ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে বিপর্যস্ত বরগুনা। তার ওপর নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় এক লাখ পরিবার তিন দিন ধরে পানিবন্দী। এসব পরিবারের সদস্যদের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। ঘূর্ণিঝড়ে বেশির ভাগ পরিবারের বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল শনিবার বরগুনা সদর ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পানিবন্দী এসব পরিবারের সদস্যদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ চোখে পড়ে। সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক বলেন, এই উপজেলায় ৩০-৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী বলে তাঁরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাথরঘাটা উপজেলায় ৫০-৫২ হাজার, বেতাগী উপজেলায় ১৫ হাজার এবং বামনায় প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। কিন্তু পানিবন্দী এসব মানুষের জন্য সাহায্যের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল।
দুপুরে সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে আছে।
গ্রামের ষাটোর্ধ্ব জাহানারা বেগম ঘরে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। হাঁটুপানি ভেঙে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের চালা ও বেড়ার কিছু অংশ নেই। ঘরের মালামাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কাঁথা-কাপড় ভেজা। জাহানারা বলেন, ‘রাইতে একটু ঘুমামু, হেই অবস্থা নাই।
ঘরে চাউল নাই, আর রানমু হেই জাগাটুও নাই। সব পানিতে তলাইয়্যা আছে। চাইর দিন ধইর্যা মানষের চিড়া-মুড়ি খাইয়্যা ঘরের সবাই দিন কাটাইতে আছি। ’
সদরের কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের কোটবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ পরিবার পানিবন্দী। সদরের খাজুরতলা গ্রামের বাসিন্দা খোকন হাওলাদার বলেন, ‘চাইর দিন ধইর্যা ঘরে কোনো রান্ধন-বাড়ন অয় না।
কোমর পানি ভাইঙ্গা রাস্তায় ওঠা লাগে। ঘর গ্যাছে, এহন পানি মোগো আরেক বিপদ ডাইক্যা আনছে। ’ কোটবাড়িয়া গ্রামের আবদুর বারেক বলেন, ‘চাইরদিন ধইর্যা ঘর দিয়া বাইর অইতে পারি না। ’
সদর উপজেলার নলটোনা ইউনিয়নের গাজী মাহমুদ, গর্জনবুনিয়া, আগা পদ্মা, গোড়া পদ্মা ও আজগরকাঠি, বালিয়াতলী ইউনিয়নের পাতাকাটা, পালের বালিয়াতলী ও ছোট তালতলী, গৌরিচন্না ইউনিয়নের খাজুরতলা, লাকুরতলা, ছোট বদরখালী, বেতবুনিয়া ও বাইশতবক গ্রামে গিয়েও একই দৃশ্য দেখা যায়। নলটোনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সফিকুজ্জামান জানান, তাঁর ইউনিয়নের দুই শতাধিক ঘর সম্পূর্ণ এবং দেড় হাজারের বেশি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
’
সকালে তালতলী ও আমতলী উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা যায়। তালতলীর প্রকল্প কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই দুই উপজেলার পানিবন্দীদের তালিকা নেই। তবে এই দুই উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার ৬০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।
তালতলীর লাউপাড়া গ্রামের হালিমন বেগমের সম্বল বলতে ছিল ছোট্ট একটা ঘর।
স্বামী আবদুল মালেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তিন মেয়ের মধ্যে ছোটটি তালতলী কলেজের ছাত্রী। বাকি দুজনের বিয়ে হলেও থাকেন মায়ের কাছে। হালিমন লাউপাড়া বাজারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান করে সংসার চালান। গত বছর ধারদেনা ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘর তোলেন।
মহাসেনের আঘাতে ঘরটি দুমড়েমুচড়ে গেছে। দোকানও শেষ। ঘরের ভিটিতে খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন হালিমন ও তাঁর পরিবার।
হালিমন বলেন, ‘ঋণ কইর্যা ঘর তুলছিলাম। কিন্তু সেই সম্বলটুকু শ্যাষ অইয়্যা গ্যালো।
এহন ক্যামনে লোনের কিস্তি দিমু, আর কী দিয়া ঘর তুলমু কইতে পারি না। ’ তালতলীর ছোট আমখোলার আলকাস মিয়া বলেন, ‘জমির ফসলাদি সব শ্যাস। এহনও ঘরের মধ্যে পানি। তিনদিন ধইর্যা কোনো দানা-পানি মোহে দেতে পারি নায়। ’
তালতলী উপজেলার লাউপাড়া, বড় ও ছোট আমখোলা লালুপাড়া, মেনিপাড়া, চামোপাড়া, আগাপাড়া, নিদ্রা, সখিনা, তেঁতুলবাড়িয়া, জয়ালভাঙাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী।
সোনাকাটা ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুস ফরাজি জানান, এই ইউনিয়নে ৩২৯ ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং এক হাজার ৬৬০টি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের মেনিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপপরিচালক হাফিজ আহামঞ্চদ বলেন, জেলার বেশ কিছু এলাকা এখনো পানির নিচে। অনেক পরিবার মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ পরিবার পানিবন্দী, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।