ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কযুক্ত হলেও অবিচ্ছেদ্য নয়। বাংলা সংস্কৃতি লালন করেও ইংরেজিতে কথা বলা যেতে পারে। ভাষা তুলনামূলকভাবে কম বদলায়, সংস্কৃতি দ্রুত বদলায়। সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় পরিবেশগত ভিন্নতার কারনে, প্রয়োজনীয়তার কারনে। ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে।
ভাষার ক্রিয়া হচ্ছে পরিবেশনা। ভাষা অর্থ তৈরির মধ্য দিয়ে পরিবেশন করে। ভাষার অর্থ নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে গুরুত্বের সাথে সম্পৃক্ত সমাজ সংস্কৃতি। সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ককে ভাষা নির্মাণ এবং পুন:নির্মাণ করে। ভাষা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং কথা বলা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক চর্চা।
ভাষা সংস্কৃতি ও সমাজভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। ভাষা মানুষের সংস্কৃতি ও ভাব প্রকাশ করে। আর হঁ্যা,দ সংস্কৃতির অন্যান্য অংশের মতো ভাষা এক দিক দিয়ে যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত বা সুস্থিত। অন্যদিক দিয়ে তা পরিবর্তনশীল।
বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর দারুণভাবে পারছে।
নৈশক্লাবে পানাহার, নাচগান ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার যে দীর্ঘদিনের পশ্চিমা রেওয়াজ তা এ অঞ্চলেও মিডিয়ার কল্যাণে চলে আসছে। মা-বাবা, ভাই- বোন, পরিজন নিয়ে গঠিত একান্নবর্তী পরিবারের ধারণাও ভ্রুকুটির বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এককালে যে জারি-সারি-ভাটিয়ালি-মুর্শিদি-ভাওয়াইয়া গান ছিল আমাদের আপামর জনগণের প্রাণস্বরূপ। যে পদযাত্রা, পুঁথিপাঠ ও গাজীর পট ছিল নিত্যদিনের সাংস্কৃতিক আকর্ষণ, যেগুলোর আজ বিলুপ্ত প্রায়, বিশেষ করে বৈদু্যতিক প্রচার মাধ্যম তথা আকাশ সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও আগ্রাসনের ফলে। এই একই প্রক্রিয়ায় আজ পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানাদির সাথে পাল্লা দিয়ে মহাসমারোহে, কখনো কখনো অত্যান্ত দৃষ্টিকটুভাবে, আয়োজিত হচ্ছে থার্টি ফার্স্ট নাইট-এর বিদেশি স্টাইলের অনুষ্ঠান।
ফলে দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির দুর্বিষহ বিকৃতি ও মর্মান্তিক অবক্ষয়ের, শিক্ষা চিকিৎসা সাংবাদিকতা রাজনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি প্রায় সব ক্ষেত্রে এক সর্বনাশা অপসংস্কৃতি বিস্তারের আশঙ্কা ও আর্তনাদ।
তথ্যের অর্থকরী পণ্যে পরিণত হওয়া এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ার প্রবণতা বিশ্বসংস্কৃতির উপর বিশ্বায়নের প্রভাবকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্যান নেডারভীন (ঔধহ ঘবফবৎাববহ) মনে করেন বিশ্বায়ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি সংকর সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে। তিনি এর নাম দিয়েছেন 'তৃতীয় সংস্কৃতি'। অনেকেই আবার স্থানীয় সংস্কৃতির মান অবনয়ন ও অস্তিত্বের সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এই উদ্বেগ অযৌক্তিক নয়। জয়বীর (ঔধুধবিবৎধ) এর মতে, নয়া যোগাযোগ প্রযুক্তি থেকে যে সামাজিক সম্পর্ক উদ্ভূত হয় তা গোটা বিশ্বকে ক্রমান্বয়ে একটি একক প্রধান অর্থনীতি, একক সরকার ব্যবস্থা এবং একক সংস্কৃতিকে সংহত করে। '৪৩ এই একক সংস্কৃতি স্থানীয় সংস্কৃতির পৃথক বৈশিষ্ট্য ও জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রতি অসংবেদনশীল, কৃত্রিম ও অগভীর। কারন সংস্কৃতির মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জনগণের আচার-আচরণ জীবনধারার প্রতিফলন ঘটানো তা এই সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিনোদন ও যৌনতা নির্ভর এই সংস্কৃতির এই ধারা প্রায় সর্বাংশেই উন্নত থেকে স্বল্পোন্নত দেশের দিকে ধাবিত।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএন ডি পি) ১৯৯৯ সালের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে 'হলিউডের ফিল্ম ও ৩ হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। কেবল টাইটানিক ছবিটি ব্যবসা করে ১ শ ৮০ কোটি ডলার। ' যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ফর্বস জানিয়েছে পর্নোগ্রাফি এখন ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ব বাণিজ্য।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ম্যাগাজিন, ভিডিও, সিডি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজলভ্যতা অপসংস্কৃতির বিস্তারকে আশঙ্কাজনকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে। বিশেষত, এশীয় দেশগুলোর সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও এ অঞ্চলকে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক পণ্য বিস্তারের উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে।
সিনেমার পাশাপাশি পশ্চিমা সঙ্গীত ও এশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পশ্চিমা পপদলগুলোর বিশ্বসফর কর্মসূচিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত ক্রমবর্ধমানহারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। স্থানীয় সংস্কৃতির উপর এগুলোর প্রভাব অনায়াসে লক্ষণীয়। সিনেমাগুলোতে সহিংসতা ও যৌনতার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সঙ্গীত রচনায় পশ্চিমা ঢং অনুকরণ এ অঞ্চলের দেশগুলোর অভিন্ন প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। উপগ্রহ সমপ্রচার ব্যবস্থার বিস্তার এই প্রক্রিয়াকে আরো বেগমান করেছে।
উপগ্রহের মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুর সাথে স্থানীয় মূল্যবোধের প্রত্যক্ষ সংঘাত অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। বাংলাদেশে টিভি সিঙ্, টিভি ফোর, ফ্যাশন টিভি, এম সি এম প্রভৃতি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক নেতিবাচক লেখালেখির পর এগুলোর প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়।
দেশজ সংস্কৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়ন পাশ্চাত্যের আদর্শভিত্তিক সর্বজনীন সংস্কৃতির যে ধারাটির পৃষ্ঠপোষকতা করছে আমাদের দেশজ মূল্যবোধ ও রীতিনীতির সাথে তার ব্যবধান বিশাল। সে সংস্কৃতি অবিমিশ্রভাবে জনপ্রিয়তা না পাওয়ায় বর্তমানে 'ফিউশন' (ভঁংরড়হ) সংস্কৃতি নামে এক উদ্ভট সাংস্কৃতিক ফর্ম তৈরি করা হয়েছে।
দেশজ ও পশ্চিমা সংস্কৃতির কিছু বিচ্ছিন্ন উপাদানকে অসুষমভাবে মিশ্রিত করে তৈরি হয়েছে এই অগভীর সংস্কৃতি। অতিমাত্রায় পশ্চিমা স্টাইল ও বাদ্যযন্ত্র নির্ভর সঙ্গীত, অপরাধ ও যৌনতা নির্ভর সোপ অপেরা ও চলচ্চিত্র, চটুল বিনোদননির্ভর হালকা পত্রপত্রিকা, পোশাক প্রসাধনে পাশ্চাত্য প্রভাব-এগুলোর সামপ্রতিক জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে বিশ্বায়িত ভোক্তা সংস্কৃতির ক্রম-আগ্রাসী প্রকৃতিরই পরিচায়ক। ভাষা মানুষের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা সংস্কৃতির প্রধান মাধ্যম ও বাহন। তাই সংস্কৃতির মতোই বিশ্বায়নে সৃষ্ট বাস্তবতার বাইরে নয় বাংলা ভাষা।
পরিশেষে বরা যায়, কোনো জাতি সংস্কৃতিহীন হয়ে পড়েছে বললে এতটুকুই বোঝা যায়। সে স্মৃতিহীন হয়ে পড়েছে। তার গর্বিত হবার বা লজ্জিত হবার কিছু নেই। কর্মী হবার সক্রিয় হবার কোনো প্রেরণা নেই, তার পরিচয় কিছু নেই। বিশ্বায়নের যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বায়নের থাবায় বিশ্ব-মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকেও আক্রমণ করেছে।
সংস্কৃতিকে পরিণত করেছে এক বিশাল মুনাফা অর্জনকারী শিল্পে। ভোগবাদপ্রবণ পণ্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠায় মারাত্মক (ংবৎরড়ঁংষু) দেখা দিয়েছে। বাড়ছে আত্ম সর্বস্বতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও জনবিচ্ছিন্নতা। মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যগুলোর সুষ্ঠু ও সুস্থ বিকাশের পক্ষে অন্তরায়।
বিশ্বায়ন সংস্কৃতির স্বাধীন অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না। মানুষের স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ও সৃজনশীলতারও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের ব্যবসাই চলছে এখন বিনোদন বা এন্টারটেইনমেন্ট এবং ইনফরমেশন টেকনোলজিকে কেন্দ্র করে। এর মাধ্যমে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে ক্রেতা, তেমনি বিশ্ব বাণিজ্যও হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত। ভাষাতাত্তি্বকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত প্রায় ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ইংরেজির আগ্রাসনে এই শতাব্দীতে প্রায় অর্ধেকই অব্যবহার্য হয়ে যাবে।
এমনকি ধ্বংস হয়ে যাবে ভাষা বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা। ঐদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষ্টি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে হটিয়ে বিশ্বপুঁজির স্বার্থে সৃষ্টি করা হচ্ছে লোভাতুর বিকৃত বাজারের। বিশ্বায়নের ফলে নারী পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বাভাবিক সম্পর্ক আর টিকে থাকছে না। মানবিক মূল্যবোধ ভেঙ্গে যান্ত্রিক রূপ নিচ্ছে। প্রবৃত্তি আর যন্ত্রের কাছে হেরে যাচ্ছে মানুষ।
বিশ্বায়ন যে বাজারি সংস্কৃতি তৈরি করছে, সেই সংস্কৃতিতে ব্যক্তির পরিচয় থাকে না। এই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির যথাযথ সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।