ঘর কিন্তু একটু নিরিবিলি ই আমার পছন্দ । আমার টেবিল উপচানো থাকে ছোট বড় বয়ামে, যাতে নানা রকমের ক্যামিক্যাল ভর্তি । এর সবই গত তিন চার বছরে সংগ্রহ করা ।
বেশ কিছু ছোট চাচার দেয়া, যখন ও দেখলো আমারও সায়েন্সে ওরই মত তুমুল আগ্রহ ।
ছোট চাচার ধারনা ভুল , আমার সায়েন্সে আগ্রহ ওর মত না।
ওর থেকে অনেক বেশি।
দরজায় আমি সবসময়ই তালা দিয়ে রাখি । আমার জিনিস অন্য কেউ ছোবে এটা ভাবতেই অসহ্য লাগে ।
‘পরাগ..’
ঘরের সামনের হাসনা হেনার ঝোপ থেকে নিজের নাম শুনতে পাওয়াটা যেকোনো সন্ধ্যাতেই ভৌতিক মনে হতো, কিন্তু আজ হলো না । কবিকে আমি ওখানেই এখন আশা করছিলাম ।
আসেপাশে তাকিয়ে নিয়ে দরজা একটু ফাক করে আমি দাড়ালাম । চিকন শরীর নিয়ে টিপলুর ঢুকতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো ।
খাওয়ার কিছু আছে নাকি ? হ্মুধায় মরতেছি ।
আমি বিস্কিটের ডিব্বা এগিয়ে দেই । কই ছিলি সারাদিন ?
জঙ্গলে জঙ্গলে । কবি হামলে পরে বিস্কিট খেতে থাকে ।
পানি কই , পানি?
পানি খেয়ে সে আমার খাটেই শুয়ে পরে ।
আহ , সারাদিনে খাওয়া বলতে শুধু হাজিদের জঙ্গলের আমড়া ।
তয় কষ্ট হইলেও কয়েকটা কবিতা লিখছি একদম সুপার । খাতা কলম দে ।
টেবিলে আছে, নিয়ে নে ।
আমার একটা স্টাফ করা কাক আছে, ছোট চাচা ইন্ডিয়া থেকে এনেছিলো । আমি ওটার পালক থেকে ধুলা ঝাড়তে লাগলাম ।
লিখতে গিয়ে কবি আবার থেমে গেলো, পরাগ ।
বল ।
আমি বিশুকে মারি নাই।
হুম ।
হুম মানে ? তুই বিশ্বাস করলি না?
বিশ্বাস করলাম ।
লিখতে গিয়ে কবি আবার থেমে গেলো, পরাগ ।
বল ।
আমি বিশুকে মারি নাই।
হুম ।
হুম মানে ? তুই বিশ্বাস করলি না?
বিশ্বাস করলাম ।
গুড । আমি কাউকে খুন করতে পারি, বল ?
আমি কিছু না বলে হাতের কাজে মন দেই ।
কবি কলম নিতে গিয়ে কলম স্ট্যান্ডটাই ফেলে দিলো নিচে । ঝুকে তুলতে গিয়ে খাটের নিচে চোখ পরলো ।
তোর খাটের নিচে কিসের বস্তা রে ?
উত্তর দিতে পাচ সেকেন্ড দেরী হলো ।
পুরোনো বই ।
ও বস্তাটা টেনে বাইরে আনতে লাগলো, বই নারে, ছুরি তো !
আমি কাকটাকে ছেড়ে চেয়ার ঘুরিয়ে বসলাম , কিছু বললাম না ।
কোরবানির গরু কাটার ছুরি? ভিতরে এইটা কি?
পলিস্টারের একটা ছোট ব্যাগ বের করলো ।
আমি নিশ্বাস ফেললাম , ফরমালডিহাইডের দ্রবনে রাখা হৃদপিন্ড ।
কি ?? কিসের এইটা ? গরুর ?
নাহ ।
তাইলে ?
টেবিল থেকে আমি একটা ক্যামিক্যালের বোতল নিলাম হাতে ।
পরাগ বল না আমাকে এইটা কিসের হৃদপিন্ড ?
খাটের কাছে এসে বসে খাতাটা হাতে নিলাম ।
এইটা বিশুর হৃদপিন্ড ।
টিপলু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে ।
আমি ওর ঘাড়ে হাত রেখে বললাম, তুই তো জানিস আমার মা মারা যায় অনেক ছোট বেলায় ।
কবির গলা দিয়ে ঘরঘর একটা শব্দ বের হলো শুধু ।
মার ঘর আর আমার ঘর ছিলো পাশাপাশি । কাজের লোক গুলাকে হ্মেতে পাঠিয়ে দিয়ে মা যখন দুপুরে হঠাৎ ঘরে খিল দিলো , আমি তখন আমার ঘরে খাতায় একাএকা ছবি আকছিলাম । অদ্ভুত একটানা একটা শব্দ শুনে মার ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি ভেতর থেকে বন্ধ । দরজার ফাক দিয়ে তাকিয়ে দেখি মা সিলিং থেকে ঝুলছেন ।
আমি আতঙ্কে ঠান্ডা হয়ে গেলাম প্রথমে । কোনো চিত্কার করতে পারলাম না। জানিনা এভাবে কতহ্মন বসেছিলাম , তারপর হঠাৎ ভয়টা কেটে গেলো । আমার মৃত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার আমার মাঝে একটা কৌতুহলের সৃষ্টি হলো । মরে গেলে মানুষের সব অঙ্গ প্রতঙ্গই কি অচল হয়ে যায় ? বাইরে থেকে যেগুলোকে দেখা যায় ? আর যেগুলোকে দেখা যায় না? কেমন লাগতে পারে একটা সত্যিকারের মস্তিস্ক দেখতে? বা হৃদপিন্ড ?
প্রচন্ড কৌতুহলে আমি ছটফট করতে থাকি।
আমি ঠিক করলাম মায়ের শরীরটা কেটে দেখতে হবে । দরজা খুলে আমি যাবো এসময়ই বাবা এসে ঘরে ঢোকে । চিত্কার, কান্না, আগরবাতি , জানাজা ।
পরের একসপ্তাহ আমি কেবলই অস্থির হয়ে থাকলাম । সবাই ভাবলো মায়ের মৃত্যুশোক ।
আসলে মায়ের কথা আমার তখন মনেই নেই । শুধু ভাবছি কিভাবে কোনো জ্যান্ত মানুষের ভেতরের প্রতঙ্গগুলো দেখা যায় ?
ভরদুপুরে তখন দেখলাম মুকুলের আড়াই বছরের ছোট ভাইটা একাএকা খেলতেছে । চকলেট দেখাতেই চলে আসলো আমার রুমে ....।
টিপলু থরথর করে কাপছে । হার্ট এট্যাক করবে নাকি? করলে খারাপ হয় না, হার্ট এট্যাকের কথাও বইতে পড়েছি।
হার্ট এট্যাক হওয়া হৃদপিন্ড দেখতে কেমন হবে কে জানে, ভেবেই আমার আনন্দ হতে থাকে । একটু পরেই দেখতে পাবো ।
প্রথমটা খুব আনাঢ়ির মতো হয়েছিলো । এখন ভাবলে অবাক লাগে আমি ধরা পড়িনি কেনো ভেবে । এরপর আস্তে আস্তে দহ্ম হয়েছি ।
এই যে দেখ বিশুর ব্যাপারটাই, ওকে টার্গেট করেছি প্রায় তিন মাস আগে । এতো সাহস ব্যাটার , নিশ্চয়ই ওর হৃদপিন্ডটা খুব ইন্টারেস্টিং কিছু হবে । ওকে ফলো করে করে প্ল্যান করলাম কিভাবে বাগে আনতে হবে । শক্তিতে ওর সাথে পারবো না, কিন্তু সায়েন্সে পারবো । এই ক্যামিক্যালটা দিয়ে সহজেই যে কাউকে অজ্ঞান করা যায় , তার আগে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার জংলার ভেতরের পুরোনো ঘরটায় নেয়া ।
ব্যাস ।
টিপলু চিত্কার করতে চায় সম্ভবত । অকারন চেষ্টা । আমি ওকে সেই বিস্কিটই খেতে দিয়েছি যা বিশুকে দিয়েছিলাম । টপিকাল এনেসথেসিয়া মেশানো আছে, ওর জিহ্বা যথেষ্ঠ পরিমান সময়ের জন্য অসাঢ় হয়ে গেছে , শরীরও খুব দুর্বল এতোহ্মনে ।
দেখ সবাই জানে তুই খুন করেছিস বিশুকে । পালিয়েও গেছিস তারপর । তুই ফিরে না এলে কারও কোনো মাথামাথা ব্যাথা হবে না। এই সুযোগ আমি কেনো নষ্ট করবো বল ? তোর ব্রেইনটা আমার কেটে দেখার ইচ্ছে ছিলো অনেক দিন থেকেই, কেনো এতো ভিতু তুই, আর কবিতাই বা লিখিস কি করে দেখা দরকার ।
কথায় ভুলিয়ে রেখে টিপলুর একেবারে সম্মোহিত করে ফেলেছি ।
এবার চটকরে হাতের ক্লোরোফর্মের শিশিটা ওর নাকে চেপে ধরতে হবে যাতে দ্রুত অজ্ঞান হয়ে যায় । কতো বার করেছি এটা, একেবারে পেশাদার হয়ে গেছি এখন ।
টিপলুর নাকের কাছে যখন বোতলটা নেবো, চোখের কোণে রুপালী ঝলকানি দেখলাম । কিন্তু ততহ্মনে দেরী হহয়ে গেলো । বোধহয় অবশিষ্ট পুরো শক্তি দিয়েই টিপলু আমার গলায় ছুরিটা বসিয়ে দিলো ।
বস্তাটা ছেড়ে দিলেও ছুরিটা যে ছাড়ে নি সেটা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে । নিজের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে দেখে আমার অকল্পনীয় এক অনুভুতি হচ্ছে , আমি আমার রক্তে হাত ভিজিয়ে হটাৎ হেসে উঠতে চাই । স্বরনালী কাটা থাকায় কোনো শব্দ তৈরী হয় না । টিপলু আতঙ্কে নীল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ।
আধঘন্টা পরে ।
পরাগের রুম থেকে বেড়িয়ে টিপলু প্রানপনে ছুটতে থাকে । কিশোরটি জানে না সে ভুলে তার নিজের নাম লিখা কবিতার খাতাটি ফেলে এসেছে পরাগের লাশের পাশে । যে ছুরি দিয়ে পরাগ বিশুকে খুন করেছিলো এবং মাত্রই নিজে খুন হলো তাতে এখন কেবল টিপলুরই হাতের ছাপ ।
কতদুর ছুটবে সে ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।