লেখিকা :মাসুদা সুলতানা (রুমী)
১ম পর্ব
* ইসলাম পূর্বযুগে পুরুষঃ-
ইসলাম পূর্বযুগটাকে বলা হয় জাহেলিয়াতের যুগ। সে যুগে চুরি, ডাকাতি, মারামারি, লুটতরাজ, অত্যাচার, অবিচার, ব্যাভিচার, জুয়া, মদ্যপান, নারী হরণ, শিশুহত্যা প্রভৃতি যতো রকমের খারাবী-বদমাশী, পাপ ও দূর্নীতি থাকতে পারে তৎকালিন পুরুষ চরিত্রে তার একটারও অভাব ছিল না। তারা যেনো অমানুষ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কে পশুর মতো বললে পশুকেও বুঝি অপমান করা হবে। কারণ খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া কোনো পশু অন্য প্রাণী হত্যা করে না।
অথচ এদের মধ্যে ছিল না কোনো প্রকার নীতি নৈতিকতা। স্বার্থপরতা আর গোত্র প্রীতিই ছিল এদের চালিকা শক্তি।
* মানুষ নয় পুরুষঃ মানুষের গুণাবলী এদের মধ্যে তখন ছিলনা। এরা যেনো মানুষ নয় অন্য কোনো প্রজাতি হয়ে গিয়েছিলো। যার নাম পুরুষ।
এদের অত্যাচারের আওতা থেকে কেউ বাদ যেতো না। জোর যার মুল্লুক তার এই ছিলো তাদের মূল মন্ত্র। দুর্বলের উপর অত্যাচার করাই ছিল গৌরবের ব্যাপার। নারী, শিশু, ক্রীতদাস, দাসী, গরীব এবং অপরিচিত লোকজন ছিল এদের অত্যাচারের লীলাভূমি। নারীকে ওরা মানুষ হিসাবে মনেই করতনা।
সে মা হোক, কন্যা হোক, বোন হোক কিংবা স্ত্রী হোক।
* সব পুরুষের একই চেহারাঃ- সব পুরুষই প্রায় একই রকম ছিলো। সে যখন পিতা তখন কন্যা সন্তান হত্যা করা তার নৈতিক দায়িত্ব। যখন সে ভাই, তখন বোনকে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা কিংবা বেশি সমস্যা হলে বিক্রি করে দেওয়া তার ইচ্ছার ব্যাপার। আর যখন সে স্বামী তখন তো স্ত্রীর উপর তার পূর্ণ মালিকানা।
ইচ্ছা করলে রাখতে পারে, বিক্রি করতে পারে, কিছুদিন অন্য পুরুষের কাছে বন্ধক রাখতে পারে। জুয়ায় বাজি ধরতে পারে, অন্য কিছুর বিনিময়ে বদল ও করতে া কিংবা মেরেও ফেলতে পারে।
দুর্বল শ্রেণীর মানুষদের এরা গরু ছাগলের মতো হাটে বাজারে বিক্রি করতো এদের জন্য নুন্যতম সহানুভূতি এই পুরুষদের হৃদয়ে ছিল না। প্রেম ভালোবাসা এদের অন্তর থেকে নির্বাসন নিয়েছিল।
* সব শেয়ালের একই রা ঃÑ একি শুধু আরবে? না এই অবস্থা বিরাজ করছিল পৃথিবীর প্রতিটি দেশে দেশে।
পুরুষ কোথাও উপরোক্ত চিত্রের চেয়ে উন্নত ছিল না। বরং আরও নোংরা আর মূর্খ আরও জাহেল ছিল অন্যান্য দেশের পুরুষ নামের প্রাণীগুলো।
* পঁচা ডোবায় ডুবন্ত ছিল পুরুষঃ অত্যাচার আর নোংরামীর কাঁদায় থিক থিক করছিল পৃথিবী। আর এই পঁচা পাঁকে আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিল পুরুষ। নৈতিক চরিত্র বলতে কিছু ছিলো না এদের।
মান সম্মান ইজ্জত বলতেও কিছু বুঝত না। এরা জানত শুধু
উদর পূর্তি আর অনৈতিক ফুর্তি।
এতে কে সর্বসান্ত হলো আর নির্যাতিত হলো এসব দেখার কোনো বিষয় তাদের ছিলো না। আল্লাহর ভয়, আখেরাতের জবাব দিহীতা এসব কিছুই তাদের মধ্যে ছিলো না।
এই থিক থিকে কাঁদার মধ্যেই ফুটল একটি শতদল।
যার সৌরভে মৌতাত হয়ে গেলো পৃথিবী। পুতি গন্ধময় সমাজ পুতপবিত্র হয়ে গেলো।
* রাসূল সাঃ এর আবির্ভাবঃ
রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটবর্তী হয়। আর তাই বুঝি ইসলাম রবি আগমনের পূর্ব মুহূর্তে পুরুষ ডুবে গিয়েছিল অজ্ঞতা, দুশ্চরিত্রতা, প্রতিহিংসা আর খারাবির গভীর অন্ধকারে। ইসলামের আবির্ভাবে সবকিছুর সাথে পুরুষের হৃদয় ও আলোকিত হলো।
সেই আলোতে পুরুষ তার নিজের ভূল ত্রুটিগুলো দেখতে পেলো।
* অন্ধকুপ থেকে উদ্ধারঃ অজ্ঞানতার অন্ধকুপ থেকে উদ্ধার পেলো পুরুষ। পুরুষ তার মাকে চিনতে পারলো। ইসলাম তাকে শেখালো “মায়ের পায়ের নিচে সব পুরুষের জান্নাত। ” তাকে জানালো পুরুষ ও নারী পরস্পরের ভূষণ।
“সন্তানের উপর মাতার হক পিতার চেয়ে তিনগুন অধিক। নারীর উপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে পুরুষের উপরও নারীরও তেমনি অধিকার আছে। “পিতা যদি তিন, কিংবা দুই কিংবা একটি কন্যা সন্তানও স্বস্নেহে বড় করে তোলেন আখেরাতে সেই পিতা নবী (সঃ) এর অতি নিকটবর্তী হবেন। সে জানল “পুরুষ উত্তম কি অধম, মানুষ কি অমানুষ সে ব্যাপারে তার স্ত্রীর বক্তব্যই চুড়ান্ত। দাস দাসী হলো তার ভাই বোন কিংবা সন্তান সন্ততির মতো।
সে দিক নির্দেশনা পেলো “ নিজে যা খাবে দাস দাসীদেরকেও তাই খেতে দেবে। নিজে যা পরবে দাস দাসীদেরও তাই পরতে দেবে। অতিরিক্ত কাজের চাপ তার উপর দেবে না। জুলুম করবে না, মারবে না। ” বলা হলো ‘ যে ঈমানদার ব্যক্তি কোনো ক্ষুধার্ত ঈমানদার ব্যক্তিকে খাদ্যদান করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বেহেশতের ফল খাওয়াবেন।
যে মুমিন ব্যক্তি কোনো তৃষ্ণার্ত মুমিন ব্যক্তিকে পানি পান করায় কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সীল মোহর করা খাঁটি “আর রাহীকুল মাখতুম” পান করাবেন। যে মুমিন ব্যক্তি কোনো বস্ত্রহীন মুমিন ব্যক্তিকে পরিধেয় বস্ত্র দান করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বেহেশতের সবুজ পোশাক পরাবেন। ”
এইভাবে বিভিন্ন শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা পেয়ে পুরুষ নিজের স্বার্থের চেয়ে অপরের প্রতি বেশি দায়িত্ববান হয়ে গেলো।
* পুরুষ এবার মানুষ হলোঃ আশরাফুল মাখলুক বা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছিলেন। আদম সন্তান সেই সম্মান হারিয়ে ফেলে মানুষ নামের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো।
ইসলাম তাকে নতুন করে মানুষ করল। প্রেম প্রীতি, ভালোবাসা, দায়িত্বনুভূতি উদারতা পরোপকার, বদান্যতা সব গুণের সমাবেশ ঘটাল তার মধ্যে।
দাহিয়া কালবীর মত ব্যক্তি যে সত্তরটিরও অধিক নিষ্পাপ কন্যা শিশুকে হত্যা করে গৌরব বোধ করেছে। সেই দাহিয়া কালবী কান্নায় ভেংগে পড়েছে। তার কাজের অমানবিকতা ও পাপ বুঝতে পেরে।
ওমর ইবনে খাত্তাবের মতো লোক যে রাসূল (সাঃ) কে হত্যার নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিলো সেই ওমর ইবনে খাত্তাব হলেন হযরত ওমর (রাঃ) মুসলিম দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা।
* জ্ঞানে গুণে সমৃদ্ধঃ- সেই মদখোর, মাতাল, অত্যাচারী খুনী পুরুষেরা যেনো যাদুমন্ত্র গুণে রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেলো। তারা হলেন অতিথি বৎসল, সংযমী, পরোপকারী, দাতা, ধীশক্তি সম্পন্ন, আত্মত্যাগী, আত্মপ্রত্যয়ী, দয়ালু এবং আল্লাহর রঙে রঞ্জিত মহা মানব। জাফর ইবনে আবু তালিবের ভাষায় “আমরা ছিলাম অজ্ঞ জাতি, আমরা মূর্তিপুজা করতাম, মৃত জন্তুর গোশত খেতাম এবং অমানবিক ও খারাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম। আমরা নিকট আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা ও দুর্ব্যবহার করতাম।
এবং আমাদের মধ্যে যে সবল সে দুর্বলের হক আত্মসাৎ করত।
এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা আমাদের কাছে আমাদের মধ্য থেকেই এক ব্যক্তিকে নবী করে পাঠালেন। আমরা তাকে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও সত্যবাদী বলে জানি এবং বিশ্বস্ত ও সচ্চরিত্র রূপে তাকে দেখেছি। তিনি আমাদের একমাত্র আল্লাহর এবাদত করার ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করার আহবান জানালেন। আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য যে সব বস্তু তথা পাথর ও মূর্তি ইত্যাদির পূজা করতাম তা ছাড়তে বললেন।
তিনি সত্য কথা বলা, আমানত রক্ষা করা, আত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করা, প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং নিষিদ্ধ কাজ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকার আদেশ দিলেন। তিনি আমাদের কুরুচিপূর্ণ কাজ করতে, মিথ্যা বলতে, ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করতে ও নিরাপরাধ নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করতে নিষেধ করলেন। ”
উপর্যুক্ত কথা গুলো হয়রত জাফর তাইয়ার ইবনে আবু তালিব আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীকে বলেছিলেন। উপর্যুক্ত কথা গুলোর মধ্যে ইসলাম পূর্বযুগ এবং পরবর্তী যুগের পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
* পিতা ভ্রাতা সাথী ও সন্তানঃ- ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে পুরুষ আর অত্যাচারী থাকল না।
সে হলো স্নেহশীল পিতা, দায়িত্ববান ভ্রাতা। হলো হৃদয়বান সাথী, আদর্শ সন্তান।
পিতা, পুত্র সন্তানের চেয়ে অধিক যত্নে লালন করতে লাগলো কন্যা সন্তানটিকে। শিক্ষা দীক্ষায় উপযুক্ত করে তাকে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির অংশীদার করে বিয়ে দিল উত্তম পাত্রে। আর ভাই-এর দায়িত্বের নমুনা দেখে তো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেলো--।
রাসূল (সঃ) নব বিবাহিত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন। জাবির কুমারি বিয়ে করেছ না বিধবা করেছ? জাবির (রাঃ) উত্তর দিলেন ‘বিধবা বিয়ে করেছি। ’ রাসূল (সাঃ) বললেন ‘বিধবা করলে কেন? কুমারি মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে। জাবির বললেন, “আমার মা ছোট ছোট কয়েক টি কন্যা সন্তান রেখে মারা গেছেন। আমি ওদের বয়সী একটি মেয়ে কে বিয়ে করে আনা পছন্দ করলাম না।
আমি এমন একজন মহিলাকে এনেছি যে ওদের দেখাশুনা করতে পারবে। চুল বেঁধে দিতে পারবে এবং শিক্ষা দিতে পারবে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি) (চলবে.....)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।