রাজাকার ও তাদের বংশধরেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠাই পাবে
স্ত্রী ও তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার হয়েছে জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির প্রধান মওলানা সাইদুর রহমান জাফর। উদ্ধার হয়েছে আত্মঘাতী হামলা চালানোর নানা সরঞ্জামসহ আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, গ্রেনেড তৈরির বিস্ফোরক ও বিপুল পরিমাণ জেহাদী বই। জেএমবিপ্রধান গ্রেফতার হলেও জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম সচল রয়েছে। জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। তারা আত্মঘাতী হামলা চালাতেও সৰম।
জামায়াতের সঙ্গে পুরনো সম্পর্কের জের ধরে জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে। জামায়াতের নামানুসারে জঙ্গী সংগঠনটির নাম রাখা হয় জেএমবি।
মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ জানান, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বিশেষ টিম, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), সিআইডি, ডিবি ও ডিএমপির সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ দল দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। দলটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জেএমবিপ্রধান মওলানা সাইদুর রহমান ও তার সহযোগীদের অবস্থান চিহ্নিত করে। দলটি গত ২৩ মে রাতে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন দনিয়া এলাকায় অভিযান চালায়।
অভিযানে জেএমবি বিশেষ দলটির ওপর হাতে তৈরি গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ৮ পুলিশ সদস্য আহত হন। এ সময় জেএমবির কয়েক সদস্য পালিয়ে যেতে সৰম হয়। কিন্তু স্থানীয়দের সহযোগিতায় জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে নজরুল ওরফে শিবলু দলটির হাতে গ্রেফতার হয়। পরে ওই বাসা থেকে ৯টি হাতে তৈরি শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে জেএমবিপ্রধান গ্রেফতার ॥ গ্রেফতার শিবলুর তথ্য মতে, মঙ্গলবার ভোরে নারায়ণগঞ্জের পাইনাদী এলাকার বাড়ি থেকে জেএমবির সামরিক শাখার সমন্বয়ক আমির হোসেন ওরফে শরীফ ও এহসার সদস্য নূর হোসেন ওরফে সবুজকে গ্রেফতার করা হয়। বাড়িটি গ্রেফতারকৃত সামরিক শাখার সমন্বয়ক আমির হোসেনের। ওই বাড়ি থেকে আত্মঘাতী হামলা চালানোর তাজা গ্রেনেড, বিস্ফোরক, কোমরে গ্রেনেড রাখার বিশেষ বেল্ট, একটি বিদেশী পিস্তল, দু'টি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, জেএমবির সামরিক সদস্যদের তৈরি কিছু গুলি, গুলি তৈরির সরঞ্জাম, লেদ মেশিন, গ্রেনেড রাখার বিশেষ বেল্ট তৈরির উপকরণসহ বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মতে, মঙ্গলবার ভোরে জেএমবির এহসার সদস্য আব্দুল্লাহর রাজধানীর পূর্ব দনিয়ার বাসা থেকে তৃতীয় স্ত্রী নাইমা আক্তার ও সহচর আব্দুল্লাহেল কাফীসহ জেএমবিপ্রধান মওলানা সাইদুর রহমান জাফরকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ সাংগঠনিক জেহাদী বই ও লিফলেট।
জামায়াত কানেকশন ॥ সাইদুর রহমান জাফর ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানাধীন কুজাপুর এলাকার মীরপুরবাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল মতিন। মায়ের নাম রুজোনুন্নেছা। মৌলভীবাজার দারুল উলুম ও সিলেট দরগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যনত্ম ছাত্রশিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন সাইদুর বেশ কিছুদিন জামায়াতের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। । ছাত্রশিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি থাকা অবস্থায়ই ১৯৮০ সালে মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা তরিকুন্নেছার সঙ্গে প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সাইদুর। প্রথম ঘরের শামীম ওরফে সুমন (২৫), নাসিম (১৯), ফাহিম (১৭), বাশার ওরফে নাইম নামে চারপুত্র সনত্মান ও শিরিন নামে এক কন্যাসন্তান রয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রথম স্ত্রীর ঘরের সন্তান বাশার বর্তমানে জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
১৯৮১ সালে জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। ১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর মৌলভীবাজার জেলা শাখার আমির ছিল। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতা থাকা অবস্থায়ই মওলানা সাইদুর রহমানের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ ছিল। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে সাইদুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে জেএমবির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
জঙ্গী গ্রেফতার ॥ জঙ্গী হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর মধ্যবাড্ডা থেকে হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানকে, জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকার সূর্যর্ দীঘল বাড়ি থেকে, ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানাধীন চেচুয়া বাজারের রামপুরা গ্রাম থেকে জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার বানিয়াচালা মেম্বার মসজিদের মেহমানখানা থেকে, আব্দুল আউয়াল ওরফে আদিলকে ২০০৫ সালের ১৮ নবেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সানিকে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদকে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররাম এলাকা থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদকে ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকার একটি বাড়ি থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য ফারম্নক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সিরাজ ওরফে আমজাদকে ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া ডগাইর এলাকার আইডিয়াল পাড়ের ৮ নম্বর বাড়ি থেকে, জেএমবির সামরিক কমান্ডার মোঃ মোহতাসিম বিলস্নাহ ওরফে বশিরকে ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমা মিজানকে ২০০৯ সালের রাজধানীর মিরপুর পীরেরবাগ এলাকা থেকে ও জেএমবির আইটি শাখার প্রধান বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার এমরানুল হক ওরফে রাজীব ওরফে মঈনুল ওরফে আবু তোবা ওরফে ইকবালকে রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে ২০০৯ সালের জুন মাসে গ্রেফতার করা হয়। ঝালাকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ সাইফুল্লাহর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কানেকশন ॥ ২০০১ সালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। বহুল আলোচিত আফগান যুদ্ধে অনত্মত ১২ হাজার বাংলাদেশী অংশ নেয়।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১ হাজার ৮২ ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী ছিল। আফগান ফেরত যোদ্ধারা দেশে ফিরে ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলায় জাগো মুজাহিদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ১৯৯৫ সালের দিকে মুফতি হান্নান অন্তত ৩ হাজার আফগান ফেরত যোদ্ধাকে সংগঠিত করে। সংগঠিত দলটিকে হরকত-উল-জিহাদ অব বাংলাদেশ সংক্ষেপে হুজিবি নাম দেয়া হয়। হুজিবিই পরবর্তীতে হুজি নাম ধারণ করে।
হুজি গঠনে বিএনপি-জামায়াতের একটি অংশ নানাভাবে সহযোগিতা করে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হুজি গঠনে আর্থিক সহায়তা করে। আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় ও পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার জঙ্গীরা হুজি ও জেএমবির সঙ্গে যোগ দেয়। আফগান ফেরত জঙ্গীরা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। পরে মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের পরামর্শে সুনামগঞ্জ জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার পেছনে, নাইক্ষ্যংছড়ি, হিমছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখানবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারের উখিয়াসহ আশপাশের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাদ্রাসার নামে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে।
ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করে মুফতি হান্নান, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইডিপি নামে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের চেষ্টাকারী মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ বিদেশী জঙ্গীরা।
পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ জানান, জেএমবির অর্থের উৎস, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে জেএমবির কি পরিমাণ সদস্য বর্তমানে বাংলাদেশে বা বিদেশে সক্রিয় রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। অবশ্য জেএমবি এখনও সক্রিয় রয়েছে। তাদের আত্মঘাতী হামলা চালানোর ক্ষমতা সম্পর্কে তদন্ত চলছে।
মহিলা আত্মঘাতী স্কোয়াড সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ চলছে।
সাইদুর রহমান জেএমবিতে যোগ দেয়ার পর জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ আরও বেড়ে যায়। সেই পুরনো সম্পর্কের জের ধরে এখনও জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ রয়েছে। জামায়াতের নামের আদলেই জঙ্গী সংগঠনটির নাম রাখা হয় জেএমবি। জেএমবি বিগত দিনের মতো এখনও জামায়াতের কাছ থেকে নানাভাবে সহায়তা পেয়ে আসছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।