জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন চার দিন ধরে অবরুদ্ধ থাকার পর গতকাল আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করেছেন এবং তদন্ত কমিটি গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে শিক্ষকেরা তাঁদের মূল দাবি থেকে এখনো সরে যাননি। হয়তো কিছুটা সময় দিতে পারেন। একটা বিশ্ববিদ্যালয়, যার সঙ্গে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জড়িত, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসের পর মাস অচলাবস্থা চলা দুর্ভাগ্যজনক।
এর আগে বর্তমান সরকারের আমলেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ, অবরোধ, ধর্মঘট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
কোনোটিতে শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। কোথাও উপাচার্য, কোথাও সহ-উপাচার্য অপমানজনকভাবে বিদায় নিয়েছেন। কোথাও বা আন্দোলনকারীরা পিছু হটেছেন।
জাহাঙ্গীরনগরের বর্তমান উপাচার্যকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারই নিয়োগ দিয়েছে। আবার যেসব শিক্ষক আন্দোলনের নামে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, তাঁদের বড় অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক।
তাই, বুয়েটের মতো আন্দোলনকারীদের জামায়াত-মৌলবাদী আখ্যায়িত করা যাবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখন তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ উপাচার্যের সঙ্গে আছে, আরেক ভাগ উপাচার্যের বিরুদ্ধে, তৃতীয় ভাগ উপাচার্য ও অবরোধকারী শিক্ষকদের মাঝামাঝি অবস্থানে। তারা উপাচার্যকে সময় দেওয়া এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পক্ষপাতী।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহাম্মদ আবদুল জলিল মিয়া বিদায়ের আগে ৩৩৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেন, যাঁদের মধ্যে তাঁর একাধিক নিকটাত্মীয়ও ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কীভাবে এই অনৈতিক কাজ করতে পারেন? রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির অনুমোদিত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৩৩৬। কিন্তু জলিল মিয়া সেই সংখ্যা বাড়িয়ে করেছেন ৬৭৪। অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জুন মাসে শেষ হওয়ার পর এখন তাঁরা ধর্মঘটে নেমেছেন। নতুন উপাচার্যকে এক দিন দেড় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। যদিও অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ী করার ব্যাপারে তাঁর কিছু করার নেই।
ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া তিনি কাউকে বেতন-ভাতা দিতে পারবেন না। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষাকেই অবরুদ্ধ করে রেখেছে। দুর্ভাগ্য যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জলিল মিয়াদের সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অবরোধ অবস্থা চলছে, তা হয়তো একসময় কেটে যাবে। বরাবরের মতো সরকার বা আচার্য ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে ফিরে যাবেন। আবার নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কোনো ইস্যুতে অবরোধ চলবে। ধর্মঘট ডাকা হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য লোক বসাবে না (ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলছি না)। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেবে না।
নতুন নেতৃত্ব গড়বে না। ‘আদুভাইদের’ দিয়ে ছাত্রসংগঠন চালাবে। নেতা-নেত্রীরা তাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
দুই
আগামী নির্বাচন নিয়ে গোটা দেশে যে অনিশ্চয়তা ও অবরোধ অবস্থা চলছে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এই অবরোধ হলো সন্দেহ ও অবিশ্বাসের। এই অবরোধ হলো শঙ্কা ও ভয়ের।
এই অবরোধ হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার। সম্ভাব্য সংঘাত ও সংঘর্ষের। এই অবরোধ হলো একগুঁয়েমি ও আত্মম্ভরিতার। এই অবরোধ হলো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের। এই অবরোধ হলো ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর।
এই অবরোধ হলো দুর্নীতি ও দখলবাজির।
এসবের বিপরীতে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মহৎ কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেননি, পারছেন না। সুড়ঙ্গের শেষে কোনো আলো দেখাতে পারছেন না। এ কারণেই দেশের মানুষ গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে। বিদেশিরা শান্তির ললিত বাণী শোনাচ্ছেন।
দূত পাঠাচ্ছেন। রাষ্ট্রদূতেরা নিয়মিত সবক দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে জনগণের অসহায়ত্ব ও অবরোধ অবস্থা কাটছে না। কেউ বলতে পারছেন না, নির্বাচনটি কীভাবে হবে? কবে হবে? আদৌ হবে কি না? নির্বাচন না হলে কী হবে? ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ শঙ্কা ও ভয়ে আছেন। দুশ্চিন্তা করছেন।
কিন্তু দলবাজেরা বলছেন, ও কিচ্ছু না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংকটটি উপলব্ধি করছেন বলে মনে হয় না। দুই পক্ষই গোঁ ধরে বসেছে, ‘তালগাছ আমার। ’ তারা নিজেদের মতো করে সবকিছু করতে চাইছে। একে অপরের বিরুদ্ধে রণহুংকার ছাড়ছে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান শর্তই হলো দলমত-নির্বিশেষে সবাই আইন মেনে চলবে এবং আইনের সুরক্ষা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই সেটি অনুপস্থিত। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন এবং ভবিষ্যতে যাবেন বলে আশা করেন, তাঁরা কেউই আইন মানেন না। মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আইন মানবে সাধারণ মানুষ, বিচার হবে আমজনতার।
তাঁদের মতো অসাধারণেরা কেন আইন মানবেন? কেন বিচারের মুখোমুখি হবেন? আইন তাঁরা তৈরি করবেন, কিন্তু মানবেন না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা।
আইনের শাসনের প্রধান অন্তরায় হলো অপরাধের বিচার না হওয়া এবং অপরাধী শাস্তি না পাওয়া। আইনের অতন্দ্রপ্রহরী সরকার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার দোহাই দিয়ে গত সাড়ে চার বছরে সাত হাজার ১৭৩টি মামলা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক প্রত্যাহার করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। বিএনপির সরকার পাঁচ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে বিনা বিচারে ৭৩ হাজার ৫৪১ জন লোককে খালাস দিয়েছিল।
এবারে খালাসের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এর মাধ্যমে দুই সরকারই ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। মন্দ কাজে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক। এ আমলের অভিজ্ঞতা ওই আমলের কুশীলবেরা যথাসাধ্য কাজে লাগান।
বাংলাদেশে এখন সর্বত্রই অবরোধ।
ঘরে-বাইরে, ট্রেনে, বাসে, স্টেশনে, টার্মিনালে—সর্বত্র সাধারণ মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। বাসযাত্রীরা মালিকদের কাছে অবরুদ্ধ। বাসমালিকেরা মহাপ্রতাপশালী চাঁদাবাজের কাছে অসহায় (নারায়ণগঞ্জের বাসমালিকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, শামীম ওসমানের শ্যালককে চাঁদা দিতে না হলে তাঁরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ভাড়া কমাতে পারতেন। এই চাঁদাবাজকে কি সরকার চেনে না? অবশ্যই চেনে। ধরছে না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কেবল সাধারণ মানুষ নয়, সরকারও চাঁদাবাজদের কাছে অবরুদ্ধ ও অসহায়। দেশের মানুষ তো চাঁদাবাজের কাছে অবরুদ্ধ থাকা সরকার চায় না। তারা সেই সরকারই চায়, যারা চাঁদাবাজদের অবরোধ থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে সাধারণ ক্রেতারা পাইকারদের কাছে অবরুদ্ধ। পাইকারেরা মজুতদারের কাছে অবরুদ্ধ।
কৃষকেরা মহাজনের কাছে অবরুদ্ধ। খুদে ঋণগ্রহীতারা এনজিওগুলোর কাছে অবরুদ্ধ। বাক্স্বাধীনতা দমনকারীদের কাছে অবরুদ্ধ। পবিত্র ধর্ম ফতোয়াবাজদের কাছে অবরুদ্ধ। সেবাপ্রার্থীরাসেবাদানকারীদের কাছে অবরুদ্ধ।
সম্প্রতি ঢাকার বাসিন্দাদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ঘুষ দিয়েও পুলিশের কাছ থেকে সেবা পেয়ে তারা খুশি! অর্থাৎ এখানে ঘুষই ত্রাতা হিসেবে কাজ করছে।
সামনে ঘোর অন্ধকার। একটি বা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অবরুদ্ধ থাকলে সরকারকে বলা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাঠিয়ে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে এখনই তাঁদের মুক্ত করো। কিন্তু গোটা দেশই যখন সংঘাত-সংঘর্ষ-জঙ্গিবাদের কাছে অবরুদ্ধ থাকে, যখন চারদিকে ঘোর অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন প্রতিকার চাওয়ার ইচ্ছাও মানুষ হারিয়ে ফেলে।
দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানদের কাছে অবরুদ্ধ।
ন্যায় অন্যায়ের কাছে অবরুদ্ধ। ভালোবাসা স্বার্থের কাছে অবরুদ্ধ। মানবতা বর্বরতার কাছে অবরুদ্ধ। সততা অসততার কাছে অবরুদ্ধ। স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের কাছে অবরুদ্ধ।
আর গণতন্ত্র পুরোপুরি দলতন্ত্রের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
এই অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে উদ্ধারের উপায় কী? আমি জানি না। প্রিয় পাঠক, আপনারা জানেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।