দেশের বিভিন্নস্থানে এখন প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে রহস্যজনক গুলিবিদ্ধ লাশ। কীভাবে তাদের মৃত্যু হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তাদের মৃত্যু সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না। ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
কয়েক দিন পর তাদের গুলিবিদ্ধ লাশ কখনও রাস্তার ধারে, কখনও বা ঝোপের পাশে কিংবা ডোবায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কারও কারও লাশ অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবেও উদ্ধার হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা ক্রসফায়ারের নতুন সংস্করণ। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী মাকসুদ, তোফাজ্জল, পাবনার চরমপন্থী দলের আঞ্চলিক নেতা সবুর খাঁ ও পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) ক্যাডার শহিদুল ইসলামের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে সাতক্ষীরার কৃষক নেতা সাইফুল্লাহ লস্করের লাশ পাওয়া যায়।
কৃষক সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যশোর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ক্রস-ফায়ারের বিকল্প হিসেবে সরকার গুপ্তহত্যা চালু করেছে। এমন হত্যাকাণ্ড এখন প্রায়ই ঘটছে। অনেক ঘটনা আবার মিডিয়ার আড়ালে থাকছে। লাশ পাওয়ার পাশাপাশি অনেককে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে মাঝে মধ্যেই সংবাদ সম্মেলন অথবা পত্রিকা অফিসে এসে হারিয়ে যাওয়া স্বজনের সন্ধান চাওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এর আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ক্রসফায়ারের ঘটনা স্বীকার করলেও নানামুখী চাপ ও সমালোচনার মুখে এখন আর তারা ক্রসফায়ারের বিষয়টি স্বীকার করছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও বলেছেন, দেশে ক্রসফায়ার বলতে কিছু নেই। আগের মতো ক্রসফায়ারের কথা স্বীকার না করলেও বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু থেমে নেই। প্রায়ই দেশের বিভিন্নস্থানে গুলিবিদ্ধ যে সব লাশ পাওয়া যাচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মৃত্যু যে ক্রসফায়ারে হয়েছে এ ব্যাপারে সবাই প্রায় নিশ্চিত। আবার যাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই দাগী ক্রিমিনাল অথবা চিহ্নিত সন্ত্রাসী।
অনুমান করা হচ্ছে, ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো এবং সমালোচনার হাত থেকে বাঁচার জন্যই নয়া এই পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়েছে।
গত ১৩ নভেম্বর মাদারীপুরের মিঠাপুর এলাকার সর্বহারা সদস্য দুই ভাই লুত্ফর খালাসি ও খায়রুল খালাসিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারের পর লুত্ফর খালাসির ছেলে বাবলু খালাসি ঢাকা ও মাদারীপুরে পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে আশঙ্কা প্রকাশ করে, তার বাবা ও চাচাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হতে পারে। তাই সে বাবা ও চাচার প্রাণরক্ষার আকুল আবেদন জানায়। কিন্তু ওই আবেদনেও কাজ হয়নি।
ঢাকায় যেদিন সংবাদ সম্মেলন করছিল পুত্র ওইদিন রাতেই অর্থাত্ ১৬ নভেম্বর তার বাবা এবং চাচাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ঘটনার পরের দিনই আদালত সুয়োমোটো রুল জারি করে সরকার ও র্যাবের কাছে জানতে চান, দুই সহোদরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন আইন বহির্ভূত হত্যা ঘোষণা করা হবে না। পাশাপাশি আদালত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, র্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট চারজনকে ওই রুলের জবাব দিতে বলেন। বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচার বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ওই আদেশ দেন।
১৪ ডিসেম্বর আদালত শুনানিতে বলেন, আদালত সুয়োমোটো রুল জারি করার পরও ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
মূলত হাইকোর্টের এই সুয়োমোটো রুলের পরেই ক্রসফায়ারের ঘটনা কমে যায়। কিন্তু গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে।
নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আমীন মাকসুদ ওরফে ড্রেজার মাকসুদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। গত রোববার গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার টালটিয়া নাগদা ব্রিজ সংলগ্ন রাস্তার পাশ থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। তার বিরুদ্ধে ৩টি হত্যাসহ ১৭টি মামলা রয়েছে।
এদিকে মাকসুদের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তির। নিহত মাকসুদের স্ত্রী মুন্নী ও স্বজনরা জানান, মাকসুদ তার একজন বন্ধুসহ শনিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা থেকে একটি টেক্সিক্যাব নিয়ে উত্তরা যাচ্ছিলেন। পথে ২টি সাদা রংয়ের গাড়ি ঢাকার রেডিসন হোটেলের সামনের সড়কে মাকসুদের গাড়ির গতিরোধ করে। ১৫/১৬ জন সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়ি থেকে নামিয়ে মাকসুদ ও তার বন্ধু মসিউর রহমান মশুকে লাঠিপেটা করে। মসুকে ফেলে রেখে তারা মাকসুদকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
এরপরই তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে।
গত রোববার সন্ত্রাসীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দলের আঞ্চলিক নেতা সবুর খাঁ (৩৫) খুন হয়েছে। গত শনিবার সকালে শহিদুল ইসলাম (৪৫) নামে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধের) অপর এক ক্যাডার নিহত হয়। তাদের দু’জনকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। কে বা কারা তাদের হত্যা করেছে এ ব্যাপারে পুলিশ কিছুই জানাতে পারেনি।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার মুলগ্রাম ইউনিয়নের ক্ষতবাড়ি গ্রামের রফিকুল ইসলাম খাঁ’র ছেলে চরমপন্থী দলের আঞ্চলিক নেতা সবুর খাঁ। গত শনিবার রাতে তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে আতাইকোলা থানার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ফলিয়া গ্রামের একটি মাঠে নিয়ে মাথায় আঘাত করে ও গলায় লোহার চেইন পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তার লাশ পাওয়া যায় সেখানে।
গত ২৩ ডিসেম্বর খুলনার মংলায় হোটেল পারিজাতের পার্শ্ববর্তী কাশবনের ভেতর থেকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধের আঞ্চলিক প্রধান শহীদুল ইসলাম শহীদের (৩৮) গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।
তার বুকে ৩টি বুলেটবিদ্ধ ছিল। কয়েকদিন আগে সাদা পোশাকের লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায় বলে আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেন।
৪ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার কৃষক আন্দোলনের নেতা সাইফুল্লাহ লস্করের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে পুলিশ তার বাসায় অভিযান চালায়। এরপরই তার লাশ পাওয়া যায় বাড়ির পাশে।
তার গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন ছিল। ২০ নভেম্বর মিরপুরে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল কালাম আজাদ রাজুর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। মাগুরা জেলার দোয়ারাপাড়ার আবদুুল আজিজ বিশ্বাসের পুত্র রাজুর বিরুদ্ধে নগরীর মিরপুরসহ বিভিন্ন থানায় মামলা ছিল। মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পেছনে একটি স্কুলের পাশের খালি জমিতে ঝোপের পাশে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার মাথায় গুলিবিদ্ধ ছিল।
নিহতের আত্মীয়রা জানান, ১৮ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। কে বা কারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে তা জানা যায়নি। তবে শাহ আলী থানা পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের মাথায় দুটি গুলি ছিল। দেখে মনে হয়েছে, পেশাদার ব্যক্তিরা তাকে হত্যা করেছে।
১০ অক্টোবর মতিঝিল ব্রাদার্স ক্লাব মাঠ থেকে মোসলেহউদ্দিন ওরফে শাহীন চৌধুরী নামে এক ফিলিং স্টেশন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
র্যাব, থানা, ডিবি অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধান করেও তার কোনো খোঁজ না পেয়ে শাহীনের স্ত্রী প্রিয়া মতিঝিল থানায় জিডি করেন। জিডিতে বলা হয়, তার স্বামী শাহীন চৌধুরী গত ১০ অক্টোবর বিকালে জগিং করার জন্য মতিঝিলের ব্রাদার্স ক্লাব মাঠে যান। সেখানে একটি সাদা মাইক্রোবাসযোগে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা ব্রাদার্স ক্লাবে গেলে উপস্থিত লোকজন জানায়, র্যাব পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে ৬-৭ সশস্ত্র যুবক তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা র্যাব-৩, র্যাব-১০, র্যাব সদর দফতর, মতিঝিল, সূত্রাপুর, কোতোয়ালিসহ ঢাকার বিভিন্ন থানা এবং মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নেন।
শাহীন চৌধুরীকে আটকের বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্বীকার করেনি। পরে গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি মাঠ থেকে মোসলেহ উদ্দিনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের স্ত্রী এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এমনিতেই তিনি এতিম ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহাআতঙ্কে আছেন তাই এ বিষয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে চাইছেন না।
সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সভাপতি ভিপি হেলালকে উত্তরার বাসা থেকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অদ্যাবধি তার কোনো হদিস পায়নি তার পরিবার।
গত ১৯ ডিসেম্বর সাভারের ভাকুর্তা এলাকার কলাবাগান থেকে অজ্ঞাত যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ২১ ডিসেম্বর ঢাকা-আরিচা সড়কের বলিয়ারপুর এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আজ পর্যন্ত এই দুই হতভাগা যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এভাবে গত কয়েক মাসে গুলিবিদ্ধ লাশের পরিসংখ্যান নিলে দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাবে।
এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যার শিকারদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কীভাবে, কাদের হাতে তাদের মৃত্যু হচ্ছে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রহস্যজনক নীরবতা পালন করছেন। নিহতের আত্মীয়স্বজনরা বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করলেও আজ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ব্যাখ্যা বা বক্তব্য দেয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।