আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুলিশ অফিসার গৌতম কোন জিঘাংসার শিকার?



ইমরান হোসেইন সুমন: পুলিশ অফিসার গৌতমের খুনি কে? কার জিঘাংসার শিকার হলেন তিনি? তাকে কি পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে? আর হত্যার পর ৩ যুবকের দেহ তলস্নাশির যে কথা বলা হচ্ছে তা সাজানো কিনা- এসব প্রশ্ন এখন পুলিশের সামনে। এ ঘটনায় ডিবি, র‌্যাব, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের সব ক’টি সংস্থা একযোগে তদন্ত চালাচ্ছে। উয়ারী বিভাগের সব ক’টি থানায় নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত সতর্কাবস্থা। পয়েন্টে পয়েন্টে বসানো হয়েছে তল্লাশি চৌকি। এদিকে গৌতম খুনের পর তার বন্ধু দাবিদার আজম ও শামীমের ভূমিকা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।

গুলিবিদ্ধ গৌতমকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার কোমর থেকে সরকারি অস্ত্র ও ওয়াকিটকি খুলে নেয়ার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। এ ঘটনায় দশজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদের মধ্যে বন্ধু দাবিদার আজমও রয়েছেন। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আহত শামীমকে নিয়ে আজমের হাসপাতালে ছুটে যাওয়া এবং থানায় অস্ত্র নিয়ে যাওয়া- এ সব বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে আজমের কাছে। জিজ্ঞাসাবাদে আজম এলোমেলো কথাবার্তা বলছে।

গৌতম থানা থেকে বের হওয়ার পর ধোলাইখাল যাওয়া পর্যন্ত কি ঘটেছিল তার জবাব এখনও মিলছে না। সেদিন রাতে বংশাল থানায় অপারেটরের দায়িত্ব পালন করা ইজাজ বলছেন, গৌতম স্যার থানা থেকে বের হয়ে যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যেই কালোমতন লোকটি (আজম) পিস্তল ও ওয়াকিটকি নিয়ে থানায় আসে। ওদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাতে গুলিবিদ্ধ শামীমকে নজরবন্দি করা হয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে পুলিশি পাহারা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাতে গুলি লাগা শামীমের অবস্থা তেমন গুরুতর নয়।

গোয়েন্দা ও কর্মকর্তারা বলছেন, শামীমই বলতে পারবে এ ঘটনার মূল তথ্য। কি ঘটেছিল সে রাতে জানতে চাওয়া হচ্ছে তার কাছে। অন্যদিকে পুলিশ অফিসার গৌতম, ধোলাইখালের মোটরপার্টস ব্যবসায়ী শামীম ও আজমের মোবাইল কল লিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওই রাতে গৌতমের সঙ্গে শামীম ও আজমের কথোপকথনের রেকর্ড চাওয়া হয়েছে ফোন কোম্পানির কাছে। ওদিকে ধোলাইখালের চিশতিয়া মার্কেটের এক দারোয়ান পুলিশকে জানিয়েছে, রাতে গুলির ঘটনার পর তিনি সামনে এগিয়ে আসেন।

সেখানে আজম ও শামীমকে দেখেন তিনি। আজম তাকে বলে, ওনাকে একটি রিকশায় তুলে দিয়েন। তখন রাস্তায় পড়েছিল গৌতমের লাশ। তবে তিনি তা করতে পারেননি। তার আগেই পুলিশের একটি টহল টিম এসে গৌতমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

সুরতহালে যা লেখা হলো গৌতম খুনের পর হাসপাতালে তার সুরতহাল করেছেন সূত্রাপুর থানার এসআই জাহাঙ্গীর কবির খান। এই মামলার বাদীও তিনি। গতকাল মানবজমিনকে তিনি বলেন, সুরতহালে গৌতম স্যারের বুকের বাঁ পাশের নিচের অংশে একটি গুলি লেগেছে। আর কোমরের পেছনের দিক থেকে দু’টি গুলি লাগে। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়।

তবে বুকের ওই অংশে গুলি লাগার পর হাসপাতালে নেয়া পর্যন্ত কমপক্ষে আধ ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা বেঁচে থাকার কথা ছিল। এ সময় কোমরে পিস্তল ও ওয়াকিটকি পাওয়া যায়নি। মানিব্যাগও ছিল না। এসআই জাহাঙ্গীর বলেন, গৌতম স্যার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন কি গেলেন না তা আজম কিভাবে বুঝলো? আর গুলিবিদ্ধ স্যারকে রেখেই তড়িঘড়ি করে আহত শামীমকে নিয়ে তিনি কেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন তা রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মাসউদুর রহমান প্রিন্স বলেন, গুলিতে কোন ব্যক্তির হার্ট যদি ফুটো হয়ে যায় তাহলে কমপক্ষে তার আধ ঘণ্টা বেঁচে থাকার কথা।

আবার অনেক সময় ভিকটিম শকড হয়ে গেলে ১৫ মিনিটের মধ্যেই মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমাদের মনে হয়ে যেহেতু গৌতম পুলিশ অফিসার ছিলেন তাই তার মধ্যে মানসিক দৃঢ়তা ছিল। তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নেয়া হলে হয়তো কিছু একটা করা যেত। গৌতমকে কে ডেকে এনেছিল সেই রাতে বংশাল থানায় ওয়ারলেস অপারেটরের দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল ইজাজ। গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, রাত তখন ২টা বাজে।

কালোমতো একটা লোক স্যারের টেবিলের সামনে গিয়ে বসেন। স্যারকে কি যেন বলছিলেন লোকটি। এরপরই স্যার আমাকে বলেন, ভালভাবে ডিউটি করা। ঘুমিয়ে যেও না। জরুরি কোন খবর হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাইও।

এরপর স্যার ওই লোককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যান। এর ২০ মিনিট পরই হাঁপাতে হাঁপাতে ওই লোকটি স্যারের পিস্তল, ওয়াকিটকি ও মোবাইল ফোন নিয়ে থানায় ঢোকেন। বলে, গৌতমকে গুলি করেছে। আপনারা চলেন। সে সময় ডিউটি অফিসার ছিলেন পিএসআই ফজলু।

তিনি বলেন, লোকটি গৌতম স্যারের অস্ত্র নিয়ে এলে জানতে চাই, কি হয়েছে। সে বলে, গৌতমকে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে রাস্তায়। ফজলু বলেন, আমি তৎক্ষণাৎ স্যারের অস্ত্রটি নিয়েই থানা থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে স্যারকে পাইনি।

শুনি টহল টিম তাকে নিয়ে গেছে। এরপর আমি হাসপাতালে যাই। পেছন থেকে গুলি করলো কে ঘটনার পর মঙ্গলবার হাসপাতালে বন্ধু দাবিদার আজম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সামনের দিক থেকেই গুলি করে সন্ত্রাসীরা। গুলিবিদ্ধ গৌতম তার বুকেই লুটিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি গুলি সামনে থেকে করা হয়েছে।

আর দু’টি গুলি করা হয়েছে পেছন থেকে। তাহলে পেছন থেকে গুলি করলো কে? আর কিভাবেই আজমের কোলে লুটিয়ে পড়লেন গৌতম। এ জিজ্ঞাসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। আজম বলেছেন, লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌতম তাকে বলেছিলেন, ভাই কিছু একটা করেন। রকি ডিএক্স গাড়ি যে জিপে (রকি ডিএক্স) করে গৌতম ও আজম থানা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সেই জিপ নিয়ে রয়েছে নানা রহস্য।

পুলিশ বলছে, ওই জিপটির কোন কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর জিপে করে গৌতম ও আজম বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেও ধোলাইখালে কেন নামানো হলো গৌতমকে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ধারণা করা হচ্ছে, কৌশলে পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে গৌতমকে খুন করা হয়েছে ওই জায়গায়। এর কারণ হিসাবে কর্মকর্তারা বলছেন, বংশাল থানার অপারেশন অফিসার হয়ে সূত্রাপুর থানা এলাকায় গৌতমের মতো একজন দক্ষ অফিসারের ফোর্স ছাড়া তল্লাশি চালানোর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার উদ্দেশে এ ধরনের গল্প ফাঁদা হয়ে থাকতে পারে।

তাছাড়া ধোলাইখালের চোরাই গাড়ি মার্কেটের গডফাদারদের বিষয়ে অনেক তথ্য ছিল পুলিশ অফিসার গৌতমের কাছে। এর নেপথ্যে শামীম ও আজমের হাত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে উয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মোস্তাক আহমেদ জানান, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, মামলার ক্লু পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুলির ঘটনার পর সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য কোন চেষ্টা কেন করেননি শামীম ও আজম। আজম-শামীম আসলেই বন্ধু কি? গৌতম খুন হওয়ার পর থেকে আজম ও শামীম তাকে বন্ধু দাবি করে এলেও তারা বন্ধু ছিলেন কিনা এটাও এখন বড় প্রশ্ন। বংশাল থানার ওসি আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, আজম ও শামীম মাঝে মধ্যে থানায় আসতো তবে গৌতমের বন্ধু ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার এসআই জালাল বলেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবশেষ জানানো হয়েছে গৌতমের পরিবারকে সব রকম সহযোগিতা দেয়া হবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.