হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
মুসলমান দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুধুমাত্র তারকা ক্ষাতি প্রাপ্ত কয়েকজনকে নিয়ে আলোচনা করেই পতন পর্বে চলে যেতে হচ্ছে। ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালটায় বহু দার্শনিক/বিজ্ঞানীরই আবির্ভাব ঘটেছিল আরব ভূখন্ডে এবং এতো বিচিত্র ছিল তাদের দার্শনিক এবং ধর্ম বিষয়ক চিন্তা ভাবনা যে তাদের সবাইকে নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে একেবারেই সম্ভবও না। ইবনে সাহ্ল, ইবনে আল হাইথাম, বানু মুসা, থাবিথ ইবনে কারা এহেন আরো বহু দার্শনিক বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটে এই সময়টায় যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুতাজিলা সমর্থক অথবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পোষন করতেন রক্ষনশীল ইসলামের বিরোধী মতাদর্শ। এদের মধ্যে আল হাইথাম’কে এমনকি আধুনিক যুগের মাপকাঠিতেও একজন পুরো মাত্রার বিজ্ঞানী বলা যায়। আধুনিক দৃষ্টিবিজ্ঞানের পিতা বলে ক্ষাত আল হাইথাম এমন এক দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন যা ছিল আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পূর্বসূরী।
তিনি সরাসরি পরীক্ষা নিরিক্ষা ও পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে সত্য উদঘাটনের পক্ষে ছিলেন। কম বয়সেই পৃথিবীর এত এত ধর্ম আর মতাদর্শগত গোলমালে বিতশ্রদ্ধ হয়ে এবং ধর্ম বিষয়ে গভীর পড়াশোনার পর হাইথাম পৃথিবীর তৎকালিন সব ধর্মকেই মিথ্যা বলে ঘোষনা করেছিলেন। হাইথামের মত এহেন আরো বহু মনিষীকে নিয়ে আলোচনা বাদ রেখেই আমাদের চলে যেতে হচ্ছে পতন পর্বে।
পতন পর্ব
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের পতন হঠাৎ করে হয় নাই। উত্থানও কোন হঠাৎ ঘটনা ছিলনা।
আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি, প্রায় দেরশ বছরের ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক পটভূমি ভূমিকা রেখেছিল উত্থানের পেছনে। পতন পর্ব অবশ্য আরো দীর্ঘ সময় স্থায়ি ছিল। মূল আরব ভূখন্ডে যখন পতনের কাল শুরু হয়ে গেছে, পশ্চিমে স্পেনের মুসলমানরা তখন আরো এগিয়ে গেছেন দর্শন আর বিজ্ঞানের চর্চায়।
খলিফা মামুনের শাসনামলের শেষ দিকেই রক্ষনশীল আলেম সমাজ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে আবির্ভাব হয়। তবে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সময় থেকেই মুতাজিলা এবং মুসলিম দার্শনিকরা আব্বাসিয় খলিফাদের কাছ থেকে সরাসরি পৃষ্টপোশকতা হারায়।
তবে এসব ঘটনায় ততদিনে আরব বিশ্বের বিভিন্ন অংশে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভাটা পরে নাই। আল ফারাবি, ইবনে সিনার মতো দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্টপোশক অনেক আঞ্চলিক শাসনকর্তার দরবার ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু সময়টা ধিরে ধিরে হয়ে উঠতে থাকে রাজনৈতিক ধর্মীয় মতাদর্শগতভাবে চরম অস্থিতিশীল। এহেন অস্থিতিশীল সময়ের একটা পর্যায় থেকেই আমি শুরু করবো পতনের গল্প, সময়টা ১১ শতক।
পতনের পটভূমি
১১ শতকের আরব দুনিয়া।
ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে অস্থির একটা সময়। মুসলিম বিশ্ব তখন তিন খেলাফতের মাঝে বিভক্ত। আব্বাসিয়দের হাতে পতনের পর উমাইয়াদের একটা অংশ ৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনে প্রতিষ্ঠা করে কর্ডোভার খেলাফত। ইসমাইলি সিয়ারা ৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করে ফাতেমিয় খেলাফত, এই খেলাফত বিস্তৃত ছিল পুরো মুসলিম আফ্রিকা এবং আরবের একটা বড় অংশ জুড়ে। আরব ভূখন্ডের বাকি অংশে ছিল আব্বাসিয় খেলাফত।
রাজনৈতিকভাবে ফাতেমিয় এবং আব্বাসিয় আর ধর্মতাত্ত্বিকভাবে ইসমাইলি আর সুন্নি বিরোধ তখন চরমে। মুতাজিলা এবং পবিত্র ভাতৃসংঘের* মতো সংগবদ্ধভাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার গোষ্টিগুলো ততদিনে বিলুপ্ত। তার বদলে আবির্ভাব ঘটেছে বিভিন্ন কট্রর জঙ্গিবাদী সংগঠন অথবা উদার সুফি সংগঠনের।
পতনের গল্প
আমাদের পতনের গল্পের সময় ব্যাপ্তি, ঘটনা আর চরিত্র অনেক বেশি হলেও আলোচনার স্বার্থে বিশেষ কয়েকজন ব্যাক্তির জীবন, কাজ এবং দর্শন নিয়ে আমরা আলোচনা করবো, তবে ধারাবাহিকভাবে না, আলোচনা পাশাপাশি চলবে, কারন এরা সবাই ছিলেন সমসাময়িক। আমাদের গল্পের মূল নায়ক তিনজন, আল-গাজালি (১০৫৮-১১১১), ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) আর হাসান ইবনে সাবা (১০৫০-১১২৪)।
এই তিনজন সেই সময়ের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ত্ব করতেন। ওমর খৈয়াম ছিলেন ফারাবি-সিনার যোগ্য উত্তরসূরী, একজন পরিশ্রমী বিজ্ঞানী, ভাবুক কবি। গাজালি ছিলেন রক্ষনশীল এবং সুফি পন্থার সমন্বয়কারি ব্যাক্তি, একই সাথে এই দুই শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করতেন তিনি, তবে দুই শ্রেনীর গোড়াদেরই তিনি সমালোচনা করেছেন। আর হাসান ইবনে সাবা ছিলেন চরমপন্থী জঙ্গিবাদী এমন একটা অংশের প্রতিনিধি যারা তৎকালিন শাসন ব্যাবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধীতা করতো ।
তিনটা চরিত্রই ট্রাজিক চরিত্র, খানিকটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে যদিও।
আল-গাজালি এবং ওমর খৈয়াম দুজনেই সাচুক* সুলতান মালিক শাহএর পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। অন্যদিকে হাসান ইবনে সাবা ছিলেন মালিক শাহএর মহাশত্রু । কোন কোন ফারসি ঐতিহাসিকের দাবি অনুযায়ী হাসান আর খৈয়াম ছিলেন ছোটবেলার বন্ধু এবং পরবর্তিতে একজন কট্টর আস্তিকতা এবং আরেকজন নাস্তিকতার পথ বেছে নেন।
শুরুতেই আল-গাজালির প্রশঙ্গে আসি। গাজালির জন্ম ১০৫৮ খ্রীষ্টাব্দে, উত্তর ইরানের খোরাসানের তুস শহরে।
তার পুরো নাম আবু হামিদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজালি। প্রথম জীবনে তিনি দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। দর্শন ছাড়াও জীব বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সুলতান মালিক শাহ এর মন্ত্রী ঐ সময়ের আরেক মহামনিষি নিজামুল মুলকের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার শিক্ষকতার জীবন। ক্রমবর্ধমান ইসমাইলিয়া মতাদর্শ রুখতে নিজামুল মুলক সে সময় বেশ কিছু সুন্নি আইনশাস্ত্রের একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।
গাজালি এসব একাডেমিতে শাফি আইতত্ত্ব এবং আশারিয়া ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিতেন। এমনকি ভবিষ্যতে সুফিবাদের পথ বেছে নিলেও মধ্যপন্থি শাফি আইন এবং আশারিয়া ধর্মতত্ত্বে তিনি ছিলেন আস্থাশীল, যদিও কট্রোর হাম্বলিদের তিনি কখনো সমর্থন করেন নাই।
ওমর খৈয়ামের জন্মও খোরাসানে, নিশাপুর নামক স্থানে। তিনি কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন না। বিদ্যানুরাগের কারনেই তিনি শেখ মুহাম্মদ মানসুরি এবং ইমাম মোয়াফফাক নিশাপুরির মতো তৎকালিন সময়কার খোরাসানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের শিষ্য হতে পেরেছিলেন।
তিনি ছিলেন তার সময়কার পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইবনে সিনার দর্শনের শিক্ষা দিয়েগেছেন তার ছাত্রদের। সুলতান মালিক শাহএর সহায়তায় তিনি একটি মানমন্দির গড়ে তোলেন। এই মানমন্দিরেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার স্বর্বশ্রেষ্ট গবেষনা কর্মগুলো সম্পন্ন করেন। তার সময়কার বহু জ্যোতির্বিদের আগমন ঘটেছিল এই মানমন্দিরে।
হাসান ইবনে সাবার জন্ম ইরানের কোমে। এক বারপন্থি সিয়া পরিবারে জন্ম নেন তিনি। পরবর্তিতে তার পরিবার রাই শহরে বসবাস করা শুরু করে, যা ছিল তৎকালিন সময়কার অন্যতম জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। অল্প বয়সেই তিনি ভাষা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গনিতে বুৎপত্তি অর্জন করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে পারিবারিক ধর্মীয় মতাদর্শ ত্যাগ করে তিনি ইসমাইলিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আব্বাসিয় ভূখন্ডের গুপ্ত ইসমাইলিয়াদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকায় আবির্ভূত হন।
(চলবে)
*পবিত্র ভাতৃসংঘ = পবিত্র ভাতৃসংঘ ছিল বসরার একটি গুপ্ত দার্শনিক সংঘ। এদের বিষয়ে এই সিরেজে আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হয় নাই।
*সাচুক= সেলঝুক বলতে আমরা যে শব্দটা ব্যাবহার করি তা তুর্কিশ সাচুক শব্দের ইংরেজি থেকে আসা বিকৃত রূপ। প্রকৃত উচ্চারন সাচুক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।