বিশ্বায়ন এবং আকাশ সংস্কৃতির দাপটেই পৃথিবীর ছোট বড়ো অনেক ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর কয়টি দেশ তাদের নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারবে সে প্রশ্ন আজ বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বায়নের আদর্শগত ক্রিয়াকলাপ বিশ্বের সংস্কৃতির বলয়ে এমন এক অসহায়ত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে চায়, যাতে প্রত্যেকেরই মনে হবে, বিশ্বায়নের বিকল্প বুঝি সত্যিই কিছু নাই। বিশ্বায়নের আগ্রাসনের সামনে বড় বড় জাতি ও দেশগুলিও অসহায়ভাবে স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
ইংরেজি 'Globalization এর বাংলা পরিভাষা বিশ্বায়ন। এর আরবী আওলামা। অর্থনীতি ও ব্যবসা সংক্রান্ত স্কুলের তাত্তি্বকদের মতে, Globalization can be defined as the activities of multinational enterprises engaged in foreign direct investment and the development of business networks to create value across national borders.
এন্থনীয় গিডিংস (Anthony Giddings) এর মতে, Globalization is political, technical and cultural, as wella economic, Globalization is new and revolutionary and is mainly due to the ‘massive increase’ in financial foreign exchange transactions. This has been facilitated by dynamic improvement n communications technology especially electronic interchange facilitated by personal computers.
Alan Rugman বলেছেন, word ‘Globalization is much abused and presents a problem for scholars aeross the social sciences who define it from the viewpoint of their own discipline.
J.A. Camelleri এর মতে,Nevertheless, the process of globalization is a striking barometer of the states increasingly restricted freedom of action in management of economic activity. The growth international institutions points to a significant, it little advertises delegation of state authority.
আবেদা সুলতানার মতে, বিশ্বায়ন হল এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে উৎপাদন পুঁজির গতিশীলতা, প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবাধ বাণিজ্য ও মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সকল দেশের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়।
ড. মো. আজিজুর রহমানের মতে, বিশ্বায়ন হলো সমগ্র বিশ্বে অবাধ বাণিজ্য সংস্থা গড়ে তোলা। এককথায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী একটি বাজার গড়ে তোলা।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক সকল প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটানো। ব্যাপক অর্থে সমগ্র বিশ্ববাসীকে নিয়ে একটি বিশ্বসমাজ গড়ে তোলা।
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে পুঁজিবাদেরই নতুন, আচ্ছাদন, পুঁজিবাদ যা বিশ্বে বাজার খোঁজে এবং পুঁজি লগি্ন করে। এতকাল তারা কাজটা করতো সাম্রাজ্যবাদী কায়দায়। যেখানে জবরদস্তি থাকতো।
জবরদস্তি এখনও আছে। কিন্তু এখন তাকে বিশ্বায়ন নাম দিয়ে বেশ ভদ্রগোছের চেহারা দেয়া হয়েছে। যেন সবাই এক বিশ্বের অংশ; ছোট বড় নেই। এখন আর ঔপনিবেশ স্থাপনের ঝুট ঝামেলা নেই। তথ্য প্রযুক্তি রয়েছে।
আছে বিজ্ঞাপন। ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা।
এম. কনফুসিয়াসের মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে ট্যান্সন্যাশনালিজম। এ পলিসিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশের 'অধীনতা নীতি' বলা যায় না।
ড. মনযের কাহাফের মতে, বিশ্বায়ন বর্তমান পৃথিবীর একটি অতি সামপ্রতিক প্রপঞ্চ।
সমগ্র পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কতর্ৃত্ব হাতে তুলে নেয়ার জন্য কৌশলী পাশ্চাত্য এ ধরনের শ্লোগান মুখে তুলে নিয়েছে। সহজ কথায় সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটা সমাজের বাসিন্দা। ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বিষয় পর্যন্ত সব ব্যাপারেই সবাইকে একই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এটি সাম্রাজ্যবাদের সামপ্রতিকতম অস্ত্র।
প্রফেসর ড. খুরশীদ আহমদের মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের একটি কৌশল।
আর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বড় মোড়ল হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশটি বিশ্বায়নের যে ফর্মুলা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাতে ইসলাম ধর্মকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবুল আসাদ বিশ্বায়নকে 'Hegemonistic centralization আধিপত্যবাদী এককেন্দ্রীকরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্বায়ন নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদের পরিশীলিত বিকল্প শব্দ। বিশ্বায়ন একটি পদ্ধতিগত কর্মকৌশল।
প্রকৃত অর্থে এককেন্দ্রীকরণের একটি অপকৌশল।
ড. মাহাথির মোহাম্মদের মতে, বিশ্বায়ন হচ্ছে এমন একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বিশ্বের সকল দেশকে একটি অভিন্ন সত্তার আওতায় নিয়ে আসা। দরিদ্র দেশগুলোর বাজার দখল ও তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করাই এর লক্ষ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বিশ্বায়নের কারনে বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যহীনতা ও অসাম্য বেড়েছে। ধনী দেশগুলোর প্রভাব বেশি বলে এমনটি হয়েছে।
প্রফেসর ড. মোজাফফর আহমদ বলেন, বিশ্বায়নের ফলে উন্নত বিশ্ব তাদের পণ্যের বাজার সমপ্রসারণ করেছে। বাণিজ্যের বিশ্বায়নের বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে। আধুনিক বাণিজ্য তত্ত্বের আলোকে অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন এবং লার্নার পরিপূর্ণ উপকরণ দান সমতার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিশ্বায়ন বাস্তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যরত দেশসমূহের মধ্যে উপকরণদাম সমান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অমর্ত্যসেন বলেছেন, বিশ্বায়ন এখনো বিতর্কিত বিষয়।
আজকের বিশ্ব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হলেও একই সাথে সর্বগ্রাসী বঞ্চনা এবং নিদারুণ বৈষম্যও চলেছে।
বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে উন্নয়নশীর দেশে শিল্প কারখানার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের নয়াব্যবস্থা হওয়া তো দূরের কথা তাদের যে কর্মসংস্থান আছে তাও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের নাম করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) প্রভাব খাটিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে শাসন করছে। বিশ্বায়নের কোনো শর্ত (Conditions) বা ঘটনা (Phenomenon) নয়।
এ এমন এক প্রক্রিয়া (Process) যা বহুদিন ধরে ঘটে চলছে। বিশ্বায়ন (Globalization) তো প্রকৃতপক্ষে নবোদিত বিপজ্জনক কোনো বিষয় নয়। হাজার হাজার বছর আগে থেকে বিশ্বের এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অভিযান চলে আসছে নানাভাবে-পর্যটন, বিদেশে গমন, আমদানি-রফতানি ব্যবসা, সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার; বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ অন্যান্য উন্নত শিক্ষায় বিনিময় ব্যবস্থা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে।
বিশ্বায়নের সার্বজনীনতা কিন্তু শুধুমাত্র সার্বিক বাজার গড়ে তোলার ভেতরেই সীমাবদ্ধ, সেই বাজার বা পৃথিবীর সমস্ত বস্তুকে বদলিয়ে দিতে পারে। সমস্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পণ্যে পরিণত করতে পারে এবং সেই পণ্যকে ক্ষুদ্র স্থানীয় ও বৃহৎ বিশ্ববাজারে বিক্রি করে দিতে পারে।
জাতীয় ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং বিশ্বায়নের সংস্কৃতির মধ্যে কিছু কিছু মৌলিক বৈপরীত্য আছে। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে এক ছাঁচে ঢেলে নিতে চায়। যদিও প্রাচীন সাংস্কৃতিক শৈলীগুলির মূল ধর্মই ছিল বহুধা বিভক্ত বৈচিত্রে সমৃদ্ধ সুসংহত আঞ্চলিক ঐতিহ্যের প্রতীক। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বিশ্বায়ন যে ধরনের চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে সুচিন্তিত সুপরিকল্পিত সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগে গ্রহণ করা প্রয়াজন। সর্বস্তরে সচেতনতা, উপযুক্ত কর্মপ্রয়াস জোরদারের কোনো বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।