বিদ্যুৎ সঙ্কট দূর করা যায় কিভাবে
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
দেশের গুরুতর বিদ্যুৎ সঙ্কট সমাধানের জন্য ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার যা করছে এবং তার চেয়ে বড় কথা, যা সে না করছে- তাতে যেকোনো মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইতোমধ্যে ১৫ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ কালের এক-চতুর্থাংশ সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। গুরুতর একটি জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রাথমিক ধরনের কিছু ফলাফল হাতেনাতে তুলে দেয়ার জন্য একটি সদিচ্ছা সম্পন্ন দক্ষ সরকারের জন্য ১৫ মাস মোটেও খুব কম সময় নয়। কিন্তু সঙ্কটের তীব্রতা কমে আসার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রত্যক্ষ কোনো লক্ষণ এখনো জনগণের সামনে দৃষ্টিগোচর হয়নি।
সঙ্কটের তীব্রতা হ্রাস না পেয়ে বরঞ্চ তা আরো বেড়েছে। আগে রেওয়াজ ছিল দিন ২/৩ বার এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং। কিছু দিন আগে ঘোষণা দিয়ে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দু’ঘণ্টা পর পর দু’ঘণ্টা করে লোডশেডিং-এর নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। সঙ্কট সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতির বদলে অবনতিই এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের কাজের রেকর্ড। মানুষ তাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
বিদ্যুৎ, সার, দ্রব্যমূল্য, পানি, গ্যাস- এগুলো মোটেও কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। ’৯৬-এর আগে দেশে তীব্র সার সঙ্কট হয়েছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকার বিক্ষুব্ধ কৃষকের আন্দোলনকে দমন করার জন্য তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। বিএনপি-র ওপর থেকে মানুষের মন দ্রুত উঠে গিয়েছিল। মানুষের মধ্য থেকে তখন সৌৗাগান উঠেছিল, ‘খালেদা যাবে সারে’।
বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় শনির আখড়ার ‘পানি-আন্দোলন’, কানসাটের ‘বিদ্যুৎ আন্দোলন’ সরকারকে চরমভাবে জনবিচ্ছিন্ন করেছিল। বিদ্যুৎ সঙ্কট এভাবে চলতে থাকলে ‘খালেদা গেলে সারে, আর হাসিনা যাবে তারে’- এই সৌাগান আবার মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করবে।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের মতো এরূপ গুরুতর বিষয়ে সরকার যেভাবে শুধু বাগাড়ম্বর, ধৈর্য ধরার সবক, লোক দেখানো কিছু চটকদার পদক্ষেপ ও হাল্কা বোল-চালের মধ্যে নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছে তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, কর্মকর্তারা একেকজন একেক কথা বলছেন। কেউ বললেন, সামনে মাসের মাঝামাঝি সঙ্কটের তীব্রতা থাকবে না।
কেউ বললেন- দু’সপ্তাহ পরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অনেকে বললেন, এটা খুব বড় সমস্যা, সমাধান করতে ৩/৪ বছর লেগে যাবে। অন্যরা বললেন, আমাদের তো ‘ভিশন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি’ ওয়ান দেয়াই আছে, সমস্যা ততোদিনে আমরা সমাধান করে দিব। উপদেষ্টা মহোদয় জোর দিয়ে বললেন, ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে ‘দিনের আলো সাশ্রয়’-এর ফর্মুলার দ্বারা বিদ্যুৎ সঙ্কটের তীব্রতা অনেক কমিয়ে আনা যাবে। বলা হলো, রাতে এয়ারকন্ডিশনার চালানো বন্ধ রাখতে হবে, তাতে অবস্থার কিছু উন্নতি হবে।
কতো টেটকা বুদ্ধি। কতো দু’সপ্তাহ পার হলো, কতো আগামী মাসের মাঝামাঝি এলো গেলো, ঘড়ির কাঁটা আগানো হলো পেছানো হলো- কাজ হলো না কিছুতেই।
নিজেদের বেতন-ভাতা প্রায় ডবল পরিমাণে বৃদ্ধি করা ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি আমদনির সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে যারা ধৈর্য ধারণ করতে অক্ষম, তাদের মুখ থেকে বিদ্যুৎ সঙ্কট লাঘবের জন্য ধৈর্য ধরার সবকে পাবলিক যদি সাড়া দিতে আগ্রহী না হয় তাহলে তাদেরকে দোষ দেয়া যায় কি?
যেকোনো দেশের জন্য বিদ্যুতের বিষয়টি ছোটখাটো আর দশটা বিষয়ের একটির মতো ব্যাপার নয়। রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সেই বিপ্লবের নেতা কমরেড লেনিন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সারাদেশে বিদ্যুতায়নের এক মহাকর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। এই কাজকে কেন কেন্দ্রিক কাজ বিবেচনা করা উচিত তা তিনি অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি ইত্যাদি নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
তার বিখ্যাত উক্তি ছিল এই বলে যে, ‘সমাজতন্ত্র হলো সোভিয়েত ক্ষমতা যোগ বিদ্যুৎ’। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও অর্থনৈতিক-সামাজিক অগ্রগতির অন্যতম চাবিকাঠি হলো বিদ্যুৎ। আধুনিক যুগে এটাকে শক্তি-সম্পদ বলাটাই অধিকতর শুদ্ধ। দেশের মানব সম্পদের উৎকর্ষতা সাধন, সকলের জন্য উন্নত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, শক্তি সম্পদের বিপুল সরবরাহ নিশ্চিত করা (যার মধ্যে বিদ্যুৎ একটি প্রধান অংশ) এবং নৌ-রেল-সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন- এই চতুর্মুখী কতর্ব্যকে জাতীয় উন্নয়নের রণনীতিগত পথ রূপে বিবেচনা করা উচিত। জাতির বর্তমান বিকাশের স্তরে এখানেই হলো বিদ্যুতের সামষ্টিক গুরুত্ব।
শুধু অগ্রগতির প্রয়োজনেই বিদ্যুতের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ নয়। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ের সাথেও বিদ্যুতের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। জ্বালানি নিরাপত্তা আবার সরাসরি জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাছাড়া অর্থনীতির চলতি অবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্যও বিদ্যুৎ সঙ্কট দূর করাটা অত্যাবশ্যক। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সঙ্কট সৃষ্টি হলে তা শিল্প, কৃষি, উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন ইত্যাদি সবকিছুকেই বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করে।
বিনিয়োগ, পরিবেশ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অমোচনীয় প্রতিকূলতা। সামষ্টিক ক্ষেত্রে এসব প্রতিকূলতার অভিঘাত শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ওপরে। বিদ্যুতের অভাবে কারখানা বন্ধ থাকলে মালিকের লাভ কম বটে, কিন্তু শ্রমিকের মজুরি কমিয়ে রেখে অথবা শ্রমিক ছাঁটাই করে সে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তাছাড়া, যদি শেষ পর্যন্ত তার লাভের পরিমাণ কিছুটা কমেও যায় তাতে তার জীবনে অনাহার-দরিদ্র্য নেমে আসা তো দূরের কথা, তার বিলাসবহুল জীবনমানে সেটার প্রভাব খুব সামান্যই পড়ে থাকে।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের সরাসরি অভিঘাত সবচেয়ে বেশি সরাসরি অনুভূত হয় জনগণের দৈনন্দিন জীবনে।
যারাই বিদ্যুৎনির্ভর জীবন প্রণালীতে জড়িয়ে আছে সেই বিত্তবান, মধ্যবিত্ত ও গরিবের একাংশ বিদ্যুৎ সঙ্কটে সরাসরি সমস্যার মুখে পড়ে। এসব মানুষের সংখ্যা শহরেই বেশি। গ্রামাঞ্চলেও বেশ কিছু লোক এখন বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী হয়েছে। তবে একথা ঠিক যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী এখনো সরাসরি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না। আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যুৎ সঙ্কট তাদের জীবনযাত্রাকে তেমন প্রভাবিত করে না।
কিন্তু তাদের ওপরেও পরোক্ষ নানাভাবে বিদ্যুৎ সঙ্কটের আঘাত এসে পড়ে। তাই, সামষ্টিক বিচারে হোক কিংবা তৃণমূল বিচারে হোক, অর্থনীতির বিবেচনা থেকে হোক, কি সামাজিক বিবেচনা থেকে হোক, জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রসঙ্গ থেকে হোক কিম্বা রাজনীতির উত্থান-পতনের হিসাব থেকে হোক,- সব বিবেচনা থেকেই বিদ্যুৎ সঙ্কট একটি খুবই গুরুতর বিষয়। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার রূপকল্প প্রসঙ্গ তো বহু দূরের বিষয়, ন্যূনতম জাতীয় অগ্রগতির ধারা নিশ্চিত করতে হলে এবং এমনকি উন্নয়ন ধারায় ধস ও বিপর্যয় রোধ করতে হলে বিদ্যুতের সমস্যা দূর করার প্রতি অগ্রাধিকারমূলক মনোযোগ দেয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে সরকারের পারফর্মেন্স হতাশাজনক।
বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের উদাসিনতা, খামখেয়ালিপনা, বাগাড়ম্বরে সীমাবদ্ধ থেকে বাস্তবে কিছু না করতে পারার কারণ কী? তা কি সরকারের সদিচ্ছার অভাব, অদক্ষতা, সমস্যার স্বরূপ বুঝতে না পারা, বিশেষজ্ঞমূলক পরামর্শ গ্রহণের বদলে সাধারণ জ্ঞান দিয়ে কাজ চালানোর প্রবণতা ইত্যাদি।
হয়তো এসব কারণের সবগুলোই বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতার জন্য কম-বেশি দায়ী। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ অন্যত্র। বিদ্যুৎ খাতের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে নতুন উৎপাদন সক্ষমতা যুক্ত করার বিষয়ের সাথে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রশ্ন জড়িত। বড় বড় এসব দীর্ঘমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি প্রজেক্টের ঠিকাদারী পাওয়ার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। এসব প্রজেক্ট দেয়া-নেয়াকে কেন্দ্র করে আছে কমিশনের লেন-দেনের ব্যাপার।
এসব কমিশনের টাকার পরিমাণ কল্পনাতীত। রাজনীতিবিদ আমলাতন্ত্র প্রভৃতি নীতি নির্ধারকদের আসল আকর্ষণ হলো এই কমিশনের ভাগ পাওয়ার দিকে। সঙ্কটের আশু নিরসনের দিকে মনোযোগ দেয়ার প্রতি তাদের সময়ইবা কই সে বিষয়ে তাদের তেমন আগ্রহই বা ততোটা থাকবে কেন। কোনো দেশীয় কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়ে সমস্যার ভার কিছুটা লাঘবের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিলে, তাতেও কর্তাব্যক্তিরা অনাগ্রহী। কারণ তিনটি।
এক. দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এসব কাজ করালে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে যেভাবে কমিশন হাতে নেয়া যায়, এক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যাবে না। দুই. সঙ্কট যদি লাঘব হয় তাহলে গভীর সঙ্কটের অজুহাত কাজে লাগিয়ে বেশি দামে বিদেশিদেরকে প্রজেক্ট পাইয়ে দিয়ে কমিশনের পরিমাণ বাড়ানো যাবে না। তিন. সঙ্কট লাঘবের জন্য আশু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের কাজ থেকে তেমন কমিশন পাওয়ার সুযোগ কম। সুদূর প্রসারি বড় বড় দামি প্রজেক্টে কমিশন বেশি। তাই বর্তমান সমস্যা জিইয়ে থাকুক তাতে এসব কর্তাব্যক্তিদের লোকসান কি? সরকার আসে যায়, কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয় না, -এর পেছনে এগুলোই বড় কারণ।
দীর্ঘমেয়াদি নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের বিদ্যুৎ ও শক্তি-সম্পদের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। দুর্নীতি ও টেবিলের নিচ দিয়ে কমিশন লেনদেনের কারবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, বিদ্যুৎখাতের উন্নতির জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে সৎ ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই কাজে হাত দিতে হবে। সাথে সাথে বিদ্যুৎ সঙ্কটের বর্তমান ভয়াবহতা লাঘবের জন্যও দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। আলাদিনের চেরাগের মতো ফুৎকারে সব সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু ১২/১৪ মাসে সঙ্কটের তীব্রতা দূর করা সম্ভব। তেল-গ্যাস- সম্পদ-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সম্প্রতি এ বিষয়ে কতগুলো সুনির্দিষ্ট করণীয় তুলে ধরেছেন।
পাওয়ার সেলের সাবেক চেয়ারম্যান বি ডি রহমতউল্লাহ, ভূতত্ত্ববিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমামসহ বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই তারা বিদ্যুৎ ও শক্তি-সম্পদের করণীয় সম্পর্কে তাদের সুপারিশ তুলে ধরেছে। এখানে সে সবের কয়েকটা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
ফ সাধারণ বিদ্যুৎ বাল্বের বদলে সর্বত্র বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহার নিশ্চিত করা। এর জন্য ব্যয় হবে ৩০০ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নে সময় নিবে ৩ মাস। এই টাকা অবশ্য পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের বিলের সাথে সমন্বয় করে উঠিয়ে নেয়াও সম্ভব হবে।
এর ফলে একদিকে গ্রাহকদের বিল ২০%-এ নেমে আসবে একই সাথে এই কার্যক্রমের দ্বারা ৩ মাসের মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াট লোড চাহিদা কমিয়ে ফেলা যাবে।
০ শিল্প-কারখানায় এবং ৫ ঘোড়া-শক্তির ঊর্ধ্বের যেকোনো মোটরের বিপরীতে, ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ইন্টেলিজ্যান্ট মোটর-নিয়ন্ত্রক’ (ওগঈ) স্থাপন করে সর্বাধিক ৪ মাসের মধ্যে সিস্টেম থেকে ৭০০ মেগাওয়াট লোড চাহিদা কমানো সম্ভব। এ জন্য খরচ হবে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, যে টাকা গ্রাহকদের পরবর্তী বিল থেকে পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে আনা যাবে।
০ সব টিউব লাইটে ইলেক্ট্রনিক ব্যালাস্ট ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে লোড চাহিদা ১০০ মেগাওয়াট হ্রাস করা যাবে। এজন্য খরচ হবে মাত্র ১ কোটি টাকা এবং সময় লাগবে মাত্র ১ মাস।
০ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বস্তরে উপযুক্ত ক্যাপাসিটার স্থাপন করে ২৫০ মেগাওয়াট লোড চাহিদা কমানো যাবে। এটা বাস্তবায়নে সময় লাগবে সর্বাধিক ১২ মাস এবং এজন্য খরচ করতে হবে ১০০০ কোটি টাকা।
০ শিল্প-কারখানার মালিকদের সাথে সমন্বয় করে, তাদের উদ্যোগেই ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যবস্থা স্থাপন করে বিদ্যুৎ সিস্টেমে ৭০০ মেগাওয়াট লোড সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব। এই ব্যবস্থা চালু করতে সময় লাগবে সর্বাধিক ১২ মাস। এজন্য সরকারকে কোনো খরচ বহন করতে হবে না।
০ পুরানো অদক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থাপনাগুলো নবায়ন করে সিস্টেমে কমপক্ষে ৭০০ মেগাওয়াট লেড সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। এজন্য খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নে সময় নিবে ১২ মাস।
০ লোড ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত ও দক্ষ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৪০০ মেগাওয়াট লোড চাহিদা হ্রাস করা সম্ভব। এজন্য প্রচারণা ব্যয় ছাড়া কোনো ব্যয় নেই, এবং এ কাজ করতে ২/৩ মাসের বেশী সময় লাগবে না।
উপর্যুক্ত ৭টি ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারাই বিদ্যুৎ সিস্টেমে লোড চাহিদা ২০৫০ মেগাওয়াট হ্রাস করা যাবে এবং পাশাপাশি সরবরাহ বাড়ানো যাবে ১৪০০ মেগাওয়াট।
অর্থাৎ ১২ মাসের মধ্যেই এভাবে মোট ৩৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এজন্য খরচ হবে মাত্র ২৪০১ কোটি টাকা। কেউ যদি মনে করেন, এই হিসাবটা বেশি, তাহলে আপেক্ষিকভাবে বলা যায় যে, খুব বেশি হলে ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এভাবে কমসে কম হাজার তিনেক মেগাওয়াট বিদ্যুতের সংস্থান করা সম্ভব। এই অর্থ আমাদের জাতীয় বাজেটের ৩%-এর কম। এসব কাজ ইতোমধ্যে মহাজোট সরকার করে ফেলতে পারতো।
এসব জরুরি কাজের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ১২ মাসের জায়গায় ১৫ মাস সময়ও পেয়েছিল। তবুও সরকার এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ‘রাতারাতি বিদ্যুৎ সঙ্কট দূর করা সম্ভব নয়’ বলে যে অজুহাত দেখানো হচ্ছে, জনগণ তা তাই মেনে নিতে পারে না।
আশু সঙ্কট লাঘবের এসব উপস্থিত জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও শক্তি-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বড় বড় কার্যক্রম একই সাথে গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি তথা তেল, গ্যাস, কয়লা প্রভৃতির প্রসঙ্গ চলে আসে।
এসব ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
(১) নবায়নযোগ্য জ্বালানি যথা সূর্য, বাতাস, বায়োগ্যাস, নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শক্তি-সম্পদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিতে হবে।
(২) বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শক্তি-সম্পদের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে ও তা প্রসারিত করতে হবে।
(৩) বাপেক্সকে শক্তিশালী করে চলমান গ্যাস কূপগুলো ওয়ার্কওভারে ও উন্নয়নের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদে গ্যাস সঙ্কট মিটিয়ে ফেলতে হবে। বিদেশে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রদ করে, প্রয়োজনে বিদেশি কারিগরি সহায়তা গ্রহণ করে, ১০০% দেশীয় মালিকানায় নতুন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৪) দেশের কয়লা সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। মাটি খুঁড়ে ওপেন পিট পদ্ধতি কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতির বদলে গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে কয়লা সম্পদ ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি সম্প্রতি চীনসহ কয়েকটি দেশ সফলভাবে প্রয়োগ করা শুরু করেছে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক ও জনবসতিজনক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে মাটি খুঁড়ে কয়লা উত্তোলনের চেয়ে গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিই বেশি উপযুক্ত। এই পদ্ধতিতে কয়লাকে মাটির নিচে রেখেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে গ্যাস/তেলে রূপান্তর করে তা পাম্প করে বা চাপ সৃষ্টি করে উপরে উঠিয়ে এনে প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা যায়।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি, শক্তি-সম্পদ প্রভৃতি কোনো সঙ্কটই অসমাধানযোগ্য নয়। সমাধানের উপায় আছে, পথ আছে। বাধা হলো উপরিতলার মুষ্টিমেয় মানুষের রাক্ষুসে লালসা। রাক্ষসের এই ‘খাই-খাই’ লালসাকে ভয় দেখিয়ে বা নীতিবাক্য শুনিয়ে নিবৃত্ত করা যাবে না। লুটপাটের ‘খাই-খাই’ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে বদলে ফেলতে না পারলে এই বাধা দূর হয়তো হবে না।
সেটা সমাজ বিপ্লবের প্রসঙ্গ, একটি পৃথক বিষয়। তবে, ‘খাই-খাই’ বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করে দেখা যাক না। সরকার কি সেটুকু করতেও সম্পূর্ণ অপারগ?
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।