ছোটবেলায় মামা বাড়ি যাওয়া কার না পছন্দের। আর আমাদের তো জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে মামা বাড়িতে। সেখানে যেতে পারলে মনে করতাম আকাশের চাঁদটা হাতের মুঠোয় পেয়েছি।
দাদা দাদীর কথা তেমন মনে পরেনা। আদর ভালবাসার কথা মনে পড়লে বাবা মার পরেই যার কথা মনে আসে সে আমার নানী।
তিনি আজ নেই। অনেকদিন আগেই চলে গেছেন আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে তার কথা আজ বলব না । আজ এমন এক মানুষের কথা বলব যিনি ছিলেন আমার ছোটবেলার খলনায়ক। খলনায়ক বললাম এজন্যেই যে তার আদর আর স্নেহের ধরনটা ভিন্ন রকম হওয়ায় আমার শিশুমন তাকে শত্রু জ্ঞানই করত।
আমার মনে আছে ছেলেবেলার সে দিন গুলোতে আমার মনের আদালতে তাক আসামি বনিয়ে কতবার তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি। তিনি আমার বড় মামা। আমার মায়ের অনুজ্। আমরা মামা বাড়িতে গেলেই মামা আমাদের জিজ্ঞাসা করতেন -কার বাড়িতে এসছে? আমরা তো তোমাদের আত্মীয় নই। আনেক কে আবার ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন , দেখেন তো এ বাচ্চাটাকে চিনতে পারেন কিনা?।
শুধু আমি একা নই আমাদের সব খালাত মামাত ভাইবোনদের তিনি সাথে তিনি এমন করে ইয়ার্কি করতেন। আর আমরা সবাই একসাথে কেঁদে ফেলতাম। গালি দিতাম মামাকে । আবার অনেক সময় বলতাম আপনিই এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। নানী এসব নিয়ে মামাকে কত বকতেন।
কিন্তু মামার আদর করবার ধরণটাই এ রকম ছিল। তারপর যখন একটু একটু করে বুঝতে শিখলাম তখন বুঝলাম বড় মামা আসলে বাচ্চাদের খুউব ভালবাসেন । কেননা মতের অমিল হবার জন্য প্রায়ই মামা আর আমার বাবার মধ্যে ঝগড়া মন কষাকষি লেগে যেত। তাছাড়া আমার মামা ছিলেন অতি সাবধানী আর বিষয় আসয় জ্ঞানী একজন মানুষ। সবসময় জমিজমা আর বিষয় সম্পত্তি নিয়ে বেশি চিন্তা করতেন ।
তবে আমাদের ব্যপারে তার ভালবাসা ছিল অকৃতিম।
আবার এও দেখেছি এতটা হিসেবী মানুষটা গ্রামের বা আত্মীয় স্বজন কারও বিপদের কথা শুনলে এগিয়ে আসতেন সবার আগে। ছোটবেলায় দেখেছি মামা অনেক রাতে বাড়ি ফিরলেও খুব ভোরে গ্রামের গরীব আর বিদগ্রস্থ মানুষরা তাকে ডেকে তুলত । মামা সবার বিপদে পাশে দাঁড়াতেন। এ কারনে গ্রামের গরীব মানুষেরা সবসময় মামার পিছু লেগে থাকত।
কোথায় কে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেনা কোথায় কার মেয়েকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য নির্যাতন করল এসব ব্যাপারে মামা সবসময় গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে আছেন। কারও অসুখে বিসুখে মামা থাকতেন সবার আগে। নিজের কাজ ফেলে দিনের পর দিন হাসপাতালে গ্রামের রোগীদের পাশে থাকতেন। এ কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষ গুলোর সুখের সময় এ নাহক অন্তত দুখের সময় বড় মামা ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়।
মামার অনেক আচরনে আমিও তার উপর সব সময় খুশি থাকতে পারতাম না।
মাঝে মাঝে অভিমান করতাম তার অতি বিষয় সম্পদ এর লোভ আর এগুলো আগলে রাখার তীব্র বাসানার কারনে । মামা প্রায়ই জমিজমা কিনতে তার অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বলতেন আর বলতেন যে জমি করে সেই বোঝে এর কি মায়া। তখন বুঝতাম না আজ বুঝি মামা এগুলো আগলে রাখতে চাইতেন বোধহয় এজন্যই যে তিনি বেশীদিন ধরে এগুলো ভোগ করতে পারবেন না। মামাকে কত বলতাম মামা জমিজমা দিয়ে কি হবে? মরে গেলেই তো সব শেষ । মামা মুখে মানলেও মনেমনে বোধহয় মানতে পারতেন না।
কিন্তু কে জানত মামা এসব ছেড়ে সবার আগে চলে যাবেন । গত ৩০ মার্চ ২০১০ মামা চলে যান । সুস্থ সবল একজন মানুষ মাত্র একদিনের জ্বরে ভুগে অসীমের পথে পাড়ি জমিয়েছেন । তার প্রিয় ভিটেমাটি ছেরে , আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে, সবাইকে নির্বাক করে দিয়ে আর চোখের জ্বলে ভাসিয়ে।
আজ বুঝতে পারি, এত অপ্রিয় এ মানুষটির জন্য বুকের কোথায় জানি এত টান লুকিয়ে ছিল।
তাকে যে এত ভালবাসতাম বুঝলাম যেদিন শুনলাম তিনি আর নেই। আজ খুব মনে পড়ল তার কথা । এখন আমি আর মামার ভিটেমাটিগুলোর দিকে আর তাকাতে পারিনা। আমার চোখ ফেটে জ্বল আসে। ভাবি, এত সংক্ষিপ্ত জীবন নিয়ে পৃথিবীতে এসে মানুষ কেন এত বাঁধন তৈরি করতে চায়?।
কাছের মানুষ গুলো চলে গেলে পৃথিবীটা কেমন জানি পরপর লাগে। আজ আমি তার মত কাছের মানুষকে হারিয়ে এটা গভীরভাবে বুঝি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।