আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
বাংলাদেশের বাঙালিরা সারাজীবন নিরপেক্ষ ও মধ্যবর্তী অবস্থান ভালবেসেছে। নিরপেক্ষতাই তাদের প্রথম ও শেষ প্রেম। চরম ও পরম আদর্শ। তারা না চরম ডান, না চরম বাম। তারা না পরম ধার্মিক, না চরম উদারনৈতিক।
এই মনোভাব, মানসিকতার স্পষ্ট প্রতিফলন চোখে পড়ে বাঙালির পেশাগত জীবনেও। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পণ্ডিত হতে তাদের মাঝে প্রচ্ছন্ন অনিচ্ছা দেখা যায়; তারা হতে চায় সকল বাণিজ্যের বণিক, সকল খেলার খেলোয়াড়, সর্ব গুণে গুণী! বাংলায় পণ্ডিত শব্দটি পর্যন্ত ক্ষেত্র-বিশেষে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়; অনেকটা গালির মত; যেমন “পণ্ডিত কোথাকার!”, “চুপ কর পণ্ডিত”, “মাস্টর হইয়া গেছ?” ইত্যাদি। আর এই চরিত্রের ধারক বাঙালি ও সকল বাংলাদেশী।
এই বাংলাদেশও হয়ত তাই জন্ম দিয়েছে এমন রাজনৈতিক সব দলের যাদের আদর্শের ভেতর বোল্ড অবস্থায় বেশ কিছু বড় অক্ষরের ‘কিন্তু’ আছে। মাওলানা ভাসানীর চীনপন্থি ন্যাপ কি মুজিবের গণতন্ত্রের আওয়ামীলীগ; ব্যক্তি জীবনে জিয়া কিংবা এরশাদ ‘ধার্মিক’ ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাদের রক্ষণশীল, যথাক্রমে, বিএনপি কি জাতীয় পার্টি, কি এই মডার্ন জামাত-শিবির, তারা কে আসলে ঝেড়ে কেশে দেখিয়েছে? আজীবন খুচখুচে কাশি লালন করে এরা বার্ধক্যে উপনীত হয়ে বাংলা সিনেমার নায়িকার বাবার মত কাশতে কাশতে ছেলের বাবার হাতে কিছু ডায়লগ সমেত নায়িকার দেখাশুনার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে শেষ কাশি দিয়ে পগারপার হয়েছেন।
তাদের মাঝে যে অসাম্প্রদায়িক ছিল, প্রমাণ মেলে সে আবার সাম্প্রদায়িকও ছিল। যে গোঁড়া ধার্মিক, সেই আবার উদারনৈতিক! যার দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, তারই আবার দালাল খিদমতে অবদান ঋদ্ধ। কারণ আদর্শকে প্রতিষ্ঠা নয়, তাদের লক্ষ্য ছিল দ্বৈত চরিত্রের বাঙালির সমর্থন অর্জন, ভোট আদায় এবং যে কোনও তরিকায় ক্ষমতায় আসীন হওয়া। দলগুলো আর দল নেই, পরিণত হয়েছে হরেক রকম আদর্শের সমাহারে সাজানো মনোহারী দোকানে। আর এই করতে গিয়ে তাদের সত্যিকারের আদর্শ পেঁচিয়ে গেছে মার্কেটিংয়ের নাড়িভুঁড়ির সাথে।
কেউবা তা লুকিয়ে রেখেছে মূলনীতির মলাটের পিছনে।
কেন আমাদের মাঝে সংগতির এত সংঘর্ষ? আশাতীত স্বাধীনতার প্রাপ্তিই কি আমাদের হৃদয়ে অসহনীয় কিছুর জন্ম দিয়েছিল যে মুক্তি এনে দেওয়া নায়কেরা পাকিস্তানের স্তুতিগানের গায়ককে এনে প্রেস অফিসার করেছিলেন? স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের জন্য গতর খেটেছিল বলে পুরস্কার পাওয়া বেঈমানদের সরাসরি বাংলাদেশে এনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন? স্বয়ং বীর মুক্তিযোদ্ধারাই সকল লাজলজ্জার বাঁধ ভেঙে দিয়ে, নিজ গরিমার দায়ের মুক্তি নিয়ে এক পর্যায়ে দালাল দ্বারাই দল গঠন করে নিয়েছিলেন! অতঃপর উত্তরসূরি-গণ যথেষ্ট প্রমাণ সমেত একে অপরকে দালাল আশ্রয়দাতা/দাত্রী দাবী করে, দুষে, স্বামী পিতার নামের কারণে সকলের প্রশ্রয়ে, ছলচাতুরী, শঠতার আশ্রয়ে, প্রয়োজনে নিজেদের ভেতরে আঁতাত করে দল ও দেশ চালিয়ে এসেছে পালাক্রমে। এভাবে তারাও যেমন তুষ্ট ছিল; মানসিক দিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পেরে বাংলাদেশীরাও তেমন সন্তুষ্ট ছিল।
কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুরুর হওয়ার মধ্য দিয়ে হঠাৎই যেন অনেক কিছু পাল্টে গেছে। যদিও সাধারণ সুশীল মধ্যবিত্ত মানসিকতায় তৃপ্ত মানুষের পুণরায় তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের নিরপেক্ষ অবস্থানটিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় খামতি নাই।
কিন্তু বিচার শুরুর সাথে সাথে অস্তিত্বগত বিপাকে পড়েছে যারা, তারা বাধ্য হয়েছে স্ববিরোধী খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। তাদের রকমারি পণ্যে বোঝাই পশরার পেছনে লুকোনো পাকিস্তানী আদর্শের গুদামের মুখ উন্মোচিত হয়ে গেছে বলেই বেপর্দা হয়ে আজ তারা বেগানা তির্যক অঙ্গুলির সম্মুখেই বেহায়া অঙ্গবিক্ষেপ করছে। এই ডামাডোলে, জাতিগত, অস্তিত্বগত কারণে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ববহ একটি মোড়ে এসে উপস্থিত হয়েছি; কিন্তু এর ঠাহর আমরা এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি।
জাতির, মুক্তিযুদ্ধের জয় আর পরবর্তী হত্যাযজ্ঞের পরাজয় থেকে যদি আজও শিক্ষা না নেই, তবে অচিরেই দীক্ষা নিতে হবে মধ্যযুগের। এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশীরা যদি নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু, “শিশু-পাগল স্বরূপ নিরপেক্ষ হতে চাওয়ার চেষ্টা” থেকে সরে আসতে না পারে তবে তাদের পূর্বের শান্তিপূর্ণ পর্যায়টিতে তো ফিরে যাওয়া আর হবেই না, বরং যন্ত্রণার এক মহা-শূন্যতায় অনন্তকাল ধরে ঝুলে থাকার হুমকির মুখে তারা নিপতিত হবে।
এদিকে অন্যান্য দলগুলি যদি এখনই তাদের দ্বিমুখী বৈশিষ্ট্য বিলোপ করতে না পারে তবে যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়, অমোচনীয়, অভাবনীয়, অনুদ্ধারণীয়। গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনো নৈতিক-অনৈতিক কার্যক্রম দ্বারা যখন শক্তিশালী কোনও দলকে প্রয়োজনের তাগিদে অকিঞ্চিৎকর করে তোলা হচ্ছে আর ইত্যবসরে যদি জনগণ নিজ স্বার্থ বুঝে নিয়ে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল না হতে পারে, তবে পরিশেষে সবচেয়ে চড়া মূল্য তাদেরকেই দিতে হবে। আহমেদ ছফা বলেছিলেন, “আওয়ামীলীগ যখন জিতে তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জিতেন, আর আওয়ামী লীগ যখন হারে, গোটা বাংলাদেশ পরাজিত হয়”। হাসিনা তথা মুষ্টিমেয় নেতা-নেত্রী জিতুক না জিতুক, বাংলাদেশ যেন পরাজিত না হয় তা নিশ্চিত করা যায় কিভাবে? সেটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়।
http://www.notun-din.com/?p=6215
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।