ফেরী থামতেই লাফিয়ে নামলাম জেটিতে। সামনে এক মহিলা মূর্তি। তার সাদা মাথা দেখে বোঝা গেল সবদেশেই কাক - পক্ষীদের এই মূর্তিগুলো বিশেষ পছন্দের। কংক্রীটে বাঁধানো সরু গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দেখি একটা নীল আর একটা সাদা বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
বাড়িগুলোর নীচে দোকান। অতিসূক্ষ সুতোর কাজের জিনিস সব বিক্রী হচ্ছে। রুমাল, ছাতা, ফ্রক আরো কত কি। আমার স্ত্রীর তখন কেনা-কাটা রোগ ধরেছে। দোকান দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ছে।
কোনোমতে তাকে টেনে বগলদাবা করে সামনে পাড়ি দিলাম। গলি শেষ হতেই দেখি একটা খাঁড়ি ঢুকে এসেছে। তার দুদিকে সরু রাস্তা। জলে প্রচুর কাঠের লগি গাঁথা। তাতে ছোটো ছোটো নৌকা বাঁধা।
প্রতিটি বাড়ির সামনে একটি করে নৌকা। ব্যক্তিগত। পাশাপাশি দুটো বাড়ির রং কখনই এক নয়।
বুরানো এই ঝলমলে, রঙিন, পুচকি বাড়িগুলোর জন্যই ভুবনবিখ্যাত। চিত্রশিল্পিদের কাছে স্বপ্নের সাবজেক্ট।
কেউ যদি এখানে বাড়ি রঙ করাতে চায়, তাকে সরকারের কাছে চিঠি পাঠাতে হয়। সরকার তাকে রঙ সাজেস্ট করে দেয়।
শুধু রঙ নয়। বেশীরভাগ বাড়ির কলিংবেল বা দরজার কড়াগুলিও নজরকাড়া। পেতল, স্টীল বা অন্যান্য ধাতুর তৈরী।
কোথাও সিংহের মুখে, কোথাও বা হাতির শুঁড়ের সাথে ঝুলছে কড়া। বাড়িগুলো সব একই ধাঁচের। বাইরে থেকে দেখে ধনী - দরিদ্র বোঝার উপায় নেই। তবে এখানকার বেশীরভাগ বাসিন্দাই মৎস্যজীবি।
খাঁড়ির ওপর ছোটো ছোটো কাঠের পুল।
নীচে টলটলে জল। আগের রাতে বরফ পড়েছে। মিছরির দানার মতো বরফের টুকরো ব্রীজের কাঠের ওপরে ছড়িয়ে আছে।
আমরা ছবি তুলছি। তুলছি তো তুলছিই।
সেই এক-একটা জায়গা থাকে না যেখানে ভিউফাইন্ডারে চোখ না রেখে হাতে ক্যামেরা নিয়ে যেদিকে খুশী লেন্স করে ক্লিক করে গেলেই অসাধারন সব ফ্রেম ধরা পড়ে যায়। এটাও সেরকমই এক জায়গা।
এ গলি - সে গলি ঘুরছি। সূর্যের আলোর সাথে খেলছি লুকোচুরি। কোথাও পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে লোমে ঢাকা গোল্লা কুকুর।
নীল বাড়ির গায়ে রঙমিলান্তি খেলছি গায়ে চাপানো নীল টি-শার্টের সৌজন্যে।
সময় পেরোয়। ফেরার মন ফিরতে চায় না। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা থামাবার ক্ষমতা কারোর নেই। ফিরতি ফেরীতে চাপি।
মুরানো হয়ে ভেনিস। যাওয়ার আগে আরেকবার রিয়াল্টো, জলে ভেসে বেড়ানো অগুনতি গন্ডোলা, মাঝির উদাত্ত গলায় গান, আরেকবার মার্কাস স্কোয়ার, পায়রা সরিয়ে এ কোনা থেকে ও কোনা চক্কর, রহস্য আর ইতিহাস পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা রাস্তা আর খালগুলো - সব দেখতে হবে যে।
বিকেল ৪:৩০। সেই সমুদ্র দমানো ব্রীজের ওপর দিয়ে চলছে আমাদের ইউরো রেল। ফিরছি তুষার ঢাকা, সাদা ওড়না পরা সুইজারল্যান্ডে।
পিছনে আস্তে আস্তে মিলিয়ে আসে সুন্দরী, বিদূষী ভেনিস। মনে মনে শপথ নিই। মৌ আমার হাত ধরে ওপাশের সিট থেকেই। আমার মনের কথাটা ভাষা পায় ওর মুখে - "মরার আগে আরেকবার আসতে হবেই এখানে, একটু বেশি সময় নিয়ে"!
সেই দিনটা অবধি বিদায় ভেনিস, সেই দিনটা অবধি তুমি থাকবে আমাদের বুকের মাঝে, আমাদের "সেনিওরিটা" হয়ে.... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।