এক্কেবারে সিনেমার মতোই!
মঞ্চে সিনেমা কিংবা সিনেমার মঞ্চকে নাট্যের আধারে ধরা!
‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’-এর সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘সিনেমার মতো’ দেখে সে রকমই মনে হল। মনে হল, কারণ, প্রযোজনাটি দেখতে দেখতে কীভাবে যেন পর্দা থেকে বাস্তব, আবার বাস্তব থেকে পর্দায় এক অনন্ত পরিক্রমার সাক্ষী থাকা গেল!
গত শতকের বিখ্যাত বা কুখ্যাত সাতের দশকে ‘মিস ক্যালকাটা’ হয়েছিলেন যে তরুণী, এই ২০১৩ সালেও কি তাঁর পরিভ্রমণ শেষ হল? কে জানে? প্রশ্নগুলো সহজ হতে পারে, কিন্তু উত্তর? আর তাই, ‘মিস ক্যালকাটা’ জয়ন্তী ভদ্র যখন ধীরে ধীরে অভিনেত্রী হয়ে উঠলেন, একদা বড় পর্দার অভিনেত্রী থেকে এখনকার মেগা সিরিয়ালের অভিনেত্রী, এই প্রশ্নটাই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল।
‘মিস ক্যালকাটা’ জয়ন্তী নজরে পড়লেন কলকাতার তরুণ ব্যবসায়ী জয়জিৎ দত্তগুপ্তের! এই জয়জিৎ বা জয় এর পরে আরও অনেক বার আসবেন এই নাট্যে। প্রত্যক্ষভাবে না থেকেও অতি প্রবলভাবে মঞ্চ জুড়ে থেকে যাবেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, এই নাটকের নানা চরিত্রের জীবনচর্চায়! জয় মারা যাবেন। ভাগ্য বিপর্যয়ে তাঁদের রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়ি বিক্রি করে বাপের বাড়ি চালতাবাগানে দাদার আশ্রয়ে চলে আসবেন জয়ন্তী, সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে অভিজিৎ ও পৃথ্বীজিৎ।
বড় ছেলে অভিজিৎ জীবনেও ভুলবে না তার বনেদিয়ানা ও বংশকৌলিন্যের কথা! ভুলবে না, সে বিদেশি গাড়ি চড়ে স্কুলে যেত! অথচ, সে ভুলে যাবে ছোট ভাইকে মিনিবাসে চড়িয়ে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার কথা!
মদে চুর হয়ে থাকা অভিজিৎ, অতীতের বৃত্ত থেকে বেরোতে না পারা অভিজিৎ, বাবা জয় দত্তগুপ্তের বনেদিয়ানার মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকা অভিজিৎ, পরম ঘৃণা আর অভিমানে নিজের মাকে ‘মিসেস দত্তগুপ্ত’ বলে ডাকা অভিজিৎ, জয়ন্তীর দ্বিতীয় বারের স্বামী দীপায়নকে ‘স্যাঁকা পাউরুটি’ বলে ব্যঙ্গ করা অভিজিৎ মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ব্রাত্য বসুর এই অভিনয় দেখাটা এক অভিজ্ঞতা!
এক অর্থে অভিজিৎও যেন এই সমাজ-সংসারে এক প্রান্তিক মানুষ হয়ে যায়! অধুনা মুম্বইনিবাসী অভিজিৎকে তার প্রথম স্ত্রী ছেড়ে চলে যায়, পরে উত্তরপ্রদেশের একটি মেয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতে থাকে সে। সেই মেয়েও কিন্তু তাকে ত্যাগ করে! দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক আর জুতোয় নিজেকে মুড়ে ফেলা অভিজিৎ কখন যে প্রান্তিক হয়ে গেল, তা সে নিজেও কি বুঝল?
চেন্নাই-হায়দরাবাদ-মুম্বই ক্রমান্বয়ে পালিয়ে বেড়ায় অভিজিৎ। কী তীব্র মনস্তাত্বিক জটিলতা, নিজের শিকড়ে ফিরতে চাওয়ার কী তীব্র আকুতি ব্রাত্যর অভিনয়ে! জয়ন্তী, তার মা, অভিনেত্রী জয়ন্তী দত্তগুপ্তও তাঁর বড় ছেলেকে নিয়ে যেন এক জটিল আবর্তে পড়ে যান! এক দিকে ছোট ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে গড়া তাঁর সংসার, অন্য দিকে, বখে যাওয়া, সমাজের চোরাস্রোতে ভেসে যাওয়া অভিজিৎ কী যে টানাপোড়েন আর যন্ত্রণা! আর কী যে অসামান্য অভিনয় অনসূয়া মজুমদারের! অত্যন্ত বড় মাপের অভিনেত্রী অনসূয়া। মঞ্চে বা ছোটপর্দায় বারে বারে তাঁর প্রমাণ দিয়েছেন দর্শককুলের কাছে। কিন্তু, এই জয়ন্তী চরিত্র তাঁর অভিনয় জীবনের এক অন্যতম মাইলস্টোন হয়ে থাকবে! আপাত-কাঠিন্যের মধ্যেও বড় ছেলে অভিজিতের জন্য গুমরে গুমরে ওঠা, তার সঙ্গে জয়ন্তীর অস্থির কথোপকথন, জয় দত্তগুপ্তের জীবনের নানা অকথিত কাহিনির উঠে আসা, চোরাবালি মনের সঙ্গে নিরন্তর লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে থাকেন দর্শককুল!
প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই নাট্যের সেট বলতে একটিই।
গোটা নাটকে তার কোনও পরিবর্তন হয় না, অথচ, সেই একটিমাত্র সেটকে নিয়েই দুরন্ত গতিতে নাটক এগিয়ে চলে, বলা ভাল ছোটে! আর তার সঙ্গে কি চমৎকারভাবেই না সাঁতরে চলেন পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর দীপায়ন চরিত্রটিকে নিয়ে! জয়ন্তীর দ্বিতীয় স্বামী, স্ত্রীর থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট দীপায়ন কোনও দিনই দত্তগুপ্ত পরিবারের হয়ে উঠতে পারল না! তা অবশ্য কোনও দিনই চায়নি সে। বরং, অনেকটাই প্রচ্ছন্ন থেকে জয়ন্তীর সময়ে ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে শ্যুটিংয়ের খুঁটিনাটি পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় দেখভাল করে দীপায়ন। নিজে বাংলা ফিল্ম নিয়ে গবেষণা করে, বাংলা ফিল্ম নিয়ে তথ্যচিত্র বানায়, সেখানে তাঁর স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেয়, দত্তগুপ্তদের ছোট ছেলে পৃথ্বীজিৎ তাকে বাবা বলেই সম্মান দেয়, ভালবাসে, সেটাও তার একটা বড় সন্তুষ্টির কারণ! অনবদ্য পীযূষও! নিজের অজান্তেই সে-ও যেন এই সমাজের আর এক প্রান্তিক মানুষ!
এই তিন দাপুটে অভিনেতার সঙ্গে খুবই ভাল সঙ্গত করেছেন পৃথ্বীজিতের ভূমিকায় কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজি এবং তাঁর বন্ধু মৈত্রেয়ীর চরিত্রে পৌলোমী বসু। মঞ্চে পৌলোমীর উপস্থিতি যেন এক পেলব স্পর্শ নিয়ে আসে।
২০১২-র ২৫ ডিসেম্বর জয়ন্তী জানতে পেরেছিলেন, অভিজিৎ আবার আসছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দরকার আছে।
আর তার পর থেকে এই নাট্যের পরিভ্রমণ শুরু। আর তার সঙ্গেই পরিভ্রমণ অভিনেতা, নাটককার ও পরিচালক ব্রাত্যেরও। নাটকের আঙিনা থেকে রাজনীতি ও তার হাত ধরে ক্ষমতার অলিন্দে পদচারণা সত্ত্বেও বারে বারে সেই মঞ্চেই ফিরে আসার এই পরিভ্রমণ!
এটা ব্রাত্য বসুর কাছেও এক বড় পরীক্ষা বইকি! এবং এই পরীক্ষায় তিনি মেধা-তালিকার শীর্ষেই রইলেন!
এক্কেবারে সিনেমার মতোই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।