গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত
সিকদার আমিনুল হক কবি। কিন্তু শুধু এইটুকু পরিচয় কোন কবিরই কাম্য নয়। সব কবিই তার নিজস্ব বলয় আর পৃথিবীকে প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং সেই স্ব-সৃষ্ট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান পাঠক মননে। হয়তো চাওয়া আর পাওয়ার মিলনটা সর্বদা বৈষয়িক সমীকরণে ধরা পড়ে না। তবু সত্যিকারের সমর্থ কবি কোন মিডিয়া সন্ত্রাস ছাড়াই তার রাজত্ব কায়েম করেন।
সিকদার আমিনুল হক প্রসঙ্গে এ কথাই খাটে, হ্যাঁ, তিনি শুধু কবি নন, সত্যিকারের কবি, বিশুদ্ধ কবি। এই স্বীকৃত যথার্থ কি-না তা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের ব্যক্তি সিকদার আমিনুল হককে প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন তার কবিতার। তবুও আজ ব্যক্তি সিকদারে শারীরিক অনুপস্থিতিও ক্ষরণের সৃষ্টি করে। আজ যখন আজিজ পাড়ায় কবিতার ঘরে অনেক বেসুরো চিৎকার শুনি তখন একজন বিশুদ্ধ কবির নির্মোহ বিনীত অবয়বের ছায়াটি মনে পড়ে, হায় কায়াটি দেখি না!
একদা বাঙলার মধু কবি মিনতি করে ছিলেন - ‘রেখো মা দাসে রে মনে। ’ রবি প্রভা ছড়িয়ে রবে সে কথা নিশ্চিত হয়ে ঠাকুর মশায় লিখেছিলেন - ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে।
‘ বিদ্রোহী নজরুলও লিখেছিলে - ‘অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে। ’ না, আমাদের সিকদার আমিনুল হক এইসব ছন্দ-সুরের সাথে নিজেকে হয়তো মেলাতে পারেননি। এই নিষ্ঠুর সময়ের হাওয়াটা তিনি হয়তো বুঝতেন; বুঝতেন নিজেকেও। তাই তার সুস্পষ্ট উচ্চারণ -
নিজেকে যেহেতু বুঝি, স্মৃতি নয়, উচ্ছন্নেই শেষে
যেতে চাই। কারো মনে দিইনি সামান্য স্বর্গসুখ
অমর কবিতা লিখে; - বড়ো শুষ্ক এই ঝর্ণাতলা;
কালোত্তীর্ণ হওয়া কোন ছন্দময় অহঙ্কার নেই।
রেখো না দাসেরে মনে, এই আর্জি আজ বেশি প্রিয়।
এই নষ্ট যুগে, অমরতা কিংবা শাশ্বতের চিন্তা
বড়োই নাটুকে আর ছায়াচ্ছন্ন; জীবনের লোভ
ঢের বেশ আন্তরিক। মৃত্যু চিন্তা বিমর্ষ গিমিক।
রেখো না দাসেরে মনে, এক রাত্রি এক ঋতু [১৯৯১]
লেখা পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চরে সে - এই আপ্তবাক্য মুখস্থ করে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্ম পিতার মৃত্যু বার্ষিকী ভুলে যায়। আর পিতারা ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে অফিস থেকে ফিরে এসে ছেলেকে অধিক আয়ের ফর্মুলা শেখায়।
কাজেই এই সময়ে কবি ও কবিতা বড় বেশি মার খায়। মার খায় প্রতিষ্ঠা ও প্রতিযোগিতার ব্যাকরণের হাতে। এই মার ঠেকাতে কেউ হয়তো মিডিয়ার পা চাটে, কেউ মিডিয়াকেই বুমেরাং করে নেয়, আবার কেউ গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আমাদের সিদকদার আমিনুল হক এ সবের কোনটাই করেননি। অমরত্ব থেকে খ্যাতির খুচরা মোহ - কোথাও আটকে পড়েননি তিনি।
মাকড়শা ও মাকড়শার জাল থেকে দূরে সিকদার আমিনুল হক যে নিজস্ব রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সেখানে তিনি যথার্থ বাঘ -
হরিণের উপমায় কিছু পঙক্তি পেলে, ছিঁড়ে খুড়ে
মেটাই ক্ষুধার জ্বালা; সেই অর্থে আমি মাংসাশী;
না হ’লে অপার ক্লান্তি, পড়ে থাকি শান্ত নিরিবিলি;
মাতৃভাষা নিয়ে আমি উদয়াস্ত কাটাই প্রহর।
কবি ও বাঘ, এক রাত্রি এক ঋতু [১৯৯১]
বাঘের দাপটেই মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে ঘিরে আমাদের সিকদার আমিনুল হক ইহলৌকিক পর্বটা শেষ করে দিলেন। আর আমরা জানি, এই ইহলোকে তিনি পুরোটা কবি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। বিস্মৃতিপরায়ণ এই জাতির বুকে এখনও কোথাও কোথাও শাপলা ফোঁটে নিয়মিত। তাই অনেকে নিরাশা আর বেদনার ভাঙা ঘরে কবি ও কবিতা তবু রয়ে যায়।
আর তখন সিকদার আমিনুল হকের কায়াটিও চোখে পড়ে!
এইখানে আমাদেও সিকদার আমিনুল হক অনন্য হয়ে ওঠেন। সাদা পৃষ্ঠার সঙ্গে তিনি আঁতাত করেন না, বরং নিয়ত সংগ্রাম করে যান। শুদ্ধতম একটি শব্দের জন্যে কোন শর্টকাট পথ নেই, কবিতার সংসারে নতজানুদের ঠাঁই নেই। এই সব জেনেই জনাব সিকদার আমিনুল হক কবিতার সঙ্গে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন, এ এক এমন জীবন যুদ্ধ যেখানে বাঘকে শিকার করেই খেতে হয়। চিড়িয়াখানার বাঘের মতো রেডিমেড খাবার আর চেনা খাঁচার শিক পছন্দ নয় বলেই লোরকা, নেরুদা, রিলকে, গালিবের মতো কবিতার সঙ্গে সংগ্রাম করে গেছেন তিনি।
একটি শব্দের জন্যে, একটি বাক্যেও জন্যে দিন-রাত্রি অবিরল লাঙল চষেই কবিতা ফলিয়েছেন তিনি।
একঘন্টা, একদিন দূরে থাক, মাসেও একটি
আসে না নিজস্ব শব্দ মনোমত। লিখি আর কাটি;
খাতা হয় চিত্রময়, যেন বনে হরিণের ছোটাছুটি
আর তছনছ খরগোশ-পাড়া!
কবিতা লিখেই, সুপ্রভাত হে বারান্দা [১৯৯৩]
কবিতার জন্যে নিয়ত সংগ্রামী-আপোষহীন এই কবি তার যুদ্ধক্ষেত্রে সশস্ত্র হলেও তার বুকের মধ্যে নিষ্ঠুরতা নিয়ে ফেরেন না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মতোই এ সংগ্রাম ভালবাসার বিজয়, সৃষ্টির আনন্দের সমতুল্য। বিশ্বকাব্য ভুবনে কবিকে বহু বিশেষণে ভূষিত দেখলেও কবির সঙ্গে বাঘের তুলনা বিরলই বটে।
আর এই তুলনা থেকে কবিকে স্রেফ মাংসাশী ভাবলে হয়তো আমাদের সিকদার আমিনুল হককে বুঝতে ভুল হবে। এমন ধারণাই বরং সংগত যে, কবির কবিতা অনুসন্ধানের উদগ্র বাসনাই বাঘের সাথে তুলনীয়, স্বংয় কবি নন। কারণ সিকদার আমিনুল হকের মতোই যথার্থ কবিরা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে যে কারো চেয়ে, [লক্ষ্য করান, যে কারো চেয়ে] উত্তম শ্রেণীর। আবুল হাসানকে উৎসর্গ করা কবিতায় তিনি বলেন -
কবিদের মতো ভালো, সুষ্ঠু আর কিছু আছে নাকি?
অন্যদের দ্যাখো কাছে গিয়ে, মিশে, পুথি পড়ে দ্যাখো
তোমার নিকটে যারা, মুৎসুদ্দিকে অথবা নফর
গিয়ে দ্যাখো কত হিংস্র, হাত থেকে রক্ত ঝরে পড়ে
গোপনে ঝর্ণার পাশে, আড়তে-শহরে, দূর গ্রামে।
কবি, আমি সেই ইলেকট্রা [১৯৮৫]
কবি ও কবিতার চরিত্রকে এমন করে এই সময়ে সিকদার আমিনুল হকের মতো করে আর কেউ কী বুঝতে পেরেছিলেন! কবির অভাব ও অহঙ্কার নিয়েই কবি জাগ্রত থাকেন কবিতার সংসারে।
আমাদের মনে হতে পারে গালিবের কথা বলতে গিয়ে সিদকার আমিনুল হক হয়তো নিজের কথা বলেছেন -
কাকে বলবেন অভাবের কথা; অহঙ্কারে লাগে।
যদিও গলায় খরা; মোমবাতি নির্ভয়ে জ্বালিয়ে
লিখতে বসেন শের মধ্যরাতে। আসে না মোহর
সত্যি কথা! কিন্তু পঙক্তি অনর্গল স্বর্গ থেকে নামে।
গালিবের মধ্যরাত, শ্রেষ্ঠ কবিতা [২০০০]
নিজেকে যেমন গালিবের পাশে দাঁড় করে দেখেছেন তিনি তেমনি জীবনানন্দের সঙ্গে পথ হেঁটেছেনও। নিজের কবিতাকে জীবনানন্দেও উল্টরসূরী হিসেবে ভাবতে ভালবেসেছেন তিনি।
সারারাতের সংগমের পর তিনি জীবনানন্দের মানস সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন -
কবিতা লিখতে হয়, লিখি! কষ্ট? -তাও আছে! দেহে
কত তছনছ আর রক্তচাপ, জিভে বাসী অম্ল
সারারাত্রি জেগে -
তথাপি
আমার কবিতাগুলি আপনার নিদ্রিত সন্তান।
জীবনানন্দের সঙ্গে, রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা [১৯৯৫]
কবি ও কবিতার সঙ্গে বাঘ ও হরিণের [কিংবা খরগোশের] সম্পর্ক স্থাপন করার পরও সিকদার আমিনুল হক যেমন বিনীত রয়ে যান, তেমনি প্রেমিকও। কেননা, প্রেমিকই বিনীত হয়, দূর্বিনীতও। আমাদেও কবিতা পাঠের ইতিহাসে তাই সিকদার আমিনুল হকের কলম থেকে পেয়ে যাই আরেক রমণীর মুখ, তিনি সুলতা। হ্যাঁ, জীবনানন্দের যেমন বনলতা, সিকদার আমিনুল হকের তেমনি সুলতা।
সুলতাকে আমরা প্রথম পাই ‘তিন পাপড়ির ফুল’ [১৯৭৯] কাব্যগ্রন্থে। সুলতার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই ‘সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ’ কবিতা-তোড়া উপহার দেন তিনি আমাদের।
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
আকাশে মেঘ - দীঘিতে কেন হাঁস,
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
প্রেমিক কেন থাকে না চিরকাল
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
সহজ সুখ থাকেনা মহাকাল।
সুলতা জানে, সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ, তিন পাপড়ির ফুল [১৯৭৯]
প্রথম পরিচয়ের পরও দীর্ঘদিন সুলতা আমাদের কাছে অচেনাই রয়ে যায়। চির অচেনা সুলতা যেন সিকদারের সীমার মাঝে অসীম হয়ে ওঠে ক্রমশ।
তার কণ্ঠেই শুনতে পাই আমাদের প্রশ্ন -
সুলতা এখন ভাবি বাস্তবিক তুমি কে? অলকা,
রতœা, মুনমুন, রীতা - এরা মোটামুটি খুব চেনা;
...
তুমি কি এদের কেউ? তা তো নয়। ...
সুলতা তুমি কে?, এক রাত্রি এক ঋতু [১৯৯১]
বোঝা যায়, সুলতা আমাদের চারপাশের সাধারণ নারী নয়। তারচেয়েও বেশি বলেই হয়তো কবির অনুসঙ্গে অচেনা সুলতাই নতুন নতুন রূপে বারবার ফিরে আসে। যেভাবে ঘুরে ফিরে কবি আর কবিতা আসে সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় সেভাবে সুলতাও আসে বারবার, নানা প্রসঙ্গে, নানা রূপে।
চাচ্ছি সুলতাকে আমি, সাড়া দেয় তখন এলসা!
আরাগঁ আমাকে তুমি দোষ দেবে; কিন্তু নেই পাপ।
কবে এক সকালের মেয়ে ছিলো সুলতা,...
এখন তারাই বহু; পথে, পার্কে, নৈশ বুলভারে,
আর থাকে সমুদ্রের বালু ঘরে। ঝাউপাতা খেয়ে
দুপুরে ঘুমায় তারা; জ্যোøায় একা গণ্ডোলায়
ভেনিসের রাত্রি দ্যাখে...øান করে শান্ত বাথটাবে।
কেন যে মিলিয়ে ফেলি, এলসার সাথে সুলতাকে!
সুলতা আমার এলসা, সুলতা আমার এলসা [১৯৯৪]
এইভাবে কবি ও কবিতা, বাঘ ও সুলতা একাকার হয়ে যায় তার কাব্যসমগ্রে। আর আমরা লক্ষ্য করি সিকদার আমিনুল হক বাঘের মতো ছুটে যান কবিতার দিকে, সুলতার দিকে। এবং ‘রেখো না দাসেওে মনে’ বলে যতোই বিনয় করেন আমরা তাকে মননে ও মনে রেখে দেই।
কেননা, আমাদের সকলের কবি চেতনায় অঁরাগের মতো, মায়াকোভস্কির মতো, জীবনানন্দেও মতো এবং সিকদার আমিনুল হকের মতো একজন সুলতা ও একটি বাঘ বসবাস করে; নিয়ত, অবিরত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।