সোহরাব হাসান
জোটের রাজনীতি কি শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য? হরতাল পালন ও হরতাল ঠেকানোর জন্য? বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা কি তারা আদৌ ভাববে না?
২৭ জুনের হরতাল সফল করতে বিএনপি এখন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী মিত্রের সন্ধানে। নিমতলীতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটল তা তাদের তেমন স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না। তারা প্রতিদিনই হরতালের সমর্থনে বৈঠক করছে। নিমতলীর হতভাগ্য ও অসহায় মানুষের পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট মহা বিজয় লাভ করেছিল জোটের কারণেই।
বিএনপি এখন জোট রাজনীতিকে চাঙা করতে চাইছে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে। রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের ঝান্ডা সমুন্নত রাখার বদলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশলই এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে। না হলে বিএনপি যেমন জামায়াতের সঙ্গে সখ্য করতে পারত না, তেমনই আওয়ামী লীগও এরশাদের মতো স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলাত না। আওয়ামী লীগের নৌকার এক প্রান্তে বিষণ্ন বামপন্থীরা, অন্য প্রান্তে পরিত্যক্ত স্বৈরাচার। ফলে মাঝেমধ্যে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ফারাক করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।
নির্বাচনের আশাতীত ফল দুই শিবিরকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল; আওয়ামী লীগের মধ্যে একলা চলো মনোভাব যেমন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তেমনই বিএনপিও জামায়াত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের প্রাণান্তকর চেষ্টার পাশাপাশি ধর্মীয় রাজনীতির ধারক জামায়াতের পার্থিব আশ্বাসও সক্রিয় ছিল। নির্বাচনে খালেদা জিয়া যেতে রাজি ছিলেন না। জামায়াত ও বিএনপির উদারপন্থীরা নাকি তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ভয় নেই, তাঁদের সঙ্গেও নেপথ্য নায়কেরা আছেন। কিন্তু না, বরাবর যাঁরা বিএনপির জয়ে ভূমিকা রাখেন তাঁরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতারা ভাবলেন, এককভাবেই তাঁরা যখন দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছেন, তখন অন্যদের সরকারে নেওয়ার দরকার কী? তা সত্ত্বেও দুই শিবির থেকে দুজনকে প্রতীকী মন্ত্রিত্ব দিয়ে মহাজোটের প্রাণটা বাদ দিয়ে কাঠামোটা টিকিয়ে রেখেছেন।
তবে জোট রাজনীতিতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন এরশাদ। আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ও তাঁর পঞ্চম সংশোধনীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদ ও তাঁর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে একটা কথাও বলেন না। পঞ্চম সংশোধনী খারাপ হলে অষ্টম সংশোধনী কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বাম শরিকদের প্রতিবাদের কণ্ঠ এত ক্ষীণ, ড্রয়িং রুমের বাইরে পৌঁছায় না।
যাঁরা এরশাদের ক্ষমতারোহণকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালতে মামলা করেছিলেন, তাঁরাও চুপচাপ আছেন। এত সবের পরও আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো মেয়াদ এরশাদ মহাজোটে থাকবেন, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। অন্তত এরশাদকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা সে রকমই মনে করেন।
সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি উভয়ের কাছে জোট শরিকদের গুরুত্ব বেড়েছে বলেই ধারণা করি। বড় শরিকেরা বিপদে না পড়লে যে ছোটদের কাছে ধরনা দেয় না, তার নজির ইতিহাসে ভূরি ভূরি আছে।
বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচন করলেও পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তাধারাও কাজ করে। জোট আমলে জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে জামায়াতের ভূমিকা আছে বলে বিএনপির তৃণমূল নেতারাও বিশ্বাস করেন। তাঁদের ধারণা, জামায়াতের সঙ্গে জোট করে বিএনপি তেমন লাভবান হয়নি, বরং বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াত তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে। মধ্যপন্থী মুসলিম দেশকে চরমপন্থী জঙ্গিবাদীদের দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত করিয়েছে।
কথায় বলে, বিপদে পড়লে নাকি হাতিও চামচিকার হাতে-পায়ে ধরে।
বর্তমানে বিএনপির অবস্থা তার চেয়ে ভালো বলা যাবে না। ২৭ জুনের হরতাল নিয়ে জোটের রাজনীতি আবার সরগরম করতে চাইছে তারা। বিএনপি একে দেখছে সরকার পতনের আন্দোলনের প্রথম মহড়া হিসেবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও নিয়েছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতারা বলতেন, তাঁদের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে নাকি আওয়ামী লীগ হরতাল দিত।
বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ যা যা করেছে, বিএনপিও তা-ই করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতির সুবিধা হলো, তাদের কিছু করতে হয় না, সরকারই তাদের হয়ে অনেক কিছু করে দেয়। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে ক্ষুব্ধ করলেও নেতা-মন্ত্রীরা আমলে নেন না। বিএনপি যেভাবে পেশাজীবীদের খেপিয়েছিল, সম্ভবত আওয়ামী লীগও সেই নীতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রশাসন থেকে শুরু করে সবকিছু দলীয়করণ করছে, যেভাবে পাইকারি হারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ওএসডি করে রেখেছে, তাঁরা বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মেলাবেনই।
কোনো দলই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে না, দেখে দলীয় সমর্থক হিসেবে। যারা আমার সঙ্গে নেই, তারা আমার শত্রু। মনে হচ্ছে সবার মধ্যে একেকজন জর্জ ডব্লিউ বুশ বাস করেন, অথবা তাঁর চেয়ে ভয়ংকর কেউ। অতএব, যত পার সমর্থক জোগাড় করো। বিএনপির রণপ্রস্তুতি দেখে আওয়ামী শিবিরেও নড়াচড়া শুরু হয়েছে।
শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে মহাজোটের নেত্রী শেখ হাসিনা একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং একসঙ্গে জনসেবার কথা বলেছেন। বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে তিনি শরিকদের সহযোগিতা চেয়েছেন। সহযোগীরাও দুই হাত তুলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
বাংলাদেশ বড় অদ্ভুত জায়গা। এখানে উৎপাদন বাড়িয়ে জনসেবা করা হয় না, কলের চাকা বন্ধ করে জনসেবা করতে হবে।
এখানে যেকোনো সরকার নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবে। আইন হলো আমজনতার জন্য। সরকার বেআইনিভাবে বিরোধী দলকে ঠেঙাবে, আর বিরোধী দল সড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাঙচুর, আগুন জ্বালিয়ে তার পাল্টা জবাব দেবে। জনগণ গিনিপিগ। বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা জনগণের দল, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে হরতাল দিয়েছেন।
হরতাল দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা কীভাবে পূরণ করা সম্ভব সে কথা তাঁরা বলছেন না।
নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ১১৯টি প্রাণই কেড়ে নেয়নি, সেখানকার মানুষের সহায়-সম্পদও পুড়ে ছাই হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ মানুষেরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্বজনহারা মানুষেরা নির্বাক, ভাবলেশহীন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও তাঁদের সহায়তায় হাত বাড়িয়েছে।
তাঁরা যা হারিয়েছেন, তা কখনোই ফিরে পাবেন না। কিন্তু এ মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ একটু সহানুভূতি ও ভালোবাসার আশা করতে পারেন বৈকি। দুই দলের শীর্ষ নেত্রী একসঙ্গে আহত মানুষদের দেখতে হাসপাতালে যাবেন, তাঁদের সহায়তার ব্যাপারে আলোচনা করবেন—এতটা হয়তো দুরাশা। কিন্তু দুই দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক তো একটি অভিন্ন আহ্বান জানাতে পারতেন, আসুন, আমরা ঢাকাকে সুন্দর শহর হিসেবে গড়ে তুলি। সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিই।
যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করি।
মহানগরবাসী যেদিন গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন, শান্তিনগরের কনকর্ড গ্রান্ড টাওয়ারে ফাটল ও বেগুনবাড়িতে একাধিক হেলে পড়া বাড়ির বাসিন্দারা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন, সেদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনে বিএনপির চেয়ারপারসন ও জামায়াতের নেতাদের হাস্যোজ্বল ছবি দেখলাম। তাঁরা ২৭ জুনের হরতাল সফল করতে মতৈক্যে পৌঁছেছেন। বাস্তুহারা ও আগুনে পোড়া মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাঁদের স্পর্শ করেনি। জোট বা মহাজোটের নেতারাও নিমতলীর সর্বহারা মানুষের কাছে যাননি।
সরকার বা মন্ত্রীরা কী করেছেন, আমি সেই বিষয়ে বিতর্ক করছি না। বলছি, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা।
মহা দুর্যোগে ঢাকা মহানগর। মহা দুর্যোগে বাংলাদেশ। এখনো আইলা-আক্রান্ত দুই লাখ জলবায়ু উদ্বাস্তু গৃহহারা।
অথচ নেতা-নেত্রীরা প্রতিদিন ফালতু বিষয়ে অহেতুক বিতর্কে মাতেন, একে অপরকে ঘায়েল করেন। এ থেকে মুক্তির আপাত কোনো উপায় দেখছি না। তবে এ মুহূর্তে সরকার ও বিরোধী দলের কাছে দুটি নিবেদন রাখতে চাই, দেশের গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে। প্রথম নিবেদনটি বিরোধী দলের কাছে। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে, স্বজনহারা পরিবারগুলোর অসহায়ত্বের কথা ভেবে ২৭ জুনের হরতালটি প্রত্যাহার করুন।
সামনে আন্দোলন-সংগ্রাম করার অনেক সময় পাবেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বাজেট সম্পর্কে সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের কর্তব্য হবে এগুলো বিবেচনা করা। বিরোধী দলের উচিত হবে সংসদে গিয়ে বাজেট আলোচনায় সক্রিয় অংশ নেওয়া। সর্বোপরি ঢাকা শহরে যে মহা বিপর্যয় ঘটে গেল, ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে ব্যাপারে আপনারা একযোগে কাজ করুন।
বেআইনি সব ভবন চিহ্নিত করুন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। নিরাপদ ঢাকা গড়তে, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তত সংসদে একটি প্রস্তাব নিন।
দ্বিতীয় নিবেদনটি সরকারের কাছে। যে আইনগত ত্রুটি দেখিয়ে দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ করেছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিন। পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক আইনবিরুদ্ধ কিছু করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ রাখা যাবে না। একুশে টেলিভিশন বন্ধে জোট সরকার যে ঘৃণ্য আচরণ করেছিল, কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছিল, এর পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। আমার দেশ বন্ধের ব্যাপারে মন্ত্রীরা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন, তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সরকার না চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসকের সাধ্য নেই কোনো প্রকাশনার অনুমতি দেওয়া বা বন্ধ করার। একুশ শতকের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যাঁরা দেখেন এবং দেশবাসীকে দেখাতে চান, তাঁরা কেন ভিন্ন মতের কণ্ঠ স্তব্ধ করবেন? পত্রিকাটি যদি সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচার চালিয়ে থাকে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে, তার প্রতিকার পত্রিকা বন্ধ করা নয়। বরং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রচারণার জবাব দিতে হয় সত্যকে সাহস করে আঁকড়ে ধরে। একটি মিথ্যা ১০ বার বললেও সত্য হয় না। কিন্তু সেই মিথ্যাকে বলতে না দিলেই জনমনে সন্দেহ জাগে।
দয়া করে ভিন্ন মতকে হ্যাঁ বলুন, না বলুন হরতালকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।