আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যানভাস

চিত্রদীপ জ্বেলে রেখো ময়ূখ পিদিম; রাত্রি-কথায় বেঁধে নেবো ভোরের খোঁপা। পঞ্চম বারের মত চেষ্টা করেও কেন জানি ক্যানভাসে প্রাণ দিতে পারছে না অপু। কৃষ্ণচূড়ার ছায়া শীতল চোখে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মেয়েটার চোখ যেন একটা সময় শ্রাবণের আকাশ হয়ে যায়। এক হাতে রঙের তুলি অন্য হাতে প্যালেট নিয়ে একটু পর পর পা’য়ের ভর পরিবর্তন করছে, বিরক্ত হলে পর একটু বসে বা মন খারাপ করা উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে দৃস্টি প্রসারিত করে দেয়। “অপু, শোনো---” বলে ডাকতেই ও আমার ঠোঁটে একটা আঙুল ছুঁইয়ে আকুতি মাখা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল, “ধ্রুব, আর একটু প্লিজ; আর একটু অপেক্ষা করো।

আমার ভাবনাগুলোকে জমাট বাঁধতে আর একটু সময় দাও। ” আমি অপুর ভাবনাগুলোকে তন্দুর আঁচে ছেড়ে দিয়ে নিকোটিনের গন্ধ ওড়াতে লাগোয়া বারান্দায় চলে এসে আমার ভাবনার রশিকে টেনে ধরলাম। সকাল ১১ টা থেকে ৫ ঘণ্টা ধরে অপুর সাথে একটা রুমে কাটিয়ে দিলাম। খুব জানতে ইচ্ছে করছে কিসের এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ও ছটফট করছে আর ক্যানভাসে কেন এক বিষণ্ণ তরুণীর অভিমান ধরে রাখতে চাইছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর জানা হয় না কিংবা আমি জিজ্ঞেস করতে গিয়েও ফিরে আসি।

এই চার দেয়ালের মাঝে দীর্ঘসময় থাকার সুবাদেই হয়ত আমি অপুর এলোমেলো কুঁচকে থাকা পোশাক, অযত্নে ফেলে রাখা একরাশ চুল আর ওর স্মিত স্নিগ্ধ হাসির সুবাস পেতে একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে মনে মনে আমার ভিতর ডাকতে থাকি। ও চকিতে আমার অন্তরাত্মার তীব্র আহ্বানে বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে জানতে চাইলো – “আমায় কিছু বলছ ধ্রুব?” ---- " না, তুমি তোমার ভাবনাগুলোকে জমতে দাও। আমি আছি তোমার অপেক্ষায়। কাজ করো তুমি। " অপু আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো ক্যানভাসে অভিমানী তরুণীর বিষণ্ণ ভাব ফুটিয়ে তুলতে যার চোখের কোণে অশ্রু টলমল করছে ভোরের শিশির বিন্দুর মত সজীবতায় যা বিগত ৫ ঘণ্টা ধরে ফুটিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছিল ও।

চোখটা জ্বালা করে উঠতেই দু’কাপ চা করে অপুর সামনে একটা কাপ রেখে অন্যটা নিয়ে আবারো বারান্দাতে এসে দাঁড়াই সিগারেট ঠোঁটে। বেশ কয়েকটা কষে টান দেই ভেতরে জমে থাকা বদ্ধ গুমোট অব্যক্ত কষ্টের ভাবটাকে ছাই-ভস্ম করে উড়িয়ে দিতে, ধোঁয়াগুলোকে উড়িয়ে দেই গ্লানি কমাতে শরৎ এর নীলাকাশে বলাকা আহাজারির মাঝে। বারান্দা থেকে বাইরের এপার্টমেন্টে কিশোরদের চার-ছক্কা হাঁকানো, গাড়ির একঘেয়ে ক্লান্তিকর প্যাঁ পোঁ আওয়াজ, ফেরিওয়ালার হাঁক-ডাক শুনতে শুনতে আমি ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতে থাকি দিনশেষের গোধূলিমায়াতে। হঠাৎ করেই চোখ পড়ে পাশের এপার্টমেন্টের তিনতলার কার্নিশে আমার মতই একলা একা একটা পাখি স্থির চিত্তে , নিঃসঙ্গতার ছদ্মবেশে আমাকে নিয়েই কবিতা লিখছে। আমার দিকে পাখিটার চোখ পড়তেই পাখিটা আমাকে স্তব্ধতায় বসিয়ে রেখে আমার দেহের ভিতর থেকে মনটা নিয়ে উড়ে পালালো।

আর আমি চেয়ে থাকলাম অবাক-নির্নিমেষ। পাখি হতে তো পারব না তাই ধ্রুব হয়েই কান খাড়া করে রাখি অপুর ঘুঙুরের প্রতীক্ষায় সারা দুপুরের খাঁ খাঁ তৃষ্ণা মেটাতে। “কি ভাবছ ?” শুনেই চমকে উঠি। কাঁধে স্পর্শ পাই অপুর। আসলে অপু নয়; ক্যানভাস থেকে উঠে আসা সেই বিষণ্ণ তরুণীর।

ধীরে ধীরে রক্তশূন্য হতে থাকে আমার মুখ, কম্পন ওঠে সারা দেহ জুড়ে। একরাশ ভালবাসার মৌনতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি আমার অপু চরিত্রের সেই বিষণ্ণ তরুণীর দিকে। একটা সময় অনুভব করি সেই তরুণীর শৈল্পিক আঙুল আমার চোখের পাতা, নাক, ছয় দিনের জমানো গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আমার এলোমেলো চুল গুলোর মাঝে ঘূর্ণি তুলে দিচ্ছে। এই হঠাৎ প্রাপ্তিতে কষ্টের দলায় রোধ হয়ে আসে কণ্ঠ। মুখ ফুটে আর বলা হয় না “ ভালবাসি তোমায় অপু ”।

মেয়েটি আলতো আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে ব্যালকনি থেকে রুমের দিকে আমায় নিয়ে আসে। চেয়ে দেখি অপু ক্যানভাসে ওর আঁকা শেষ করে আজকের তারিখসহ স্বাক্ষর দিচ্ছে । পায়ে পায়ে অপু ওর আঁকা সেই বিষণ্ণ তরুণীকে ফ্রেমে বন্দী করে কণে দেখা আলোয় উদ্ভাসিত মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটাতে। সন্ধ্যার আকাশটা নীল রঙ ছড়াতে শুরু করলে আমরা দু’জন দু’জনার মৌনতায় সবটুকু লীনতা শুষে নিতে থাকি একে অপরের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে। সমাপ্ত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।