আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হলুদ সাংবাদিকতা, মিডিয়া দানব ও সিটিজেন কেন

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

হলুদ সাংবাদিকতা ও মিডিয়া দানবের সহাবস্থান সাধারণত আজকের যুগে চোখে পড়েনা। আজ হলুদ সাংবাদিকতা অপেশাদারী ও পশ্চাদমুখী বলে বিবেচিত। মিথ্যাচার, অতিরঞ্জন, বানোয়াট সংবাদ হলো হলুদ সাংবাদিকতার লক্ষণ। কিন্তু অনেক অনেক মিডিয়া আউটলেটের মালিকানা যার হাতে, সেই মিডিয়া দানবের সংবাদ-ভবনগুলো থেকে যে সাংবাদিকতা পরিবেশন করা হয় তা 'পেশাদারী'’। তাতেও মিছে কথা থাকতে পারে, থাকতে পারে মালিক-মতাদর্শ-শ্রেণীর পক্ষপাতমূলক সংবাদ, কিন্তু তা ধরতে পারবে, এমন সাধ্য আছে কার? কারণ তার বহিরঙ্গে আছে পেশাদারিত্বের ছাপ।

অনেক অনেক চর্চা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে এই অর্জন। এই দুয়ের পার্থক্য অনেক। যৌনকর্মীর কড়া-অমার্জিত-অতিরঙিন মেক-আপ আর বিউটিশিয়ানের হরেক ব্রাশের মোলায়েম পরশে মডেলকন্যার ত্বকের স্তরে মিশে থাকা সহনীয় মেক-আপের যে-বিরাট পার্থক্য -- হলুদ আর পেশাদারী সাংবাদিকতার পার্থক্য ততখানিই। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে এই দুইয়ের সম্মিলন ঘটেছিল মার্কিন নাগরিক উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে। তিনি হলুদ সাংবাদিকতার জনক, আবার তার ছিল এক মিডিয়া কনগ্লোমারেট।

এই হার্স্টের জীবনীভিত্তিক যে-চলচ্চিত্র, তার নাম সিটিজেন কেন, পরিচালক অরসন ওয়েলস। তবে হার্স্ট ছবিটি একেবারেই পছন্দ করেননি। ১৯৪১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি অস্কারে নয়টি মনোনয়ন পেলেও কেবল চিত্রনাট্যের জন্যই শেষপর্যন্ত পুরস্কার পায়। অনুমান করা হয় এতে হার্স্টের হাত ছিল। যদিও সিটিজেন কেন-এ হার্স্ট ছাড়াও সমকালীন আরও কয়েকজন ধনকুবেরের জীবনের খণ্ডাংশ এবং পরিচালকের নিজের জীবনেরও কিছু অংশ যুক্ত ছিল, কিন্তু হার্স্টের জীবনের সঙ্গে মূল চরিত্র চার্লস ফস্টার কেনের অনেক মিল রয়েছে।

এতেই ক্ষুব্ধ হন হার্স্ট। তিনি তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের কোনো হাউসেই যেন এই ছবির বিজ্ঞাপন, রিভিউ এমনকি নামোল্লেখ পর্যন্ত না হয়, তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর প্রভাব পুরো হলিউডে পড়ে। হার্স্টের লবিংয়ে প্রভাবিত হয়ে পুরো ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার-এর প্রধান লুইস বি মেয়ার সিটিজেন কেন-এর প্রযোজক আরকেও-র কাছে প্রস্তাব দেন যে, ৮০৫,০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ছবির সবগুলো প্রিন্ট যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু প্রযোজন প্রতিষ্ঠানটি তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

অবশ্য হার্স্টের প্রভাবের কারণে ছবিটির ব্যবসা একদমই ভালো হয়নি। অনেক প্রদর্শক ছবিটি চালাতে চায়নি মিডিয়া-মোগল হার্স্টের প্রতিপত্তির ডরে। এসব কারণে হার্স্ট এবং ওয়েলসের বিবাদ চরমে উঠে, যা দু’জনেরই ক্যারিয়ারে ক্ষতিসাধন করে। বেতার-ব্যক্তিত্ব ওয়েলস তার প্রথম ছবি সিটিজেন কেন নির্মাণ করেন মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে, মূল চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। তার পরের ছবিগুলো ওরকম বিখ্যাত আর হয়নি।

তবে হার্স্ট তো আর ওয়েলসের সঙ্গেই কেবল বিবাদ করেননি। তিনি তার মিডিয়া-মালিকানার প্রথম দিককার পত্রিকা দি নিউইয়র্ক জার্নাল নিয়ে জোসেফ পুলিৎজারের পত্রিকা নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে প্রচারসংখ্যা টপকে যাবার জন্য এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। পুলিৎজারের পত্রিকা তখন নিউইয়র্কে প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে অবস্থান করছিল। তাকে অতিক্রম করার জন্য হার্স্ট নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ভাগিয়ে নিয়ে আসেন তার পত্রিকায়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন রিচার্ড এফ আউটকল্ট।

আউটকল্ট পুলিৎজারের পত্রিকায় একটি কমিক সিরিজ করতেন, যাতে হলুদরঙা, রাত্রিবাস পরিধান করা, একটি ন্যাড়া-মাথা ছোকরা, প্রধান চরিত্র ছিল। এর ডাকনাম ছিল ‘ইয়োলো কিড’। আউটকল্ট ভেগে যাবার পরে পুলিৎজার অন্য আরেকজনকে দিয়ে তার পত্রিকায় কমিক সিরিজটি চালিয়ে যান। ফলে নিউইয়র্ক শহরে দু’টি হলুদ ছোকরাকে দেখা গেল -- একটি নিউইয়র্ক জার্নাল-এ, আরেকটি নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড-এ। আর পত্রিকা দুটোতে চাঞ্চল্যকর, অপরাধমূলক, যৌনতানির্ভর সংবাদের পরিমাণ বেড়ে গেল।

মূল বিষয় হলো এসব সংবাদ ছিল অতিরঞ্জিত, কখনো কখনো বানোয়াট। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে হলুদ সাংবাদিকতার উদ্ভব হলো, এভাবে। উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট আর চার্লস ফস্টার কেনের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই ছিল বেশি। উভয়েই মিডিয়া মোগল ছিলেন (চলচ্চিত্রেও কেনের ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতার রেফারেন্স আছে), দু'বার বিয়ে করেন (উভয়েরই একজন স্ত্রী ছিলেন অপেরা গায়িকা), ধনে-সম্পদে ফুলে-ফেঁপে পরে রাজনীতিতে নামেন, গভর্নর পদে নির্বাচন করেন -- প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে স্পেনের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধের ব্যাপারে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। বড়ো পার্থক্য এটাই, ছবি শুরু হয় চার্লস ফস্টার কেনের মৃত্যুসংবাদ দিয়ে, আর হার্স্ট ছবির মুক্তি পাবার ১০ বছর পরে ১৯৫১ সালে মারা যান।

সিটিজেন কেন প্রাথমিকভাবে ব্যবসাসফল না হলেও, যত সময় গিয়েছে, এটি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে ক্রমেই প্রিয় চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এটা সবসময়ই প্রথম ১০-এর মধ্যে থাকে, কোনো কোনো চলচ্চিত্র-বোদ্ধার তালিকায় এটা এক নম্বরেই আছে। প্রথম আসনটি নিয়ে সিটিজেন কেন-এর সাধারণত লড়াই হয় সের্গেই আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন ও আলফ্রেড হিচককের ভার্টিগোর সঙ্গে। ফিল্ম স্কুলগুলোতে সিটিজেন কেন অবশ্যপাঠ্য। কারণ এর ন্যারেটিভ কাঠামো, চলচ্চিত্র-ভাষা থেকে শুরু করে মেক-আপের ব্যবহার পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু সিটিজেন কেন আজও সিনেমাটোগ্রাফি, আলোকসম্পাত, সম্পাদনা, মিজ-অঁ-সেন ও ডেপথ অব ফিল্ডের টেক্সট হিসেবে পাঠ্য। চলচ্চিত্র-টেকনিকের আকর হলেও, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদেরও এই ছবিটি দেখা দরকার। অবশ্য কেনের সাংবাদিক-জীবনের চাইতে তার ব্যক্তিজীবনই ছবিতে প্রধান হয়ে উঠেছে। যাহোক, এই নিবন্ধের পরবর্তী আলোচনা অরসন ওয়েলসের চলচ্চিত্র সিটিজেন কেন এবং চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র চার্লস ফস্টার কেনকে নিয়েই এগুবো।

ছবি শুরু হয় ধনকুবের চার্লস ফস্টার কেনের প্রাসাদোপম এস্টেট জানাডু-এর কয়েকটি ডিজলভ শট দিয়ে, যার একটিতে দেখা যায় এস্টেটের মূল গেটে ‘নো ট্রেসপাসিং’ সাইনবোর্ড। এরপর বিশাল অট্টালিকার একটি ঘরে নিঃসঙ্গ-বৃদ্ধ কেনের মৃত্যুদৃশ্য। মৃত্যুমুহূর্তে তিনি উচ্চারণ করেন ‘রোজবাড’। এরপরে বিখ্যাত এই ব্যক্তির ওপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়, কোনো এক অপরিসর মিলনায়তনে। প্রামাণ্যচিত্রে সংক্ষেপে কেনের মিডিয়া সাম্রাজ্য-প্রতিপত্তি ও তার পতনের বর্ণনা থাকে।

কিন্তু প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনশেষে দর্শকরা (যারা মূলত সাংবাদিক) আলোচনা করেন, কেনের মৃত্যুমুহূর্তে উচ্চারিত শব্দ ‘রোজবাড’-এর মানে কী, তা নিয়ে। নিউজরিল রিপোর্টার জেরি থম্পসনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ‘রোজবাড’ কী বা কে তা অনুসন্ধানের জন্য। জেরি থম্পসন এরপর চার্লসের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিতে আমেরিকার নানা প্রান্তে যান। ঐসব ব্যক্তিদের বর্ণনার মাধ্যমেই আসলে ছবির মূল কাহিনী এগিয়ে যায়, ফ্লাশব্যাকে। অবশ্য থম্পসন ‘রোজবাড’ কী বা কে তা বের করতে ব্যর্থ হন।

তার উপসংহার ছিল, ‘রোজবাড’ এমন কিছু যা মহাক্ষমতাধর চার্লসের খুব প্রিয়, কিন্তু তিনি তাকে পাননি বা পেয়ে হারিয়েছেন। নানা জনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কেন জন্মলাভ করেন আমেরিকার কলোরাডোয় এক দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা-মা একটি বোর্ডিং চালাতেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাদের বোর্ডিং হাউসের নিচে আবিষ্কৃত হয় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম সোনার খনি। খনি-কোম্পানির সঙ্গে কেন-পরিবারের রফা হয় যে শিশু কেনকে উচ্চশিক্ষার জন্য নিউইয়র্কে নেয়া হবে, কোম্পানির ব্যাংকার ওয়াল্টার পার্কস থ্যাচার হবেন তার অভিভাবক এবং প্রাপ্তবয়ষ্ক হলে, শিক্ষাজীবন শেষে কেন হবেন কোম্পানির একটা অংশের মালিক, বিনিময়ে তার মা সোনার খনি থেকে সরে যাবেন।

কেন ২৫ বছর বয়সে থ্যাচারের কাছ থেকে কেবল নিউইয়র্ক ইনকোয়ারার পত্রিকার দায়িত্ব নেন, বাকি সবকিছুকে অগ্রাহ্য করেন। যেদিন তিনি পত্রিকার দায়িত্ব নেন, সেদিন পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল ২৬ হাজার। তিনি হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে পত্রিকার সার্কুলেশন ৬ লাখ ৮৪ হাজার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি প্রতিপক্ষ পত্রিকা নিউইয়র্ক ক্রনিকল থেকে অনেক সাংবাদিক ভাগিয়ে আনেন। এরপর গড়ে তোলেন তার বিশাল মিডিয়া-সাম্রাজ্য।

এতে রয়েছে ৩৭টি সংবাদপত্র, ২টি সিন্ডিকেট, একটি রেডিও নেটওয়ার্ক। এছাড়া তার কর্পোরেট মালিকানাধীন ছিল পেপার মিল, গ্রোসারি স্টোর, এপার্টমেন্ট ব্যবসা, শিপিং ব্যবসা, সোনার খনি, বন-জঙ্গলের এস্টেট ইত্যাদি। তিনি প্রথমে বিয়ে করেন প্রেসিডেন্টের ভাগ্নী এমিলি নর্টনকে, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে মাথায় রেখে। রাজনীতিতে নেমে কেন গভর্নর পদে নির্বাচনেও দাঁড়ান। কিন্তু নির্বাচনের আগে বর্তমান গভর্নর জিম ডব্লিউ গেটিস পত্রিকায় প্রকাশ করে দেন যে কেনের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে অ্যামেচার গায়িকা সুসান আলেক্সান্ডারের সাথে।

এতে কেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। রক্ষিতা সুসানকেই তিনি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রী সুসানকে অপেরা গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি উঠেপড়ে লাগেন। বিশাল আয়োজন করেন সুসানকে ঘিরে।

কিন্তু অপেরা গায়িকা হিসেবে সুসান ব্যর্থ হন। তার গায়কীর সমালোচনা করার জন্য কেন তার বহু পুরনো বন্ধু ও ব্যবসায়িক সহচর জেডেডিয়াহ লেল্যান্ডকে চাকরিচ্যুত করেন। সুসানের সঙ্গে কেনের শেষ দিনগুলো কাটে জানাডু প্রসাদে। কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। প্রাসাদের উঁচু খিলান আর দূরবর্তী দেয়ালগুলো তাদের সম্পর্কের ব্যবধানকে মূর্ত করে তোলে।

একাকী প্রাসাদে হাঁপিয়ে উঠে সুসান কেনকে পরিত্যাগ করে চলে যান। সুসানের প্রস্থান কেনকে বিপর্যস্ত ও পরাজিত করে। এদিকে তিরিশের মহামন্দা তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যেও পতন আনে। বিশাল প্রাসাদের তার নিঃসঙ্গ মৃত্যুও বিরাট চরিত্রের করুণ সমাপ্তিকে নির্দেশ করে। তার মৃত্যুর পরে রিপোর্টার থম্পসন ‘রোজবাড’-এর রহস্যের কিনারা করতে না পারলেও, ক্যামেরার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের দর্শক ‘রোজবাড’ কী তা জানতে পারেন।

তার মৃত্যুর পর যখন কেনের যাবতীয় সংগ্রহ নিলামে ওঠে, তখন পরিত্যক্ত অনেক কিছুর সঙ্গে পুড়ে যেতে থাকে গায়ে ‘রোজবাড’ লেখা এক স্লেড। এই স্লেডটি নিয়েই কলোরাডোর বাড়ির আঙ্গিনায় কেন তার শৈশবে খেলতেন যা তিনি আজীবন সংগ্রহে রেখেছিলেন। হয়তো কেনের জন্য সেটাই ছিল তার জীবনের সবচাইতে মধুর সময়। আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মগর্বী এক বিখ্যাত মানুষ ভেতরে ভেতরে যে কতটা অসহায় ছিলেন, মৃত্যুমুহূর্তে উচ্চারিত ‘রোজবাড’ শব্দটিই তার প্রমাণ। সিটিজেন কেন এমন একটি ছবি যা সামান্য অবস্থায় থেকে এক ব্যক্তির বিপুল উত্থান এবং সামান্য হিসেবেই তার জীবনের সমাপ্তির কাহিনী বর্ণনা করে।

তবে এই কাহিনী যেভাবে বর্ণিত হলো, সেটাই ছবিটিকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ছবিটিকে অনন্য করে রেখেছে। গ্রেগ টোল্যান্ডের সিনেমাটোগ্রাফি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রায় পুরো ছবি জুড়েই ডিপ ফোকাসের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। আলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ফোরগ্রাউন্ড ও ব্যাকগ্রাউন্ড উভয়ক্ষেত্রেই সব চরিত্র ও প্রপসকে তীক্ষèভাবে স্পষ্ট করে তুলেছেন। জাঁ রেনোয়ার রুলস অব দ্যা গেম-এর পর সফলভাবে ডিপ ফোকাসের ব্যবহার করেছেন ওয়েলস।

টোল্যান্ড ক্লোজ-আপ শটের ক্ষেত্রে টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করেছিলেন। ডিপ ফোকাসের ব্যবহার: কেনের মা ও ব্যাংকার থ্যাচারের মধ্যে চুক্তি সই হচ্ছে। ঘরের বাইরে, দূরে ‘রোজবাড’-হাতে ক্রীড়ারত শিশু কেন। ফোরগ্রাউন্ড ও ব্যাকগ্রাউন্ড, ফ্রেমে ধারণকৃত সবই স্পষ্ট। ফ্লাশব্যাকের এরকম অসাধারণ ব্যবহার অন্য কোনো ছবিতে এর আগে দেখা যায়নি।

ছবিতে কোনো একক ন্যারেটর কেউ ছিলেন না। কেনের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত জীবনে ঘনিষ্ঠ ৫জন ব্যক্তি এখানে ন্যারেটর, যারা কেন-এর জীবনের নানা অংশের বর্ণনা তারা করেছেন। এমনকি ছবির প্রথম দিকে নিউজরিলের মাধ্যমে তার জীবনের সংক্ষিপ্ত এক বর্ণনা প্রথমেই দিয়ে দেয়া হয়। সম্পাদনা ক্ষেত্রে যদি সময় ও স্থানের ম্যানিপুলেশন একটা বিশেষত্ব হয়ে থাকে, তবে প্রথম স্ত্রী এমিলি নর্টনের সঙ্গে কেনের প্রাতঃরাশের সিকোয়েন্সটি সবসময় উল্লেখ করে থাকেন চলচ্চিত্র-বোদ্ধারা। ৫টি দৃশ্য পরপর কাটের মাধ্যমে মন্তাজের দুর্দান্ত ব্যবহার করা হয়েছে -- দুই মিনিটের সিকোয়েন্সে ১৬ বছর পার করে দেয়া হয়েছে।

কেন ও নর্টনের পোশাক বারবার পাল্টে দেয়া হয়েছে। প্রথম দৃশ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট টেবিলের দুইপাশে দু’জন, অন্তরঙ্গ কথা বলছেন। এরপরের দৃশ্যগুলোতে টেবিলের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। তাদের আলাপচারিতায় উষ্ণতা নেই, বাড়ছে দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ভৌত ও মানসিক উভয় দূরত্বই বাড়ছে।

শেষে তাদের মধ্যে কোনো আলাপই নেই, দু’জনেই সংবাদপত্র পড়ছেন। কেন পড়ছেন নিজের পত্রিকা ইনকোয়ারার আর এমিলি পড়ছেন প্রতিপক্ষ-পত্রিকা ক্রনিকল। অরসন ওয়েলসের ছিল রেডিওতে কাজ করার অভিজ্ঞতা। তাই সিটিজেন কেন-এর সাউন্ডট্র্যাকও অসাধারণ। আর চরিত্রের মেক-আপ তো তুলনাহীন।

২৪ বছর বয়সে ওয়েলস কেন-এর চরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু তাকে তরুণ থেকে বৃদ্ধ, নানা বয়সের মেক-আপে দেখা গেছে। তার জীবনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিকেও একইভাবে নানা বয়সে দেখা গেছে। সবমিলিয়ে সব চরিত্রকে বয়সানুযায়ী চিত্রিত করার ক্ষেত্রে মেক-আপের ব্যবহার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সিটিজেন কেনকে অনন্য করে রেখেছে। বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী অরসন ওয়েলসের অভিনয়ও অনবদ্য।

আর উঁচু উঁচু ছাদ, খিলান ও দেয়ালের মাধ্যমে ঘটনা ও চরিত্রের বিশালতা, অসাহয়ত্ব ও নিঃসঙ্গতার আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা মিজ-অঁ-সেন-এর আদর্শপাঠ হিসেবে চলচ্চিত্র-শিক্ষার্থীদের কাছে অগ্রগণ্য। সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার জন্য এটা আবিষ্কার করা আনন্দের ছিল যে প্রিয়তম চলচ্চিত্র সিটিজেন কেন এমন একজন ব্যক্তির জীবন অবলম্বনে নির্মিত যিনি একজন আদি মিডিয়া-মোগল এবং হলুদ সাংবাদিকতার জন্মদাতা। প্রথম প্রকাশ: খালেদ মুহিউদ্দিন সম্পাদিত 'মিডিয়াওয়াচ' পত্রিকা। ১১ জুলাই, ২০১০ সংখ্যা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।