নাম ছিলনা স্বপ্ন গুলোর........প্রতিবিম্বিত অবয়ব তাড়িয়ে বেড়ায় নিজেকে।
দুর্বার ও অসীম সম্ভাবনাময় তারুণ্যের উর্দির নিচে যদি যৌবনের মেঘলুপ্ত সূর্য লুকায়িত থাকতে পারে, তাহলে কোমলমতি শিশুদের উর্দির নিচে কি লুকায়িত থাকতে পারে? নিশ্চয়ই সেই সূর্যের উৎপত্তিস্থল শিশুরাই। কেননা যৌবনে পদার্পনের জন্য শৈশবের ক্ষণটুকু পার হওয়া চাই। কোন গাছই ততক্ষণ পর্যন্ত ফল দিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে পরিচর্যা না করা হবে। তাই বলে কি ফল পাবার আশায় শুধুমাত্র চারা বা ছোটবৃক্ষ থাকা অবস্থায় যত্ন করলেই হবে, নাকি বীজ বপন করেই যত্ন শুরু করতে হবে? বীজ বপনকালীন সময়টাই সর্বশ্রেষ্ঠ যত্ন করার সময়।
অন্যথায় ভাল চারা বা গাছ আশা করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে একটি ছোট আকৃতির গাছ অনেকটা হেয় যত্নের মাঝেই বেড়ে উঠতে পারে কিন্তু যত্ন ব্যতীত কোন বীজ কি চারায় পরিণত হতে পারে?
এর অর্থ এই যে, যৌবন বয়সে এসে তরুণেরা অনেকটাই নিজেকে সামলে রাখতে পারে, সেই সময় তারা এতটা যত্নের বা ভালবাসার কাঙাল নয়; যতটা তারা শিশু বয়সে ছিল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তরুণেরা কোন প্রকার গাইড লাইন ছাড়াই মানুষ হয়ে যাবে, কারণ যৌবন বয়সটাই হচ্ছে আবেগের সময়, এ অবস্থায় আবেগতাড়িত হয়ে অনেক ভূল পথেই তারা পা বাড়াতে পারে, তাই অভিভাবকহীন তারুণ্য অনেক সময়েই অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তবে তা মাঝে মাঝে, খুব কম বেলাতেই এরকমটা ঘটে। কিন্তু শিশুকাল; যখন তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবার বয়স অতিক্রম করে, তখন তাদের গাইড লাইনের প্রয়োজন কতটুকু?
শৈশবের লালিত্যকে অতিক্রম করেই যেহেতু যৌবনে পা রাখতে হয়, সুতরাং যৌবনের ভাল বা মন্দ কাজকর্ম, উভয় ক্ষেত্রেই শৈশবের শিক্ষার প্রভাব থাকে।
একটি বালক তখনই তারুণ্য শক্তির সঠিক প্রয়োগ করতে পারবে যখন সে শিশুকালে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। আমাদের দেশে শিশু থাকাকালীন সময়ে একটি শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক যতটুকু শিক্ষা যেভাবে পাওয়া দরকার, তার কতটুকু তারা পায়, এ ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।
বর্তমানে শিক্ষিত ও যান্ত্রিক নগরীর জীবনধারায় সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রত্যয়ে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই বাহিরে কাজ করতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাদের সন্তানকে পাঁচ কিংবা ছয় বছর বয়সেই স্কুলে ভর্তি হবার জন্য এক প্রকার অমানুষিক যুদ্ধে জয়ী হতে হয়। সুতরাং, যে পড়া তারা স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে উঠে পড়ার কথা, তা তারা বাসায় বাবা মা কর্তৃক নিয়োগকৃত সস্তা গৃহ-শিক্ষক দ্বারা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে গলধঃকরণ করে এবঙ পরীক্ষার হলে গিয়ে যেই বালক বা বালিকাটি গৃহিত বিদ্যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলন করতে পারে, সেই আপাতত এই যুদ্ধে জয়ী হয় অর্থাৎ সেই স্কুলের সেই সোনার হরিণরূপী সিটটি পেয়ে যায়।
অনেকটা পেট পুরে খেয়ে বমি করার মতো অবস্থা। যেই ঠিকমত বমি করতে পেরেছে তো সফল হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তারা একটি বা দু'টি বই মুখস্ত করছে তাও আবার নিজের বাবা বা মায়ের কাছে অত্যন্ত আদরের সাথে খেলাচ্ছলে নয়, রীতিমত শিক্ষকের বেতের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে। এর ফলে একদিকে যেমন শিশুমনের বিকাশ না ঘটে তাদের মনটি বা বিকশিত চিন্তা ভাবনাগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তারা জীবনের শুরু থেকেই হয়ে পড়ছে বই কেন্দ্রীক বা মুখস্ত বিদ্যায় নির্ভরশীল। পরোক্ষভাবে যে বয়সে তারা বাবা মার ভালবাসায় খেলাচ্ছলে প্রাকৃতিক শিক্ষা গ্রহণ করবে, সেখানে তারা বেতের জোরে শিক্ষকের পড়া গলধঃকরণ করছে।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মা-বাবার সাথে সন্তানের পারস্পরিক হৃদ্যতা ও সম্প্রীতি বাধাগ্রস্থ হচেছ এবং বাবা-মার প্রতি তাদের যে দায়িত্ববোধ ভবিষ্যতে পালন করতে হবে এবং যে কারনে পালন করতে হবে, তা তাদের চিন্তার বাহিরেই থেকে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শিশু যেমন বাবা মার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে বাবা-মাও অনাগত ভবিষ্যতে তার সন্তানের প্রাপ্য ভালবাসা ও অন্যান্য সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে মনের অজান্তেই প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিন্তু এরূপ অনাকাঙ্খিত মুহূর্তের জন্য কারা দায়ী? অভিভাবক নাকি সন্তান? আমার মতে শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরাই দায়ী। অভিভাবকরা তাদের যান্ত্রিক ও ব্যস্ত জীবন যাপন এর দরুণ অথবা ছেলে-মেয়েকে উন্নত শিক্ষা ও স্বাচ্ছন্দময় জীবন উপহার দেবার উচ্চ আশার বশবর্তী হয়ে টাকার পেছনে দিন রাত ছুটছে। ছেলেকে ভাল একটি স্কুলে ভর্তি করে, বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে, তার দৈনন্দিন উচ্চ চাহিদাগুলো টাকার জোরে সহজভাবে পূরণ করে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে এবং ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।
তারা ভেবেই নিয়েছে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে ভাল একটি অবস্থানে ছেলে বা মেয়ে পৌঁছাতে পারলেই আমাদের কষ্ট শেষ। ওরাই আমাদের দেখবে। আর এতটুকু সুখ পাবার আশাতেই তাদের এত শ্রম, এত সাধনা। আমি এটাকে হীন চোখে দেখছি না। প্রত্যেক বাবা-মা-ই চায় তার সন্তান মানুষ হবে এবং তাদের বার্ধক্যকালীন অসহায় মুহূর্তগুলোতে দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
কিন্তু বাবা-মায়েরা যখন বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তানের মুখাপেক্ষী হবেন তখন সন্তানও যে টাকার পেছনে ছুটতে থাকবে। খুব বেশী হলে সন্তান টাকার জোরে প্রয়োজনে বাবা-মার দেখাশুনার জন্য বাসায় নার্স রেখে দিবে। কিন্তু এতে কি বাবা-মার চাহিদা মিটবে? বাবা-মাতো তার সন্তানকে কাছে চায়। কিন্তু সন্তানই বা কি করবে? টাকার পেছনে দৌড়ে টাকার বলে সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার শিক্ষা তো সে বাবা-মার কাছ থেকেই পেয়েছে। সেখানে তো ভালবাসার, পারষ্পরিক স্নেহের জন্য কোন সময়ই ছিলনা।
আমি একে অর্থের কাছে হৃদয়ের বলিদান বা স্বপ্নের কাছে হৃদয়ের বলিদান ছাড়া অন্য কোন নামে অভিহিত করতে পারছি না।
আমি এতক্ষণ যা বললাম, তার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল। তা হল আমাদের বর্তমান সমাজের চিত্রটা একটু আমাদেরই সামনে তুলে ধরা। জীবনে যদি অর্থের দ্বারাই সব পাওয়া যেত, তাহলে প্রেম-ভালবাসা স্নেহ বলে কিছু থাকতো না। অর্থ দ্বারা ইট আর পাথরের সুউচ্চ দালান এবং সহস্রাধিক ঘর তোলা যায়, কিন্তু অর্থের দ্বারা হৃদয়ের ভালবাসার একটি কক্ষও গড়া যায় না।
ভালবাসার প্রতিদানই একমাত্র ভালবাসা, মমতার প্রতিদানই একমাত্র মমতা।
শিশুদের শৈশবকালে একমাত্র বন্দনা, যা সে নিজেও হয়তো উপলব্ধি করতে পারে না, তা হল বাবা-মার সান্নিধ্য। তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। এতে হয়তো সে মুখস্ত বিদ্যার জোরে ভাল কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, কিন্তু বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশির সিক্ত কচি ঘাসের বুকের উপর খানিকক্ষণ হেঁটে, তাদের সাথে মনের সকল অব্যক্ত ভাষা শেয়ার করে, তাদের যে মানসিক ও প্রাকৃতিক বিকাশ ঘটবে, তা কোন কিছুর মূল্যেই মূল্যায়ন করা যাবে না। আমি ভাল প্রতিষ্ঠান হতে বিদ্যা গ্রহণের বিপক্ষে কথা বলছি না,সমাজে চলতে হলে তা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু যে বিদ্যা মানুষের মধ্য হতে সুপ্ত প্রতিভাগুলো কেড়ে নেয়, যে বিদ্যা রক্ত মাংসের মানুষকে এক জড় পাথরে পরিনত করে তোলে, যে বিদ্যা মানুষের হৃদয়ের সহমর্মিতাগুলোকে অর্ধমৃত করে ফেলে; সেই বিদ্যার ঘোর বিরোধিতা আমি করছি, অবশ্যই করছি।
মানুষের শিশুকালের যে বন্দনা, তারুণ্যে এসে তা আর থাকে না। আবার বৃদ্ধ বয়সে আরেক রকম বন্দনা। কিন্তু যাই হোক মানুষ ভালাবাসারই কাঙাল। যে সময়ে যেটা প্রয়োজন সেই সময়ে সেটা পেতে হলে অবশ্যই স্বাভাবিকভাবেই সকল আচরণ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে, পারষ্পরিক সম্প্রীতি ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে আজ যে শিশু প্রকৃত শিক্ষার আলোকে বেড়ে উঠবে, কাল সে যৌবনে পদাচরণ করবে সাথে সাথে তার ঘুমন্ত, নির্জীব প্রতিভাগুলো বিকশিত হবে, এগিয়ে যাবে সে সামনের দিকে সমাজ প্রগতি ও নতুন স্বপ্নময় মুক্তজীবনের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে সে জীবন-ধারণের জন্য মৌলিক চাহিদাগুলোতো পূরণ করবেই, পাশাপাশি পারিপারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ সম্পর্কে জ্ঞাত হবে এবং মমতা ও ভালবাসার এক অনবদ্য সমন্বয়ে গড়ে তুলবে নিজেকে, অলঙ্কৃত করবে পরিবারকে এবং গৌরবান্বিত করবে দেশ ও জাতিকে।
আসুন, ইট-পাথরের পাষাণ প্রাচীর থেকে বের হয়ে সন্তানকে ভালবাসা, মায়া, মমতার বাঁধনের মধ্যে রেখে এমন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করি, যে শিক্ষার মাধ্যমে ফুল ফুটতে গিয়েও ঝরে পড়বে না, যে শিক্ষায় মূল হবে অন্তরাত্নার স্ফুর্তি এবং ফল হবে আনন্দদায়ক, যে শিক্ষার বলে অন্তরের গহীন প্রদেশ থেকে উৎসারিত ভালবাসায় সকলে হবে সিক্ত, যে শিক্ষায় মানবাত্না খেলা করবে সর্বত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।