বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
শ্রীলঙ্কার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ভারত মহাসাগরের বুকে একটি দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। সাগরবেষ্টিত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম ।
শ্রীলঙ্কার নাম অনেকবারই পরিবর্তিত হয়েছে। এককালে এখানেই ছিল রূপকথার রাবণের লঙ্কাপুরী- আর সে কারণেই শ্রীলঙ্কার নাম ছিল লঙ্কাদ্বীপ। শ্রীলঙ্কার আরেক নাম সিংহল দ্বীপ। বিস্ময়কর হলেও সতি- প্রাচীন বাংলার এক রাজপুত্রের উপাধি থেকে নাম হয়েছিল সিংহল। কেননা, বাংলার সেই যুবরাজের পিতামহ ছিলেন প্রাচীন বাংলার রাঢ় দেশের সিংহ উপাধিধারী ক্ষত্রিয় বীর।
এই কারণেই প্রশ্ন ওঠে বাঙালিরা কি শ্রীলঙ্কানদের পূর্বপুরুষ?
শ্রীলঙ্কার মানচিত্র। শ্রীলঙ্কা বিশ্বের অন্যতম একটি বৌদ্ধরাষ্ট্র। ক্রিকেট ও গৃহযুদ্ধের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত। ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কাকে মাঝে-মাঝে অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় দর্শনে শান্তিবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পড়েনি ...
ভূমিকায় বলছিলাম, প্রাচীন বাংলার এক রাজপুত্রের উপাধি থেকে নাম হয়েছিল সিংহল। প্রখ্যাত বাঙালি ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী কি লিখেছেন পড়–ন : ‘বাঙ্গালার ইতিহাসে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা, বিজয়ের লঙ্কাজয়।
ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে এই ঘটনার কিছুমাত্র উল্লেখ নাই। ইহার উল্লেখ পাই একমাত্র সিংহলের ইতিহাসে, পালিভাষায় রচিত সিংহলের দুইখানা প্রাচীন ইতিহাস আছে। একখানার নাম, ‘দীপবংশ’ অপরখানার নাম ‘মহাবংশ’। প্রথমখানি রচিত হইয়াছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে, দ্বিতীয়খানি রচিত হইয়াছিল
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে। ’ ( ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের গল্প।
’ দেশ। সুবর্ণজয়ন্তী প্রবন্ধ সংকলন (১৯৩৩-১৯৮৩) পৃষ্ঠা,১৯-২৪)
এখন প্রশ্ন এই-কে এই বিজয়?
এবং কবে তিনি লঙ্কাজয় করলেন?
বিজয় প্রাচীন বাংলারই এক রাজপুত্র। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লিখিত তথ্য অনুযায়ী- বঙ্গের রাজা কলিঙ্গের (বর্তমান উড়িষ্যার) এক রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের এক কন্যা হয়েছিল ... সেই কন্যার সঙ্গে রাঢ় দেশের সিংহ উপাধিধারী ‘আটবিক’ এক ক্ষত্রিয় বীরের বিয়ে হয়েছিল। এই বিবাহজ পাত্র সিংহবাহু রাঢ়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ‘সিংহপুর’ (সে কালের প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ নগরী) থেকে রাঢ় শাসন করতে থাকে।
সিংহবাহুর পুত্র বিজয় ...
বিজয়ে লঙ্কাজয়। বাঙালিরা না-জানলেও বিজয়ের লঙ্কাজয়ের কাহিনীটি শ্রীলঙ্কায় অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয়। শ্রীলঙ্কার জনগনের বিশ্বাস - যে বছর গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বান লাভ করলেন অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করলেন সে বছরই বাংলার রাজপুত্র বিজয় সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিংহল দ্বীপে অবতরণ করেছিলেন। তার মানে সময়টা ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্ব। অবশ্য এই নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
কারও কারও মতে বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের বছর খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ এবং সে কারণে বাংলার রাজপুত্র বিজয় সিংহল দ্বীপে অবতরণ করেছিলেন ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বে নয় বরং ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বে ।
খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে প্রাচীন ভারতের মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়েই শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার আরম্ভ হয় । জীবদ্দশায় অবশ্য বুদ্ধ বেশ কয়েকবার শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন। যা হোক। অশোকের সময়ে সিংহল দ্বীপের রাজা ছিলেন দেবনামপ্রিয় তিসা।
মূলত তাঁর উদ্যেগেই খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক থেকেই সিংহল দ্বীপে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে, বিহার ও সঙ্ঘরাম ( বৌদ্ধ মঠ) গড়ে উঠতে থাকে।
অনুরাধপুরের অভয়গিরি মঠ। অনুরাধপুর শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার মতোই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিহারে বিদ্যচর্চা করত। সেই সঙ্গে ইতিহাস চর্চাও করত।
তারাই শ্রীলঙ্কার রাজাদের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত রচনা করার কথা ভেভে পালি ভাষায় সিংহল দ্বীপের রাজাদের ইতিহাস মহাবংশ বা ‘গ্রেট ক্রনিকল’ লিখেছিল। মহাবংশে সিংহল দ্বীপে বিজয়ে আগমন থেকে শুরু করে রাজা মহাসেন (৩৩৪-৩৬১) এর রাজ্য শাসন আলোচিত হয়েছে। ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর কথা মনে থাকার কথা: ‘বাঙ্গালার ইতিহাসে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা, বিজয়ের লঙ্কাজয়। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে এই ঘটনার কিছুমাত্র উল্লেখ নাই। ’ এর মানে বিজয়ের লঙ্কাজয় সম্পর্কে অন্যতম উৎস প্রাচীন সিংহল দ্বীপের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
শ্রীলঙ্কার মানচিত্রে অনুরাধপুরের অবস্থান। অনুরাধপুরকে অনেকে লেখেন বা উচ্চারণ করেন: অনুরাধাপুর। আসলে অনুরাধপুর হবে। দেখুন ; সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাংলা : লেখক ও সম্পাদকের অভিধান। ’ (পৃষ্ঠা,২৭)
অনুরাধপুরের একটি প্রাচীন স্থাপত্য।
প্রাচীন এই নগরটি আরাভি আরু নদীর পাড়ে অবস্থিত ছিল । আজও আরু নদী নদীটি উত্তর থেকে অনুরাধপুর ছুঁয়ে দক্ষিণমুখি বয়ে চলেছে ।
অনুরাধপুরের প্রাচীন দিঘী। অনুরাধপুর বিজয় সিংহের সম্ভাব্য রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে শতকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী ছিল।
বিজয়ের অবতরণের বছর ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্ব। তখনও অনুরাধপুর সিংহল দ্বীপের রাজধানী ছিল কি না সে বিষয়ে অবশ্যি কোনও তথ্য পাইনি।
মহাবংশে বিজয়ের সংশ্লিষ্টতা সর্ম্পকে জনৈক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লিখেছেন, 'According to the Mahavamsa, Vijaya's grandparents hailed from the Kingdoms of Kalinga and Vanga, the present-day Indian states of Orissa and West Bengal as well as parts of Bangladesh respectively. At the beginning of the chronicle (see History of Sri Lanka) the King of Vanga is married to the daughter of the King of Kalinga. Their daughter, Suppadevi, was not only 'very fair and very amorous', but was also prophesied to consummate a 'union with the King of beasts' - in the Mahavamsa, a lion. When this duly happened, she gave birth to two children - Sinhabahu and Sinhasivali. 'Sinhabahu' means 'lion-armed' and the young prince himself is described as having 'hands and feet...formed like a lion's'. The family lived together in the lion's cave, blocked in by a large rock the lion had placed to prevent their exit. Eventually, however, Suppadevi and her two children flee the cave. Later Sinhabahu kills his father with an arrow. Then, marrying his sister, he establishes a kingdom based on a city called Sinhapura. Sinhasivali bears him a series of twins; their eldest child is named Vijaya, and his younger twin brother Sumitta ...
এ প্রসঙ্গেই ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী লিখেছেন, ‘মহাবংশের বিবরণ রূপকথারসে পরিপূর্ণ। কিন্তু মূল কথা কয়টি প্রাচীনতর দীপবংশ ও পরবর্তী মহাবংশে একই-এবং তাহা মুখ্যত ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহন করিতে কোন বাধা দেখি না। বঙ্গের রাজা কলিঙ্গের রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।
তাহাদের কন্যার সহিত রাঢ় দেশের সিংহ উপাধিধারী ‘আটবিক’ কোন ক্ষত্রিয় বীরের বিবাহ হয়। এই বিবাহজ পাত্র সিংহবাহু রাঢ়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া সিংহপুর হইতে রাঢ় শাসন করিতে থাকে। তাঁহারই পুত্র বিজয় প্রজানির্যাতন-অপরাধে নির্বাসিত হইয়া জাহাজে চড়িয়া সমুদ্রে ভাসিয়া পড়ে এবং ঝড়ে র বেগে প্রথম সুর্পারফে এবং পরে ভরুকচ্ছে যাইয়া উপস্থিত হয়। এই বন্দর দুইটি ভারতের পশ্চিম উপকূলে আজও আছে, এবং এখনও সোপারা ও ভারুচ বা ব্রোচ বলিয়া বিখ্যাত। তথা হইতে বিজয় সানুচর লঙ্কায় যাইয়া উপস্থিত হয় এবং লঙ্কার অধীশ্বর হইয়া বসে।
( ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের গল্প। ’ পৃষ্ঠা, ২৪)
প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে রাঢ়ের অবস্থান। প্রাচীন বাংলার অতি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল রাঢ়। বর্তমানে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বড় অংশ। রাঢ় উত্তর ও দক্ষিণ - এই দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল।
অজয় নদকে উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ের মধ্যবর্তী বিভাজন-রেখা বলা যেতে পারে।
পশ্চিম বাংলার মানচিত্র। এখানেই ছিল উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ় । বিজয় সিংহের পিতা মনে থাকার কথা সিংহবাহু রাঢ়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ‘সিংহপুর’ থেকে রাঢ় শাসন করতেন।
এখন কাজেই এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে বাঙালিরা কি শ্রীলঙ্কানদের পূর্বপুরুষ?
তবে আজকাল এই তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে খোদ শ্রীলঙ্কাতেই ।
তারা বলছে অন্য কথা। তবে শ্রীলঙ্কার ইংরেজি নামের (Ceylon) ভিতরে আজও রাজপুত্র বিজয়ের পরিবারের কথা রয়ে গেছে। জনৈক ঐতিহাসিক লিখেছেন:'The English name Ceylon and a host of other related names all most likely trace their roots back to the Sanskrit Sinha ("lion"). With the Sanskrit Sinha as its root, Sinhala can be interpreted to mean "the blood of a lion". As lions are not native to Sri Lanka, Sinhala is most often taken to mean a lion-like man - a hero - presumably Vijaya's grandfather. The Pāli form of the Sanskrit Sinhala is Sihalam (pronounced Silam)'
সেই অনিবার্য প্রশ্ন করেই শেষ করছি।
বাঙালিরা কি শ্রীলঙ্কানদের পূর্বপুরুষ?
তথ্য নির্দেশ:
১. নলিনীকান্ত ভট্টশালী। ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের গল্প।
’ দেশ। সুবর্ণজয়ন্তী প্রবন্ধ সংকলন (১৯৩৩-১৯৮৩) পৃষ্ঠা,১৯-২৪)
২. বাংলাপিডিয়া। এবং
৩. উইকিপিডিয়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।