আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখের ভূমিকা

অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!

পহেলা বৈশাখ। আমাদের জাতীয় জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই আমরা এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে নতুন বছরকে শুভেচ্ছা জানাই। বাঙ্গালী জাতিস্বত্ত্বা প্রকাশের এ বিশেষ দিনে আমরা বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে এ দিনটিকে বরণ করে নিই। প্রাচীনকালের সেই বৈশাখী মেলা, পূজা-পার্বন, হালখাতা, মিষ্টি বিতরণ, লাঠিখেলা এসবই আজ আমাদের মাঝে আছে একটু নতুন রূপে।

যদিও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি তার অবস্থান থেকে একটু সরে শিল্প ও সেবার পরিধি বিস্তারে রত, আজও কৃষিই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। প্রকান্ড রথ নির্মাণ, নতুন নতুন ঢাক ঢোলের ছবি আঁকানো বৈশাখী পোশাক, সারা মাসব্যাপী বৈশাখী মেলার উৎসব, আনন্দ মিছিল, রমনা বটমূলের আয়োজন, রেডিও-টেলিভিশনের ব্যাপক অনুষ্ঠান প্রচার, পত্রিকাতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ-এর মাধ্যমে এ আয়োজনের পরিধি ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে। পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ব্যাপক আয়োজন দেশের বিত্তশালী থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে এক বিশেষ উৎসবে পরিনত হয়েছে। এসকল কর্মকান্ডের প্রতটিই আনন্দের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধি করতে পারে, পারে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়তে, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিনির্ভর বাঙালি গড়ে তুলেছে গ্রামীণ সংস্কৃতি।

অবারিত শস্যের মাঠ, অজস্র নদনদী, অরণ্যঘেরা সবুজ বিস্তীর্ণ সমতল ঘিরে একান্তই প্রকৃতির কোলে লালিত হয়েছে আবহমান কালের বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি, অভ্যাস-অভিজ্ঞতা, আচার-আচরণ, উপলব্ধি-অনুভূতি মিলেমিশে নির্মাণ করেছে বাঙ্গালি সংস্কৃতি। হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-পারসিক-মুসলিম-খ্রিষ্টান নানা জাতি, ধর্ম ও ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাংলা সংস্কৃতির একটি সমন্বিত রূপ। আবহমানকাল থেকে প্রাচীন বাংলায়ও পালিত হয়ে আসছে নববর্ষ। তবে কোন নির্দিষ্ট দিন ছিল না।

প্রকৃতির কোলে লালিত কৃষিনির্ভর বাঙ্গলি জীবনে প্রকৃতিই ছিল সবকিছুর নিয়ন্তা। প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্কের কারণে একটি বিশেষ সময়ে বাঙ্গালি জীবন হয়ে উঠত উৎসবমূখর। শস্য সম্পদে সমৃদ্ধ মানুষ নিজেদের উৎপাদিত নানারকম পণ্যসামগ্রী আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে নদীতীরে, বৃক্ষছায়ায়, অথবা পাহাড়ের পাদদেশে মিলিত হত। পারস্পারিক ভাব বিনিময়, সম্প্রীতি ও ক্রয়-বিক্রয়ের উৎস হিসেবে সৃষ্টি হয় মেলা। নববর্ষের এ মেলা হত দীর্ঘস্থায়ী।

পুরো বছরের প্রয়োজনীয় উপকরণ এখান থেকেই সংগৃহীত হত। দৈনন্দিন জীবনের রসদ, ঘর-গেরস্থালির যাবতীয় জিনিসপত্রের জন্য মেলার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল মেলাকেন্দ্রিক। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ঘরে ঘরে সাড়া জাগত উৎপাদনের। কৃষিজ দব্য, কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, বাঁশ-বেত-পাট শিল্প, মৃৎ শিল্প, চারু ও কারু শিল্পের এক বিশাল সমাবেশ ঘটত মেলায়।

এভাবে প্রাচীন বাঙলায় গড়ে উঠেছিল এক সুদক্ষ জনসমষ্টি। ভারত উপমহাদেশে প্রথম বাংলা সালের প্রবর্তন এবং পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনের রীতি প্রচলন করেন সম্রাট আকবর। তিনি মূলত অর্থনৈতিক কারনেই এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। হিজরী সন নির্ধারিত হয় চাদেঁর হিসাব অনুযায়ী, কিন্তু উপমহাদেশের সারা বছরের কৃষিকাজ চাদেঁর সাথে অতোটা সম্পর্কিত নয়, যে কারণে কৃষকেরা খাজনা প্রদানে প্রতিকূলতার সন্মুখীন হত। যথা সময়ে যথাযোগ্য খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়ে তখন সম্রাট আকবর তাঁর সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফাতেউল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী চন্দ্রাব্দ ও বাংলা পঞ্জিকার সমন্বয়ে “বাংলা বছর” এর প্রচলন করেন, যা “ফসলী সন” নামে ১৫৮৪ এর মার্চ মাসে প্রবর্তীত হয়।

প্রকৃতপক্ষে সম্রাট আকবরের ১৫৫৬ সালে সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়। বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতা বন্ধুদের নিমন্তন করে মিস্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবসায়ীক লেনদেনের পুন:সূচনা করতেন “হালখাতা” বা হিসাবের নতুন খাতা খোলে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে লেনদেন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলায় সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আজও পহেলা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ কারুকাজ, সরা আঁকা, মিছরির মিষ্টি বানানো, খৈ তৈরি, কাপর বোনা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ উৎসবমূখর পরিবেশে চলতে থাকে। উৎসুক জনতা শহরের পথে পথে বেড়ানো, মেলায় ঘোরাঘুরি করা, মিছরি-মুড়কি-মুড়ি-শুকনো সন্দেশ কেনাকাটায় সবার অংশগ্রহণ হয় এক কাতার থেকে।

এর জন্য নতুন মাত্রায় বিনিয়োগ করতে হয়, অধিক শ্রমিক নিয়োগ, নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য উৎপাদনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পহেলা বৈশাখ পরিণত হয় সৃজনশীলতা, উদ্যম ও বিনিয়োগের প্রতীক হিসেবে। সারাদেশে কম-বেশি ২৭০ টি বৈশাখী মেলা বসে। কালের বিবর্তনে এ মেলার আবহ ও বিস্তৃত বহুদূর এগিয়েছে। আজ থেকে ৩২ বছর আগে মরহুম পটুয়া কামরুল হাসান নিজে ঢোল বাজিয়ে গ্রামীণ মেলার আদলে রাজধানীতে প্রথম বাংলাদেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশাখী মেলা শুরু করেন বাংলা একাডেমী সবুজ চত্বরে।

সেই থেকে পহেলা বৈশাখেই ঢাকা পরিণত হয় মেলার নগরীতে। বাংলা সংস্কৃতিকে লালন করার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশের মহান লক্ষ্য ছিল এ মেলা আয়োজনের মধ্যে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বহুল বিস্তৃতির মাধ্যমেই আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব। পহেলাবেশাখ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা আয়োজনে সামিল হয় হাজার হাজার মানুষ। এখানে নানা কর্মসূচীর মধ্যে বর্ষবরণ সঙ্গীত, মঙ্গল শোভাযাত্রা, যাত্রাপালা, কবিতা আবৃতি, সঙ্গীতানুষ্ঠান, পান্তা-ইলিশ পর্ব উল্লেখযোগ্য।

সারা বছর ধরে ছেমেয়েদের মধ্যে গান শেখা, কবিতা আবৃতি করার এক জোয়ার সৃষ্টি হয়। বাবা মায়েরা বিশেষ চেষ্টা করেন ছেলেমেয়েদের এ অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করতে। নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বৈশাখী অফার দেয়। অডিও-ভিডিও, প্রোডাকশন হাউজগুলো বৈশাখ উপলক্ষে নতুন নতুন এ্যালবাম বাজারে ছাড়ে। এ সময়ে নতুন নাটক, সিনেমা রিলিজের জন্য পূর্ব থেকেই বড় ধরনের ব্যবসা চলতে থাকে।

বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে বাড়তি আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো এ সুযোগে জনগণের কাছে সহজে পৌছানের জন্য এসকল অনুষ্ঠাণ সরাসরি সম্পচারের চেষ্টা করে। তারাও বিশেষ অফার দেয়। এভাবে সারাদেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় এ পহেলা বৈশাখে। যেটা অতীতেও ছিল, তা আজ একটু বিস্তৃতরূপে এসেছে।

ব্যবসা বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি বৃদ্ধি যেকোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ এক নিয়ামক। আমরা যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাচ্ছি, সেখানে একটা শ্রেণী শুধুমাত্র ব্যবসায়িক লাভের কথা চিন্তা করে পণ্যসামগ্রির দাম বৃদ্ধি করে বলে বৈশাখের অনেকেই আনন্দে সামিল হতে পারে না। বৈশাখ আমাদের সামনে অপার সম্ভাবনা নিয়ে আসে। বৈশাখে আমরা বলি, আমরা যেন আমাদের পুরাতন ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে নতুন উদ্যমে সামনে পথ চলতে পারি। আমাদের সাস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের নিজস্ব গান, ছড়া, নাটক, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়ার উপকরণ দেশীয় আবহে তৈরি করে বাজারে ছাড়তে পারি।

এর মাধ্যমে নিজস্ব সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী করা হবে, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন হবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে, নতুন পণ্য উদ্ভাবনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করার মধ্যে নিজের কর্মনৈপুন্যতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে আমরা একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.