আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংসারের খাতিরে

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ।

আমার বউয়ের কাছে প্রতি রাতে, নির্দিষ্ট একটা সময়ে ফোন আসে। নিঝুম রাত, ফোন আসার জন্য খুব খারাপ সময়।

এমন সময়ে ফোন আসা মানেই খারাপ কিছু। যদি পরিচিত কেউ হয়, ধরে নিতে হবে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে, আর অপরিচিত কেউ হলে ধরে নিতে হবে “খুব সন্দেহজনক” কিছু ঘটছে। দিনের পর দিন পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে তো সন্দেহটা আরও চাগিয়ে ওঠে। আমারও উঠেছে। প্রথমবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কে।

সে শুধু বলেছে “বন্ধু। “ আমি তো শুনে প্রায় তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠেছিলাম, জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম প্রায়, বন্ধু? এত রাতে? কে সেই বন্ধু যে এত রাতে রোজ তোমাকে ফোন করে? মেয়েবন্ধু, না ছেলে? উত্তর যদি ছেলেবন্ধু হয়, তাহলে “কেন?” কিন্তু তাই কি হয়? এসব জিজ্ঞেস করলে এক সেকেন্ডে সংসারে ফাটল ধরে যেতে পারতো, স্ত্রী ভেবে বসতো আমি ওকে সন্দেহ করছি। তাই বিশ্বস্ত স্ত্রীর বিশ্বস্ত স্বামীর মতো পাশ ফিরে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। কান দুটো তো আর বন্ধ করে রাখতে পারি না, কাজেই শুনতে লাগলাম সে কী কী বলে। মৃদু, আদুরে গলায় সে বলছিল, “আমারও তোমাকে খুব মনে পড়ে, মিস করি”।

আমি তো শুনে বিছানা থেকে পড়ে যাই আরকি। অ্যাঁ? পিলে চমকানো এক একটা বাক্য। না জানি কী হচ্ছে, লাইনের ওপাশে না জানি কে আছে। বন্ধু মানে কি শুধুই বন্ধু? নাকি ওর পুরনো প্রেমিক? পরকীয়া নয় তো? কে হতে পারে? আমার বন্ধু শাহেদের সাথে এককালে ওর পরিচয় হয়েছিল, ওর সাথে আবার ... ...। কেন এত খিলখিল হাসি? কী বলছে ওপাশের লোকটা? একশো একটা হতচ্ছাড়া প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।

প্রশ্নগুলো অবশ্য মনের ভেতরেই রেখে দিই। না না, আমি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত নই মোটেই। সন্দেহজনক কিছু দেখবো অথচ আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন উঁকি দেবে না, এটা তো অস্বাভাবিক। ধোঁয়া দেখলে কি মানুষ আগুন আছে কীনা জিজ্ঞেস করবে না? একদিন স্ত্রীর ল্যাপটপ খোলা ছিল। ফেসবুক ওপেন করে একটু সরে গেছিল।

আমি একটু মুখ ঘোরাতেই দেখি, কোন এক অচেনা পুরুষের সাথে চ্যাট করছে। কে সেই পুরুষ, জিজ্ঞেস করার জন্য পেটের ভেতর বড় ভুটভাট করতে লাগলো, কিন্তু কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। সংসারের ক্ষতি হবে, কাজ নেই বাপু। সংসারের সুখের খাতিরে, বাচ্চাকাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। অন্তত ভান করতে হয় যে আমি তোমাকে খুব বিশ্বাস করি, দুনিয়া উল্টে গেলেও তুমি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না ইত্যাদি।

আরে খারাপ ভাবছেন কেন? আমি কি শুধু একাই এমন করি? আমার স্ত্রীও তো আমাকে সন্দেহ করে, কিন্তু সংসারের খাতিরে কিছু বলে না। সেদিন যখন আমার ফোনটা নিয়ে বিল্ডিং ভাঙার গেমটা খেলছিল, তখনই “মৌটুসি” নামটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। আমি ফোনটা নিয়ে কথা বলে শেষ করতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মৌটুসি কে? আমি বললাম, বন্ধু। সে আর কিছু বলল না, আবার বিল্ডিং ভাঙায় মন দিলো। কিন্তু পরে দেখলাম, সে এবার মোটেই স্কোর করতে পারছে না, একটা দুটো ব্লক ভাঙতেই টাইম আপ হয়ে যাচ্ছে।

যেকোনো খেলায় ভাল স্কোর করতে হলে পুরো মনোযোগ দিতে হয়। সেটা যখন সে করতে পারছে না তখন অবশ্যই সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে। পুরুষ হলেও আমি বুঝি, স্ত্রী যখন দেখে কোন অচেনা মেয়ের ফোন আসে এবং স্বামী বলে “বন্ধু”, তখন স্ত্রী প্রথমেই কী ভাবতে পারে। আমাকে সে একবারও জিজ্ঞেস করে নি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি, নিঃসন্দেহে ওর মনে এখনো মৌটুসি নামটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বলছে না, হাসিমুখে কথা বলছে, একসাথে বেড়াতে যাচ্ছে, সবকিছুতেই বোঝাচ্ছে যে সে আমাকে খুব বিশ্বাস করে।

আর যে সংসারের জন্য এতকিছু, সে সংসার ঠিকমতই চলছে। চললেই ভাল। এমনকি যেদিন সে আমার অফিসে এসে দেখল, আমি আমার অল্পবয়স্কা সুন্দরী সেক্রেটারির সাথে উচ্চস্বরে হাস্যরসে ব্যস্ত, তখনো কোন উষ্মা প্রকাশ করলো না, বরং নিজেই পরিচিত হল, হেসে হেসে গল্প করলো। বাড়ি ফিরলেও মুখ ঝামটা দিয়ে বলল না, ঐ মেয়ের সাথে তোমার এত মাখামাখি কেন? চব্বিশ ঘণ্টা অভিনয় করে যাচ্ছি রে ভাই, সবই সংসারের খাতিরে। আমরা খুবই সুখী দম্পতি, মোটেই একে অপরকে অবিশ্বাস করি না, প্রবলভাবে ভালোবাসি।

অন্তত পাড়াপড়শি তো তাই বলে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে তো পেটের ভেতর মোচড় দেবেই, কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে মনটা কেমন কেমন করবেই। তবু একটা প্রশ্নও করতে পারছি না, স্বস্তি পেতে পারছি না, পাছে সংসারের ক্ষতি হয়। এদিকে প্রশ্নগুলো জমে থেকে থেকে পচে দুর্গন্ধ হয়ে উঠেছে। আমরা দু’জন নিশ্চয়ই খুব ভাল অভিনেতা-অভিনেত্রী, দুর্গন্ধ নিয়েই দিনের পর দিন হাসিমুখ করে বসে আছি! হয়তো প্রশ্নগুলো মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধুই মানুষের সহজাত সন্দেহ।

হয়তো রাতের বেলায় ওর কাছে যার ফোন আসে, সে শুধুই বন্ধু। “তোমাকে খুব মনে পড়ে, মিস করি” কথাগুলো হয়তো সে বন্ধুকেই বলেছে, প্রেমিককে বলে নি। হয়তো সে ফেসবুকে যে অচেনা পুরুষটির সাথে চ্যাট করে, তার সাথে আমার স্ত্রীর অন্য কোন সম্পর্ক নেই। হয়তো মৌটুসি নামের মেয়েটাকে সন্দেহ করা অমূলক। হয়তো আমি সেক্রেটারি মেয়েটার সাথে মোটেই মাখামাখি করছি না, সেদিনের হাসাহাসি ছিল নিতান্ত মামুলী কারণেই।

তারপরও, “তুমি অন্য কাউকে ভালবাসছ না তো? কারো সাথে তোমার মন দেয়া-নেয়া চলছে না তো? তুমি শুধুই আমার তো, নাকি অন্য কেউ এসে ভাগ বসিয়েছে?” জাতীয় অতি ভয়ংকর প্রশ্নগুলো সংসারের ক্ষতির ভয় ছাড়াই যদি করে ফেলে হালকা হওয়া যেত, কতই না ভাল হত। আমি-আমার স্ত্রী দু’জনই জানি উত্তর হয়তো সবগুলোই “না” হবে। কিন্তু ঐ “হয়তো”-টা নিয়েই তো যত সমস্যা। মানুষ তো আর অন্তর্যামী নয় যে হতচ্ছাড়া “হয়তো” থেকে ছাড়ান পাবে। (১৭ আগস্ট, ২০১৩)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.