আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঙালিরা একাকী ভীতু আর অনেকে খুবই ভয়ঙ্কর



কয়েক দিন থেকেই ঘটনাটা নিয়ে মনে খচ খচ করছে। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। যদিও এ ধরনের ঘটনা এখানে হরহামেশাই ঘটছে। তারপরও নিজের সামনেই যখন এসব ঘটনা ঘটে তখন তার রেশ আমার মনে অনেক দিন ধরেই থেকে যায়। কয়েকদিন আগের ঘটনা।

অফিস শেষ করে বের হতে হতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। থাকি শনির আখড়া। রাত হলে বাসায় ফিরতে বিরাট ঝক্কি। কপাল ভালো হলে দুই বার বাস চেঞ্জ না হয় তিনবার। সেদিন বাস আগেই পেয়ে গেলাম।

প্রথম দফা মতিঝিল। পরের দফাতেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন। অর্থাৎ বাস পেতে দেরি হয়নি। তবে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত। পথে জ্যাম পার হয়ে যাত্রাবাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে ১২টা।

এবারও কপাল ভাল। শনির আখড়া-রায়ের বাগ সিটিং ৫ টাকায় উঠে গেলাম। সামনেই সিট পেলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত ভালয় ভালয় এগুচ্ছিল। কাজলা পার হতেই বিপত্তিটা ঘটলো।

বাস চালক গাড়িটির সামান্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিকট শব্দে রাস্তার মিড লাইনারে লাগিয়ে দিল। যাক বাস বা যাত্রীদের ক্ষতি কারো হয়নি। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। কিন্তু কারো কোন ক্ষতি না হলেও বাসের সব যাত্রীরা গেল ব্যাপক চোটে। অবস্থা বেগতিক।

পেছনের তিন/চার জন তেড়ে আসলো চালককে পেটাতে। তাদের দেখে সামনের কয়েকজনও এগুলো। সবাই মিলেই চিৎকার করে বলছে-- ‘হালারে ইচ্ছা মতো সাইজ করেন’ ‘.....পোলা, গাঞ্জা খাইয়া গাড়ি চালাও’ ‘কান পট্টিটে একটা থাপ্পর....ওমুকের পোলা তুমুকের পোলা এইরকম নানান কিসিমের চিৎকার। এরই মধ্যে একজন এসে শুরু করে দিল কয়েক ঘাঁ...তার সঙ্গে আরো কয়েকজন...আরো একজন...অনেকেই মারতে এলো। যেন অনেক আনন্দের একটা কাজ পাওয়া গেল।

সাগ্রহে, আনন্দে, উৎসাহ-উদ্দীপনায় আশা জাগানিয়া কোন মহৎ কাজ! সবাই পেটাতে চাচ্ছে। ‘ওরে ভাই আমারে মাইরেন না’ –চালকের আত্মচিৎকার। ও আরো বললো ‘ভাই আপনাগো লগে কথা কমু, আগে গাড়িটা সাইড কইরা লই’ না গাড়ি সাইড করা যাবে না। আগে মারতে হবে। এমনই ভাবনা যাত্রীদের।

এই মাইরের সুযোগ যাতে মিস না হয়। একজন বলে উঠলো ‘হা...জাদা, আবার কথা কছ। সবাইরে মাইরা ফালাইতাছিলি। আবার কথা কছ। হালারে পিটা’ সবাই মিলে একজনকে পেটাতে যাচ্ছে এটা দেখেই মনটা কেমন যেন হয়ে গেল।

আমিও উঠে দাড়ালাম। চালককে আড়াল করে যাত্রীদের মুখোমুখি হলাম। আরো জোর গলায় বলে উঠলাম- ‘ভাই একটা অপরাধের জন্য সবাই মিলে একজনকে মারতে পারেন না’ ‘এটা অন্যায়, অনেক বড় অন্যায়’ কে শোনে আমার কথা। আমার ওপর দিয়েই পেটাতে শুরু করলো। একদিকে কারো কিল আটকাই তো অন্যদিক দিয়ে কারো লাথি।

আমিও পেরে উঠছিলাম না। অসহায় চালকের সরব কান্না, নাক-মুখ দিয়ে রক্তের ঝিলিক...কোন কিছুতেই তাদের মন গলছেনা। কী ভয়ঙ্কর ভাবে পেটানো হচ্ছে আমার ওপর দিয়েই। চালকের স্বরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। ‘ভাই আমারে মাইরেন না’ ভাই আমারে মাইরেন না...আল্লাহর দোহাই লাগে’ তার রক্তমাথা মুখ দেখে চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছে।

মাথায় আসছেনা-কী করে একটা অসহায় মানুষকে পেটাচ্ছে অন্য সব ভদ্র (!) মানুষেরা। এমন সময় আমাকে ফেলে দিল একজন। তার ওপর দিয়েই চালককে পেটাতে লাগলো। আমি উঠে দাড়ালাম। লোকটিকে দেখার চেষ্টা করলাম।

হায়, একি দেখলাম। এযে মধ্যবয়স্ক খুবই ভদ্রলোক মার্কা ভদ্রলোক। এমন ভদ্রলোক মার্কা লোক যে, একজন অসহায় মানুষকে পেটাতে পারে তা ভেবে উঠতে পারছিনা। কার কথা ঠিক মনে পড়ছেনা। কোথায় যেন পড়েছিলাম।

অনেক আগে বাংলাভাষীদের নিয়ে কে যেন বলেছিলেন- বাঙালিরা একাকী ভীতু আর অনেকে খুবই ভয়ঙ্কর। এ উক্তিরই যেন সঠিক চিত্রায়ন দেখতে পাচ্ছি এখন। এবার আরো জোর নিয়ে উঠে দাড়ালাম। কিছু একটা করতেই হবে। আমার সঙ্গে কেউ না আসুক।

একা হলেও এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো। সবাইকে আটকানোর চেষ্টা করছি। আমি যখন সবার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি এরই মধ্যে চালকটিও সুযোগ বুঝে বাস থেকে নেমে যেতে সক্ষম হলো। ভাবলাম ‘যাক বাচা গেল। ’ কিন্তু না, সে ভাবনা ছিল কয়েক মুহূর্তের।

যাত্রীদের ক্ষোভ তখনো মেটেনি। চালক পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগে এখন সবাই মিলে আমার ওপর চড়াও হলো। আমিও বলতে থাকলাম--- সবাই মিলে একজন মানুষকে কখনই এভাবে মারতে পারেন না। এটা অন্যায়। মানুষ কখনো মানুষকে এভাবে মারতে পারে না।

একজন বলে উঠলো ‘তাইলে ভাই চুমা দিম নাকি? ওই হা...জাদা যে আমাগো সবাইরে মাইরা ফালাইতেছিল, হেইটার কি হইবো। ‘এরজন্য সামনেই থানা আছে, ডাকলেই পুলিশ আসবে। এসবের বিচারের দায়িত্ব তো আমাদের না’ বললাম আমি। ভদ্রলোকরা কথা বলছে আরো কড়া ভাষায়। একের পর এক প্রশ্ন।

আমিও ছাড়ার পাত্র নই। আমিও বলে যাচ্ছি আমার কথা। এসব ভদ্র(!)লোকদের অন্যায়ের কথা। কে শোনে এসব কথা। অনেক তর্কাতর্কি হলো।

আমি তাদের কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে, সবাই মিলে একজনকে পেটানো কতটা অন্যায়। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বাসার পথ এখনো অনেক বাকি। রাত বাড়ছে। হাঁটা শুরু করলাম।

গাড়ি ভাইঙ্গা ফালান, আগুন লাগাইয়া দেন এমন কথা তখনও শোনা যাচ্ছে। আমার আবার বাসায় ফিরতে হবে। বাসায় ফিরে যাচ্ছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে চালকের রক্তমাখা মুখ। চোখ সিক্ত হয়ে আসছে।

আমি লোকটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। লোকটার ভয়ানক হয়ে যাওয়া রক্তমাখা মুখটা বার বার ভেসে উঠছে। তার যদি অন্যায় হয়েই থাকে তবে তারজন্য এ আচরণ তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রায়ই শুনি গণপিটুনিতে অমুক জায়গায় এত জন নিহত। তমুক জায়গায় এতজনকে পিটিয়ে মেরেছে জনতা(!)।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমরা সভ্য সমাজ বলে পরিচয় দেই। কিন্তু পিটিয়ে মানুষ মারার প্রবণতা কতটা সভ্যতার পরিচয় তা বুঝে আসেনা। সভ্য হলেও বাঙালি সমন্ধে সেই উক্তিটিই বার বার মনে হয়- বাঙালিরা একাকী ভীতু আর অনেকে খুবই ভয়ঙ্কর।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.