আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সন্ধ্যার মানুষ



ছেলেটি ঘুর্ণিতোলা মাতাল হওয়ার মতো। অস্থির গতিতে সবকিছু উদাস করে দিয়ে যায়। বড় বড় পায়ে উড়ো চুল দুলিয়ে হন হন হাটে। তার পদক্ষেপ কিংবা চাহনিতে সতর্ক বোধের আভাস নেই। সে ধুলো-বালির এ গ্রাম ভালবাসে।

তার স্বপ্ন মাটির গন্ধমাখা। ছেলেটি একটি ঘেসো মাঠ ও শূন্য ভিটে পেরিয়ে এ বাড়ি আসে। এ বাড়ির ছেলেরা তার বন্ধু। সকাল, দুপুর বিকেলে সে আসে যায়। সে আসে তার বৈশিষ্ট্যে।

কোন ভান নেই। ধীরে ধীরে পুরনো হতে থাকে সব। কিন্তু একটি চোখ নিত্য পূর্ণিমার মতো। কিছুই পুরনো নয়। ঠিক বোঝা যায় না নিত্যতার মাঝে দুটি চোখ কখন আগ্রহী হয়ে উঠে।

কেবল বড়ো নিরবে, বড় গোপনে জেগে ছিলো এক ভালো লাগার ক্ষীণ ধারা। সে চোখ কি সুখে অবাক দেখেছিলো ঘেসো মাঠে অস্থির পদক্ষেপ, উড়ো চুলে বাসন্তী বাতাসের খেলা। ধীরে ধীরে রিনুর চরাচর কী এক জ্যোৎস্না আলোকিত করে দিতে থাকে। স্বাভাবিকতা তার নেশায় গড়ায়। অবোধ্য টান ধরে কোথাও।

দক্ষিণ দিকে বাড়ির উঁচু সীমানা থেকে ঢালু হয়ে পথ চলে গেছে শূন্য ভিটে ও ঘেসো মাঠ ছুঁয়ে আরো দূরে থানার রাস্তা অবধি। ছেলেটির আসা যাওয়া এপথের আড়ালে অস্থির বুকে শান্ত দাড়ায় রিনু। তখনবা কেমন একটু বাতাস থাকে তার চুলগুলো ওড়াতে। তার কপালে হয়তো মুদু ঘাম জমে। পাতলা ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে যায়।

রিনু সুন্দর হাতে আড়াল করা কৃষ্ণচূড়া জড়িয়ে রাখে। তার নীল দীর্ঘশ্বাসে কোন বিকেল হয়তো আরো বিষন্ন হয়ে যায়। ওই উদাসী মুখটাকে খুব করে বুকের মাঝে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে হয়। কোথাও জল তরঙ্গের মতো মৃদু সুরে বেজে চলে অপার্থিব সুর। একটি দিন আরো অন্যরকম হলো।

রোদের উষ্ণতা নিবিড় জড়িয়ে রেখেছিলো দিনটি। ছিলো অসীম নীলিমায় মুক্ত বিহঙ্গের পাখামেলা। তবু মেয়েটির মন খারাপ হলো। বেসুর বাজে চারদিকে যেন। কোথাও ছেলেটি নেই।

তার প্রিয় জায়গা-নিবিড় বাশতলা, নদীর ঘেসো তীর। তার প্রিয়জনেরা কতো খোঁজে। ব্যথিত মেয়েটি সেদিন বেখেয়ালে ওড়না পুড়ে ফেলে। তারপর অবোধ দুঃখে তার অবুঝ বুক ভাঙ্গা জল গড়িয়েছিলো চোখে। সবাই বোঝে ওড়না পুড়িয়ে মেয়ে কাঁদে।

শেষে ঘোর সন্ধ্যায় আয়োজিত জ্যোৎস্না প্লাবনের মুখে ছেলেটি ফেরে। এলোমেলো, ুধার্ত। সারাদিন কোথায় ছুটেছে। কোন গহিন বনে, অস্পৃশ্য বুনো ফুলের মাঝে। তারপর জ্যোৎস্না নিবিড় অদ্ভূত রাত নামে।

ছেলেটি সে আহ্বানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বিহ্বল কন্ঠে সে বন্ধুদের ডেকেছিলো। তার উচ্ছলতায় কোন কান্তি নেই। মেয়েটি অবাক দেখে। জ্যোৎস্না ভেজা একটা পাগল।

ও ছেলে অমন পাগল হলে কেন। কি দুঃখ তোমার, মন বাড়িয়ে সুখ নেবে তুমি। ছেলেটি বলে- রিনু তোমার কাঁঠালচাপা কবে ফুটবে। রেনু বলে-হ্যাঁ ফুটবে। আজ অনেক সুন্দর রাত।

মেয়েটি লাজুক চোখ তোলে। ছেলেটি আচ্ছন্নের মতো আকাশে চেয়ে আছে। ভাষাহীন মেয়েটির ঠোঁট কাপে। রূপালী আলোয় তা ধরা পড়েনা। ছেলেটির মুখে তাকিয়ে মেয়েটি কেমন হয়ে যায়।

সে ভাবে, এ রাতে হাত ধরে তোমার প্রিয় নদীর ধারে নিয়ে চল। আমি তোমার বন্ধন চাই। আমার কোথাও সুখ নেই। তারপর লজ্জা যেন এক টোকায় জাগিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে সংকোচে ডুবিয়ে দিলো। রিনু মুখে ওড়না চেপেই ছুট দিলো।

ছেলেটি অবাক। সে পেছন থেকে দুবার ডাকলো- রিনু, রিনু। কার্তিক শেষ হয়ে এসেছে। উত্তুরে বাতাসে শীতের টান। শেষ রাতে গায়ে পুরোদস্তুর কাথা জড়াতে হয়।

সকালগুলো শিশির ভেজা। বিকেলগুলো রুক্ষ। এক বিকেলে রিনু সূচীকর্মে বসে। কাপড়ে সূচ ছোটে তার সুন্দর আঙ্গুলের তাড়া খেয়ে আরো সুন্দর কিছু গড়তে। ফুল ফোঁটাতে থাকে সে মনে সুন্দর ভাবনা বিছিয়ে।

আর তাতে কে যেন রঙ ছিটিয়ে দেয়, জ্যোৎস্না নামায়। মগ্নতা ধরেই কিনা হঠাৎ ভারশূন্য শরীর তার ভেসে যেতে চায়। আবার স্বরূপে ফিরে আসে। শূন্যতায় ওঠে আবার মাটিতে ভেঙে পড়ে। ঝাঁকি খায়।

মাথা ঝিমঝিম করে। অবসাদে দু’চোখ বুজে আসে। রিনু বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। ঝাঁকিয়ে জ্বর এসেছিলো সেদিন। দুদিনেও তা কমেনি।

চোখ দ’ুটি বোজা ছিলো। প্রচন্ড উত্তাপের সাথে ঘোরটাও থিতিয়ে যেতে থাকলো। সচেতনতায় স্পষ্ট জেগে উঠতে থাকে সব। তখনই একটা স্পর্শ। কপালটায় কেউ একটা ঠান্ডা হাত রেখেছে।

আকুল চোখের পাতা দুটি খুলে যায়। সেই ছেলেটি দাড়িয়ে। হাতটা নামিয়ে লাজুক হেসে বলে, খুব জ্বর বুঝি। রিনুর বুকটা ক্যামন করে ওঠে। তুমি আমায় ছুঁয়েছ।

হাতটা আরেকটু রাখো। আমার ওষুধ চাই না। তোমার গন্ধমাখা বাতাস একটু নিতে দাও। তার চোখ বেয়ে আবাধ্য জল নামে। ছেলেটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু বোঝে না।

সে বাইরে বেরিয়ে আসে। পা দুটি তার থমকে থমকে যায়। কেউ ডেকে উঠলো কি? না, পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে না। মেয়েটি সেরে উঠেছিলো। সচেতনে কিংবা উদাসিন্যে ছেলেটি আর এমুখো হয়নি।

একদিন সে এলো দিনের শেষে আধাঁর আগ্রাসনের মুখে। যখন সবকিছু রহস্যময়তার চাদরে জড়ায়। দাড়িয়ে ছিলো সে মেয়েটির সামনে। মেয়েটির সান্ধ্য আয়োজনের ব্যস্ততা ছিলো তবু সে উৎকর্ণ হলো ছেলেটির কথায়। কাঁপা কন্ঠে সে বলে-কারো জন্য টান আছে তোমার।

মেয়েটি শান্ত বলে-হ্যাঁ, একটা পাগল বড় টানে। ভারী অবুঝ সে। ছেলেটি হঠাৎ বড় বড় পা ফেলে চলে যেতে থাকে। মেয়েটি স্থির দাড়িয়ে। খানিক গিয়ে থমকে দাড়িয়ে আবার ফিরে আসে সে।

এবার নিঃশ্বাস ছোঁয়া নৈকট্যে দাড়িয়ে দু’হাতে মেয়েটির ভরাট মুখটা তুলে নেয়। বিহ্বল চোখ দুটি তার প্রানান্ত আধার সরিয়ে স্পষ্ট জাগিয়ে তুলতে চায় মেয়েটির চোখ, কপাল অধর চিবুক। তারপর তার ঠোট দুটি এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটির ভিরু কাঁপা ঠোঁট দুটির পানে। কত স্বপ্নের ঘোরে আঁকা ছবি যখন মূর্ত শরীর নিয়ে বাস্তবে হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তাকে অভিনন্দিত করা ছাড়া উপায় কি। কিন্তু না, মেয়েটি দৃঢ় প্রতিবাদে সরিয়ে দেয় ছেলেটিকে।

ওড়নাটা আঁটসাঁট শরীরে জড়িয়ে বাড়ির পানে পথ ধরে। ছেলেটি দাড়িয়েই থাকে। দুটি মানুষকে রহস্যময় করে দেয়া সন্ধ্যা তখনো হারিয়ে যায়নি। -রানা মুহম্মদ মাসুদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।