আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভেনিস আমার স্বপ্নের ভেনিস (২য় পর্ব)

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
সান মার্কো গীর্জার খিলানে বিখ্যাত শিল্পী লিবোরিও সালান্দ্রির মোজাইক শিল্পকর্ম অল্প কথায় ভেনিসের ভৌগলিক ইতিহাস চারদিক থেকে জলবেস্টিত ছোটো ছোটো দ্বীপের সমন্বয়ে সৃষ্ট অপরূপা ভেনিস, জালের মত ছোট্ ছোট্ খাল দিয়ে তারা একে অপরের সাথে বিচ্ছিন্ন। আবার ৩৬৫ টি ছোট্ ছোট্ সেতু বন্ধনে তারা একে অন্যের সাথে আবদ্ধ। বর্বর রা যখন ইতালীর উত্তর ভাগে আক্রমন চালায় তখন স্পাইনা ,আদ্রিয়া, আলতিনো,প্রভৃতি বিভিন্ন নগরী থেকে পালিয়ে আসা উদবাস্তরা আশ্রয় নেয় এই ক্ষুদ্র দ্বীপ গুলোতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের নিরলস প্রচেস্টার মাধ্যমে ভেনিস পরিনত হয় বিশ্বের এক বিষ্ময় নগরীতে যা পত্তন করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটেছে অনেক খালের। আর বেচে আছে যারা তাদের মধ্যে দীর্ঘতম হলো গ্র্যান্ড ক্যানেল।

এর থেকে বেরিয়েছে ৪৫টি ছোট ছোট শাখা ভেনিসিবাসীরা বলে রি (rii), যাতে শুধু স্পীডবোট আর গন্ডোলা চলে। প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রস্হে বিভিন্ন স্হানে ৩০ থেকে ৭০ মিটার পর্যন্ত চওড়া গ্র্যান্ড ক্যানেল পুরো শহর টিকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। তবে তিনটি সেতু বন্ধনে এরা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। রেল স্টেশন থেকে বেরোলেই যে সেতু তার নাম bridge of scalzi ,এরপর আকাডেমিয়া এবং সবশেষে বিখ্যাত রিয়াল্টো। scalzi সেতু পেরিয়েই এক মিনিটের হাটা পথে সরাইখানার সন্ধান পেলাম।

স্টেশনেই বিভিন্ন হোটেল প্রতিনিধি রা দাড়িয়ে থাকে তাদের মাধ্যমে একটি চিন্তার অবসান হলো। মধ্যম মানের হোটেল কিন্ত ডাবল বেডের জন্য অনেক ভাড়া গুনতে হলো। ওরাও বুঝেছে আমরা সমস্যায়। যাক এসব খুটিনাটি সমস্যার কথা। হোটেলে ব্যাগ রেখেই দৌড়ে আসলাম রেলস্টেশনের কাছে।

ভীষন ক্ষিদে পেয়েছিল দোকান থেকে দুজন দুটো পিজা নিলাম। যথারীতি দু টুকরো মুখে দিয়ে তার গন্তব্য হলো ময়লা ফেলার বিনে। ঘুরেই দেখলাম বাস স্টেশন! ফেরোভিয়া অর্থ স্টেশন। ওখান থেকে যে একতালা নৌযানগুলো ছেড়ে যাচ্ছে, তাকে বলে ভেপোরেট্টো অর্থ বাস যাতে অনেক লোক চড়তে পারে, আর স্পীড বোট কে ওরা বলে কার। ওগুলো রেন্ট এ কারের মত ভাড়া পাওয়া যায়।

আর যারা ধনী তাদের ব্যাক্তিগত স্পীডবোট গুলোকে বলছে প্রাইভেট কার,কি আশ্চর্য!! ভাবলাম বাসে করে পুরো ক্যানেলটা একটা চক্কর দিয়ে আসি তারপর ধীরে সুস্হে সব দেখা যাবে। আমি অত্যন্ত চন্চল । আমার স্বামী তেমনি ধীরস্হির। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলাম। কিন্ত যে পথ দিয়ে ভেপোরেট্টো যাচ্ছে তা গ্র্যান্ড ক্যানেল দিয়ে যাবার বিপরীত পথে, লিডো আর ভেনিসের প্রধান দ্বীপের মাঝখান দিয়ে।

দুরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছিনা । বড় বড় ওশেন লাইনার গুলো এখানে চলছে। মনে হচ্ছে সমুদ্র বন্দর। এখানে কিন্ত বেশ ঢেউ । আমার ভীষন ভয় করছিল।

কারন সাতার আমি জানিনা। সান মার্কো প্লাজা যেতে যেতে দুর থেকেই চোখে পড়লো ভেনিসের অন্যতম প্রধান আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু প্লাজা সান মার্কো। আমাদের কথা ছিল বাসে করে একটা চক্কর দিয়ে হোটেলে ফিরে যাবো, কিন্ত সেই প্লাজা স্টেশনে বাস থামতেই আমি ওকে বল্লাম, 'চল এখানেই নামি এটাই তো সেই বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র যা আমি ছবি ও সিনেমাতে অনেক দেখেছি আর ভ্রমন কাহিনীতেও অনেক পড়েছি'। ও আর কি বলবে, নামলাম। পাথর দিয়ে বাধানো চত্বর দিয়ে প্রবেশ করলাম।

এই সেই বিশ্বখ্যাত প্লাজা সান মার্কো। দুদিকে দুটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের মাঝে অপরূপ কারূকার্য মন্ডিত সান মার্কো গীর্জা যার একটি দিক সুদুর সমুদ্রের পানে চেয়ে আছে। ঐ চত্বরেই অবস্হান করছে ইতালীয় তথা ভেনিজিয় স্হাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন সমূহ,যেমনঃ ভেনিসের শাসক ডজের প্রাসাদ, সান মার্কোর গীর্জার সুউচ্চ ঘন্টা ঘর (বেল ফ্রাই)এবং ঘড়ির মিনার। আমি অপূর্ব বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছি আমার কল্পনার জগতে বিচরনরত স্হাপত্যকলার নিদর্শন গুলোর দিকে । সান মার্কো গীর্জার ঘন্টা ঘর বা বেল ফ্রাই।

গীর্জার প্রধান প্রবেশ পথে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো বহুদুর থেকে দৃশ্যমান ভেনিসের প্রতীক চিন্হ সেই ঘন্টা ঘর বা মিনার যা একশ মিটার উচু। নবম শতাব্দীতে প্রথম তৈরী হলেও বিভিন্ন কারনে বিধ্ধস্ত হওয়া এই মিনার শেষ বারের মত তৈরী হয় ১৯১২ সালে। গীর্জার ঘন্টা বেজে ওঠার এই ঘর থেকেই গ্যালিলিওর চোখের সামনে তার আবিস্কৃত টেলিস্কোপের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল পুরো ভেনিস নগরী এমনকি সুদুর আল্প্‌স পর্বতমালা পর্যন্ত। ঘড়ির মিনার ভেনিসের অন্যতম চিত্রাংকিত মনুমেন্ট। যাতে রয়েছে এক বিশাল ঘড়ি যা পনেরশ শতাব্দীতে তৈরী।

এই ঘড়ির ডায়ালে রয়েছে বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন এবং বিভিন্ন রাশির উপর চাঁদ ও সূর্যের পরিক্র্রমন। ঘড়িটিতে এক ঘন্টা পরপর ছাদের উপর ব্রোন্জের তৈরী দুজন মুর দুদিক থেকে বিশাল এক ব্রোন্জের ঘন্টায় আঘাত করে সময় ঘোষনা করছে। ঘন্টা বাজানোর দৃশ্যটি দেখার জন্য বহু ট্যুরিস্টই অপেক্ষায় থাকে। আমরাও শুনলাম সেই ঘন্টার ধ্বনি। সান মার্কো গীর্জা এই অপূর্ব কারুকার্য খচিত বিখ্যাত গীর্জাটি ভেনিসের রাস্ট্রীয় মঠই শুধু নয় এটা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতারও একটি নিদর্শন।

সামনের দিকে পাঁচটি প্রবেশ পথ পাঁচটি গম্বুজের সাথে মিলিযে তৈরী। প্রধান প্রবেশ পথের উপর লিবিরিও সালান্দ্রির অপূর্ব মোজাইকের চিত্রকর্ম। এখানে ঢোকার জন্য ড্রেস কোড আছে। ছেলে মেয়ে উভয়েরই হাতাকাটা গেন্জী এবং হাফপ্যান্ট পড়ে ঢোকা নিষেধ। আমরা ঢুকলাম বিনা বাধায়, আর অনেক ট্যুরিস্ট কারো কাছ থেকে চাদর নিয়ে হাত পা ঢেকে প্রবেশ করছে! ভেতরে ঢুকলাম বিশাল আর অন্যান্য গীর্জার মতই ।

মোমবাতি জ্বলছে,বেশ অন্ধকার অন্ধকার। ছাদে সোনালী কারুকাজ এবং ঐ রংয়েই ভেনিসের বিখ্যাত শিল্পী দের আকা সব ছবি। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত, ওখানেই ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকলাম বসার জায়গা নেই, মানুষ গিজ গিজ করছে। খাবার নিয়ে বাইরে বারান্দায় মাটিতে বসে পা ছড়িয়ে খাচ্ছি আরও পর্যটকের মতন, এমন সময় ১৮/২০ বছরের একটা ছেলে কেমন নেশাখোরের মতন চেহারা, ছো মেরে আমার সামনে রাখা কোকের ক্যানটা নিয়ে চলে গেল। আমি কেমন হতবাক হয়ে গেলাম।

তাকিয়ে দেখলাম আরও কয়েকজনের খাবারও এভাবে ছিনতাই হলো। খাওয়া শেষে ওখানকার স্যূভেনির শপ গুলোতে ঢুকতেই দেখলাম বিখ্যাত মুরানো কাচের তৈরী চোখ ঝলসে যাওয়া এক একটা সামগ্রী। দাম আকাশ ছোয়া। তার মাঝখান থেকেই ছোটো খাটো দু একটা জিনিস টোকেন হিসেবে কেনার সৌভাগ্য হলো। মুরানো কাচের হাতে তৈরী ফ্রস্টেড আঙুরের গুচ্ছ।

সান মার্কো প্লাজা স্যুভেনীর শপ থেকে কেনা। মুরানো কাচের হাতে তৈরী ছোট পেয়ালা। সান মার্কো প্লাজা শপ থেকে কেনা। সন্ধ্যা হয়ে গেল। জলবাস ধরে হোটেলে ফিরেই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হোলাম।

রেল স্টেশনের পেছনেই শান বাধানো চত্বর, যেখান থেকে সিড়িগুলো ধাপে ধাপে নেমে গেছে গ্র্যান্ড ক্যানেলের ঠান্ডা পানিতে, তাতে হেটে হেটে ফুলে উঠা পা দুটো ডুবিয়ে বসে রইলাম আরো শত শত পর্যটকের সাথে,অনেক রাত পর্যন্ত। ঢেউ এসে বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে পায়ের পাতায়, আর সারাদিন গরমে ঘোরা ক্লান্ত শরীর, পানির উপর দিয়ে ভেসে আসা শিরশিরে ঠান্ডা বাতাসে যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ি। কাল যাবো ডজেস প্যালেস, আকাডেমিয়ায় বিখ্যাত শিল্পী দের আঁকা ছবি আর ভেনিসের অন্যতম নিদর্শন রিয়াল্টো ব্রীজ দেখতে। সঙ্গে থাকুন।

চলবে------। Click This Link তৃতীয় পর্ব।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.