অন্যায়ভাবে সংঘটিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই । ।
দেশে একদিকে ক্রসফায়ার আর অন্যদিকে চলছে গুপ্তহত্যা। বিভিন্ন সংস্থার নাম করে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে অনেকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে।
এর দায়দায়িত্ব কেউ স্বীকার করছে না। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন চিরতরে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা র্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরনা দিলেও তাদের আর দেখা মিলছে না। এর মধ্যেই রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ তীরে মাটি খুঁড়ে তিন ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে। নিহতদের নামে মামলা থাকায় রহস্য ঘনিভূত হয়ে উঠেছে।
অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হাতে প্রমাণও রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তারা ফিরে আসেননি। চলতি মাসে কয়েকটি গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কোনো থানা এলাকায় র্যাবসহ অন্য গোয়েন্দারা কাউকে আটক করলেও তা সংশ্লিষ্ট থানাকে জানানো হচ্ছে না। ফলে কে কাকে আটক করল তা বেমালুম অস্বীকার করার সুযোগ নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাদা পোশাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের।
পরিচয়পত্র দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেন না গ্রেফতারকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা।
গত ১১ মে আইন ও সালিশ কেন্দ্র দেশব্যাপী গুপ্তহত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, সম্প্রতি পুলিশ ও র্যাব পরিচয়ে লোকজনকে বাসা ও রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ধরনের গুপ্তহত্যা ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের কর্মকান্ড কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এ ধরনের হত্যা বন্ধে সরকারের কাছে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এবং তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আহবান জানিয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এ ধরনের কর্মকান্ডকে ‘গুপ্তহত্যা’ উল্লেখ করে তা অবিলম্বে বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারাও। তারা বলেছেন, কোনো বাহিনী এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকলে তা তদন্ত করা উচিত। র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার বুধবারকে বলেন, সম্প্রতি এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাম জড়িয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করা হচ্ছে। আগেও এসব দেখা গিয়েছিল।
তবে অপরাধীদের কথা না বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নাম জড়িয়ে এসব বলার ব্যাপারটা উদ্দেশ্যমূলক কিনা তাও দেখার ব্যাপার রয়েছে।
ক্রসফায়ারের শেষ নেই : ক্রসফায়ার নিয়ে চলছে একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। আদালত ও মানবাধিকার সংস্থা সোচ্চার হলে কিছু দিনের জন্য থেমে থাকে। ফের শুরু হয় বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড। চলতি মাসের ১৭ মে পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ১০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
এছাড়াও আরো দুই ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মারা গেছে। ১২ মে একদিনেই ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় চার জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। অধিকারের হিসেবে এপ্রিল মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৯ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছে।
ক্রসফায়ারের নতুন সংস্করণ গুপ্তহত্যা : ক্রসফায়ার নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো হৈ চৈ করে বলে ক্রসফায়ারের বদলে গুপ্তহত্যাকে বেছে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
লাতিন আমেরিকা, কাশ্মির ও ফিলিপাইনের আদলে বর্তমানে এ দেশেও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড চলছে। কখনো সাদা পোশাকের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর লোক সেজে আবার কখনো র্যাবের পোশাকে কোনো ব্যক্তিকে অপহরণ করা হচ্ছে। লাশও গুম করে ফেলা হচ্ছে। ফলে অপহৃত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্নস্থানে এখন প্রায়ই রহস্যজনক গুলিবিদ্ধ লাশ মিলছে।
পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের মৃত্যু সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না। পরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফনও করা হচ্ছে।
প্রথমদিকে এক স্থান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র ক্রসফায়ার করে ডাকাতির গল্প প্রচার করতো র্যাব । আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অনুসন্ধানে এ ধরনের অনেক ঘটনা ধরা পড়েছে। যা হাইকোর্টে রিট আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
এর একটি ঘটনা হলো, ২০০৮ সালের ২২ এপ্রিল মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার টেপড়া গ্রাম থেকে লোকজনের উপস্থিতিতে আটক করা হয়েছিল নুরুজ্জামান, মোঃ আলম ও বাদশা মিয়াকে। আটকের তিন ঘণ্টা পর সাভারের আমিন বাজার এলাকায় তাদের লাশ পাওয়া যায়। র্যাব-৪-এর পক্ষ থেকে আটকের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তদন্ত করে ক্রসফায়ারের আসল রূপ আদালতে উপস্থাপন করার পরই এ ধরনের গুপ্তহত্যা শুরু হয়েছে বলেই অনেকে আশঙ্কা করছেন।
সাদা পোষাক আতঙ্ক : সাধারণ পোশাকে বিভিন্ন বাহিনীর নাম করে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন।
লোকজন এখন আর আস্থা পাচ্ছে না। এর আগেও বেশ কিছু স্থানে সাধারণ পোশাকের কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আটকে রেখেছিল স্থানীয় লোকজন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে মারধর করা হচ্ছে। মিরপুরে গ্রেফতার করতে যাওয়া লোকজনের পরিচয় জানতে চাওয়ায় আরেক ভাইকেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে গ্রেফতার করতে যাওয়া র্যাবের পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়ার অপরাধে নিউ এজ-এর একজন সাংবাদিককেও নির্যাতন করেছিল র্যাব।
এ পরিস্থিতিতে দাবি উঠেছে, কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন পোশাক পরে যান। অথবা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গ্রেফতার করেন।
নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে : ওদিকে প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ, র্যাব কার্যালয়, ডিবি কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছে লোকজন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের কর্মচারীরা জানান, বেশ কিছু দিন ধরে লোকজন মর্গে রাখা লাশ দেখে যাচ্ছেন। মর্গের একজন কর্মচারী জানান, গত সপ্তাহে মিরপুর থেকে দুইজন নারী-পুরুষ মর্গে গিয়ে তাদের ভাইয়ের খোঁজ করেন।
র্যাবের নাম করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলেও তারা জানিয়েছিলেন। তবে মর্গ থেকে ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে তাদের যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, সেখানে খুন হওয়া অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের লাশের ছবি সংরক্ষণ করা হয়। এদিকে এ হাসপাতালের মর্গের দুটি ফ্রিজের একটি বেশ কিছু দিন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আরেকটি ফ্রিজে ছয়টি লাশ রাখা যাচ্ছে।
কিন্তু লাশের চাপ বেড়ে যাওয়ায় কোনো লাশ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। তাদের আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
প্রথমে অপহরণ পরে লাশ : ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে রাজধানীতেই সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে অভিযোগ আনা হচ্ছে। তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখেছে। অনেকে আটককৃত ব্যক্তির লাশ ফেরত দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন করছেন।
গত ৪ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার কৃষক সংগ্রাম পরিষদের নেতা সাইফুল্লাহ লস্করের লাশ পাওয়া যায়। কৃষক সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যশোর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ক্রসফায়ারের বিকল্প হিসেবে সরকার গুপ্তহত্যা চালু করেছে।
১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী তরুণ লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নূরুল আমিন ওরফে ড্রেজার মাকসুদের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে গাজীপুরে। তার বিরুদ্ধে ৩টি হত্যাসহ ১৭টি মামলা রয়েছে। নিহত মাকসুদের স্ত্রী মুন্নী সাংবাদিকদের জানান, ঢাকার রেডিসন হোটেলের সামনের সড়কে ১৫/১৬ জন সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়ি থেকে নামিয়ে মাকসুদ ও তার বন্ধু মসিউর রহমান মসুকে লাঠিপেটা করে।
একপর্যায়ে মসুকে ফেলে রেখে তারা মাকসুদকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এরপরই তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে।
গত বছরের ১০ অক্টোবর মতিঝিল ব্রাদার্স ক্লাব মাঠ থেকে র্যাব পরিচয় দিয়ে ৬/৭ জন যুবক মোসলেহউদ্দিন ওরফে শাহীন চৌধুরী নামে এক ফিলিং স্টেশন ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে র্যাব, থানা, ডিবি অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ধান করেও তার কোনো খোঁজ না পেয়ে শাহীনের স্ত্রী মতিঝিল থানায় জিডি করেন। জিডিতে বলা হয়, খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা ব্রাদার্স ক্লাবে গেলে উপস্থিত লোকজন জানায়, র্যাব পরিচয়ে তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে ৬-৭ সশস্ত্র যুবক তুলে নিয়ে যায়।
গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর তুরাগের পাড়ে একটি হাউজিংয়ের জমির বালু খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় তিনটি লাশ। নিহতদের মধ্যে ঝালকাঠির রাজাপুরের যুবদল নেতা মিজানুর রহমানও (৩৭) রয়েছেন। মিজানের স্ত্রী নাসিমা খানম অভিযোগ করেন, গত ১৭ এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে তার স্বামীসহ তিনজনকে অপহরণ করা হয়েছিল। অপহরণের দিনই তিনি বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন। তাকে র্যাব পরিচয়েই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
জানা গেছে, গত মার্চ মাসে মিজানকে ধরতে র্যাব নৈকাঠির বাড়িতে হানা দেয়। তবে আগাম খবর পেয়ে মিজান আগেভাগেই সরে পড়ে। তবে র্যাব মিজানের চার সহযোগীকে গ্রেফতার এবং মিজানের জার্মানির তৈরি দুটি অত্যাধুনিক রিভলবার উদ্ধার করে।
অন্যদিকে ৩০ এপ্রিল গভীর রাতে শেরে বাংলা নগর থানা পুলিশ সংসদ ভবন সংলগ্ন এমপি হোস্টেল সংলগ্ন লেক থেকে খুন হওয়া অজ্ঞাতনামা যুবকের ভাসমান লাশ উদ্ধার করে।
গত ১৪ এপ্রিল সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ১২-১৪ জন সশস্ত্র ব্যক্তি নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে শহিদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী রানীকে তুলে নিয়ে যায়।
নিহত শহীদুল্লাহর স্ত্রী রানী বেগম জানান, পহেলা বৈশাখ সারাদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে রাতে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত পৌনে ১২টায় তারা আমিনবাজার ব্রিজের কাছে এলে সাদা ও লাল রঙের দুটি গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। গাড়ি থেকে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোক তাদের দু’জনকে আটক করে নিয়ে যায়। সাভারের গোল্লারপুর তালতলা এলাকায় নিয়ে আটককারীরা নিজেদের র্যাব সদস্য দাবি করে শহীদুল্লাহকে রেখে তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন শহীদুল।
একটি গাড়িতে র্যাব-৪ লেখা ছিল বলে রানী দাবি করেছেন। কিন্তু গত ২৬ এপ্রিল পল্লবীর প্রিয়াংকা স্যুটিং স্পটে তার লাশ পাওয়া যায়।
গত বছরের ১১ মে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে জেলগেটেই অপহরণ করা হয় রাকিবুজ্জামান রাকিবকে। এর আগে হত্যা মামলায় ১০ বছর জেল খেটেছিলেন তিনি। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এসএম কামরুজ্জামান ও আইনজীবীর সামনে থেকেই জেলগেটের ভেতর থেকেই সাদা পোশাকধারী একদল লোক রাকিবকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়।
এর পেছনে র্যাব-১০ লেখা একটি পিকআপও চলে যায়। এ সময় কামরুজ্জামান তাদের পরিচয় জানতে চাইলেও তারা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। পরদিন সকালে ইন্দিরা রোড থেকে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে তেজঁগাও থানা পুলিশ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তদন্ত করে এর সত্যতাও পেয়েছে।
আটকের পর নিখোঁজ : সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী গত ১৯ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে ঠাকুরগাঁও জেলার সালন্দর বিশ্ব ইসলামী মিশন মসজিদের সামনের সড়ক থেকে প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোশাকধারী একটি দল মোঃ আকবর আলী সর্দার নামে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায়।
আকবর সর্দারের বাড়ি মাদারীপুরে। তার ভাই আইয়ুব আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, ১২ থেকে ১৪ জনের একটি সশস্ত্র দল প্রকাশ্যে সড়ক থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকেই তার কোনো সন্ধান মেলেনি। আইয়ুব আলী অভিযোগ করেছেন, মাদারীপুর এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল। এ কারণেই তিনি এলাকা ছেড়ে ঠাকুরগাঁও এলাকায় অবস্থান করছিলেন।
রাজধানীর পল্লবীর ১১ নাম্বার সেকশনের বি-ব্লকের ১ নম্বর ওয়াপদা ভবন থেকে গত ১৪ মার্চ রাত ৩টার দিকে দুই ভাই জালাল ও লালবাবুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের অভিযোগ র্যাব পরিচয় দিয়েই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি দুই ভাই জালাল ও লালবাবুকে। তাদের ভাই শাহাবুদ্দিন জানান, জালালকে গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইলে লালবাবুকেও গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। পরদিন তাদের খোঁজ নিতে র্যাব অফিসে গেলে র্যাব কর্মকর্তারা বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করেন।
এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ পাননি পরিবারের সদস্যরা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার তেরমনি পিরোজপুর গ্রাম থেকে র্যাবের একটি টিম মোঃ সেলিম, মোহাম্মদ আলী ও মইনুল নামে তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলীকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। মইনুলকেও থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেলিমের কোনো খোঁজ পাননি তার পরিবারের সদস্যরা।
র্যাব কর্মকর্তারাও তার গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করছেন।
কারওয়ান বাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাইদুলকে পহেলা বৈশাখের রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর হাসিবুল হক জনি নামের এক ব্যক্তিকে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে অপহরণ করা হয়। তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
গত বছরের ২২ জুলাই সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়াবাজার থেকে ঢাকার র্যাব-৩-এর হাতে আটকের পর নিখোঁজ রামপুরার ব্যবসায়ী মোঃ তুষার ইসলাম টিটু।
র্যাব তাকে গ্রেফতারের বিষয় অস্বীকার করেছে। এতে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ তদন্ত করে র্যাবের হাতে গ্রেফতারের সত্যতা পায়। বিষয়টি সরকারের গোচরে আনা হলে এর তদন্তও করা হয়। অধিকারের এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তের পর কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানানো হয়নি।
রাজধানীর খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক মাহমুদুল হক রনি গত ২৭ অক্টোবর সকালে বাসাবোর বাসা থেকে কাফরুলে খালার বাসায় বেড়াতে যান।
রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার পথে কাফরুল আর্মি চেকপোস্টের কাছে র্যাব পরিচয় দিয়ে তাকে গ্রেফতার করার কথা বলে ধরে নিয়ে যায়।
গত বছরের ২৯ জুন সন্ধ্যায় ব্যবসায়ী জহির রায়হান হিরনকে তার ধানমন্ডির সার্কুলার রোডের ৫১ নম্বর বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাদের খোঁজ পাননি স্বজনরা।
এর আগে ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশাল থেকে শফিক উল্লাহ নয়নকে ধরে নিয়ে যায় র্যাব। তাকে গ্রেফতারের সময় র্যাবের আইডি কার্ড দেখানো হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশন পুলিশ ও র্যাবকে চিঠি দিলেও তারা কোনো সদুত্তর পাননি।
রুলের জবাব দেয়নি র্যাব : ২০০৮ সালের ২৫ মে গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানার উত্তর দত্তপাড়া বাসিন্দা মোঃ হাসান খানকে টঙ্গী কলেজ রোড বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে র্যাবের একটি দল গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে র্যাব তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে। তার স্ত্রী হাসি বেগম ২৯ মে হাসান খানের গ্রেফতারের কারণ ও অবস্থান জানতে চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবরে আবেদন করেন।
পুলিশ সদর দফতর তার কোনো উত্তর দেয়নি। ২২ জুন পরিবারের পক্ষ থেকে গ্রেফতার ও নিখোঁজ প্রসঙ্গে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২৩ জুলাই র্যাবের মহাপরিচালক বরাবরে হাসান খানের অবস্থান ও অবস্থার সংবাদ তার পরিবারকে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়। র্যাবের পক্ষ থেকে চিঠির কোনো উত্তর দেওয়া না হলে ওই বছরেরই ২৩ অক্টোবর হাসান খানকে আদালতে উপস্থাপন করার জন্য হেবিয়াস কর্পাস রিট মামলা করা হয়। ২৬ অক্টোবর শুনানি শেষে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মোঃ আবু তারিকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ হাসান খানকে তিন সপ্তাহের মধ্যে আদালতের সামনে উপস্থিত করার জন্য র্যাবের প্রতি রুলনিশি জারি করেন।
এটি বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের লিগ্যাল এডভোকেসি এন্ড পলিসি রিফর্ম ইউনিট সমন্বয়ক আবু ওবায়দুর রহমান বুধবারকে জানান, এ রুলের কোনো জবাব দেয়নি র্যাব। আর হাসানকেও ফিরে পায়নি তার পরিবার। অন্য হাজারো রিট আবেদনের মতো এটাও শুনানির জন্য ঝুলে রয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালকের বক্তব্য : এসব অভিযোগের বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার বুধবারকে বলেন, সাদা পোশাকে গ্রেফতার আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে হলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
গ্রেফতারের সময় পরিচয়পত্র প্রদর্শনের বিধি রয়েছে। এর বাইরে কেউ কোনো কাজ করলে তা প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যেখান থেকেই গ্রেফতার করা হোক না কেন বিধান মেনেই গ্রেফতার করতে হয়। তিনি বলেন, হাইকোর্ট আমাদের যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন আমরা তা হুবহু পালন করছি।
শেষ কথা : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম করে কাউকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তার লাশ পাওয়া যাওয়া শুধু গভীর উদ্বেগজনক ঘটনাই নয় বরং তা রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নাগরিকের সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এটা আইনের শাসনের প্রতি জনগণের অনাস্থাকে আরো প্রকট করে তুলবে এবং তা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ডেকে আনবে মহাবিপর্যয়। এ ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতাও নেই। দেশের মানুষ সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হতে চায়। এটা অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন। আর সে কারণেই সবগুলো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এখনই সব ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধ করা উচিত।
সূত্র: সাপ্তাহিক বুধবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।