হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আরব দার্শনিকরা প্রথম থেকেই রক্ষনশীল এবং মৌলবাদীদের বিরোধীতার মুখে পরেন। এমনকি আল-কিন্দির মতো ধর্মপ্রাণ দার্শনিককেও আখ্যায়িত করা হয় কাফির বলে। সমন্বয়বাদি দার্শনিক আল-কিন্দি প্রতিবাদে বলেছিলেন “যথার্থ দার্শনিক নয়, বরং ধর্মীয় মুখপাত্ররাই অধার্মিক। তাঁরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করায় প্রবৃত্ত। ধর্মকে কেন্দ্র করে শক্তি অর্জন এবং সেই শক্তির ভিত্তিতে স্বার্থ-সংরক্ষনের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এমন কিছু বাজে অজুহাতে সৎ মানুষের সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি করেন যেগুলোর স্রষ্টা ও হোতা তারা নিজেরাই”।
তবে আল-কিন্দির পর তার নিজ শিষ্য আল-শারখসি সমন্বয়বাদের বদলে ধর্মীয় সংশয়বাদ বেছে নেন, পরিণামে জীবন দিতে হয় তাকে। পরবর্তিতে পারস্য দেশীয় দার্শনিক রাওয়ান্ডির হাতে আরব দর্শনে ধর্মীয় সংশয়বাদ আরো বিকোষিত হয়। কিন্তু ধর্মীয় সংশয়বাদ যার হাতে চুরান্তরূপ ধারণ করেন তিনি হলেন আরবের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক ইবনে ইয়াহিয়া আল-রাজি। আল-রাজির পর থেকে বেশিরভাগ মুসলমান দার্শনিক/বিজ্ঞনিরাই ধর্মিয় অনুশাসনের চেয়ে দর্শন চর্চাকেই নিজেদের জন্য উপযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করতে থাকেন।
আল রাজি (৮৬৫-৯২৫)
পরিচয় ও কর্মযজ্ঞঃ আল রাজিকে গণ্য করা হয় দশম শতাব্দিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বাধিক খ্যাতিমান ও প্রামানিক লেখক হিসেবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং রসায়ন বিজ্ঞানী হিসাবে অধিক খ্যাতিমান হলেও তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ, অর্থাৎ বহুগুনের অধিকারী ব্যক্তি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ২০০ এর অধিক পুস্তক এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। একমাত্র গনিত ছাড়া সমসাময়িক জ্ঞান বিজ্ঞানের সব বিষয়েই তিনি অবদান রেখে গেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর রচিত তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম আল-হাবি। ১২৯৭ সালে এই পুস্তক ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় কনটিনেন্স নামে এবং ষোল শতক পর্যন্ত ইউরোপে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হয়।
পারস্যের খুরাসানে জন্ম নেয়া এই মহান ব্যক্তি প্রথম জীবনে রসায়ন শাস্ত্রে গবেষনায় নিয়োজিত হন। কিন্তু পরে তার চোখে সমস্যা হওয়ায় রসায়ন বিষয়ক গবেষনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। নিজের চোখের চিকিৎসা করতে গিয়েই আগ্রহী হন চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি এবং এক পর্যায়ে পরিণত হন নিজের সময়ের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানীতে। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে তিনি খুরাসানের এক হাসপাতালের পরিচালক নিযুক্ত হন। খলিফা মুকতাদির শাসনামলে তিনি বাগদাদের একটি হাসপাতালের পরিচালক নিযুক্ত হন।
খলিফা মুকতাদির মৃত্যুর পর তিনি নিজ শহরে ফিরে আসেন। এসময় তার কাছে অনেক ছাত্রের সমাগম ঘটে। বাকি জীবন তিনি নিজের ছাত্র, রোগি এবং গবেষনা নিয়ে কাটিয়ে দেন। ছাত্রদের নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি পাঠচক্র তৈরি করেন। বিজ্ঞান বা দর্শনের কোন প্রশ্ন এলে তিনি কোন একটি পাঠচক্রকে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব দিতেন, সেই পাঠচক্র ব্যার্থ হলে দায়িত্ব নিত অন্যকোন পাঠচক্র।
সবাই ব্যার্থ হলে আল রাজি নিজেই সমাধান দিতেন।
জ্ঞান চর্চা আর মানব সেবাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, এই কারনে শাসকের দরবার তিনি সব সময় এড়িয়ে গেছেন। শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানই নয়, চিকিৎসার নৈতিকতা নিয়েও তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি একজন নীতিবান চিকিৎসক ছিলেন। কোন অর্থ দাবি না করেই রোগিদের চিকিৎসা করতেন।
ছাত্র আর রোগিদের সময় দেয়ার বাইরে যেটুকু সময় পেতেন পড়াশোনা করতেন। অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণেই শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। তবে দৃষ্টিশক্তি ফেরানোর সুযোগ থাকলেও তিনি তা অস্বিকার করেন। তার যুক্তি ছিলো যে তিনি পৃথিবীর অনেক কিছু দেখে ফেলেছেন, আর বেশি কিছু তার দেখারা নাই। ৯২৪ কিংবা ৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই মহামানব দেহত্যাগ করে পরবর্তি প্রজন্মের মুক্তমনা জিজ্ঞাসুদের চেতনায় অমরত্ব লাভ করেন।
ধর্ম ও দর্শনঃ জগৎ, স্রষ্টা আর সৃষ্টি বিষয়ে আলোচনায় অনেক ক্ষেত্রেই আল-রাজি ছিলেন অনন্য। অনেক ক্ষেত্রে তিনি প্লেটো, এরিস্টটল অথবা অন্য গ্রিক দার্শনিকদের মতকে সমর্থন করেন, আবার অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ভিন্ন মত পোষন করেন। তবে তার অধিবিদ্যা বিষয়ক গবেষনার মূল প্রেরণা ছিলেন প্লেটো আর নীতিবিদ্যা বিষয়ে তিনি ছিলেন সক্রেটিসের ভক্ত। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি যেমত পোষন করেন তা তার সময়ে ইসলাম পরিপন্থি এবং খুব কম দার্শনিকের মত হলেও পরবর্তি সময়ের দার্শনিকরা এই মতের কাছাকাছি মতামতই পোষন করেন। স্রষ্টা শুন্য থেকে কোন কিছু সৃষ্টি করেছেন এটা তিনি মানেন নাই।
তার বক্তব্য ছিলো জগৎ সৃষ্টি হয়েছে আকারবিহীন জড় থেকে যা স্রষ্টার মতই অনাদিকাল যাবৎ অস্তিত্ববান ছিল। পরবর্তিতে আল-ফারাবি এবং ইবনে সিনাও কাছাকাছি মত প্রকাশ করেন। আত্মা বিষয়ে তিনি জন্মন্তরবাদে বিশ্বাস করতেন আরব দার্শনিকদের ইতিহাসে যা মোটামুটি বিরল ঘটনা।
প্রচলিত ধর্ম সম্বন্ধে আল-রাজি ছিলেন সংশয়বাদি। ওহি বা প্রত্যাদেশ এবং নবী রাসুলদের তিনি পুরোপুরি অস্বিকার করেন।
ধর্ম বিষয়ে তিনি তিনটা পুস্তক রচনা করেন। পুস্তকগুলির নাম ‘নবীর ভন্ড চাতুরি’ ‘নবীর দাবিওয়ালাদের ছল চাতুরি’ এবং ‘প্রত্যাদিস্ট ধর্মসমূহ প্রশঙ্গে’। রাজি বলেন, “আল্লাহ অবশ্যই নবুয়তের জ্ঞান দিয়ে একজন মানুষকে অন্যদের ওপরে স্থান দেবেন না এবং আবার সেই নবীদের মধ্যেই এত শত্রুতা আর মতপার্থক্য দেবেন না যাতে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে”। ধর্মযুদ্ধ বিষয়ে তিনি বলেন, “ সারা দুনিয়ায় গোলমাল লেগে যাবে এবং এরা একদল আরেক দলের সাথে খুনাখুনি হানাহানি করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমরা দেখেছি, এইভাবে এখন পর্যন্ত কম লোক নিহত হয় নাই”।
সাধারণ ধার্মিক ব্যক্তিদের মধ্যে যুক্তি এবং জ্ঞান চর্চার অভাববোধ আছে বলে সমালোচনা করেন তিনি। ধর্ম বিষয়ে কোন যৌক্তিক প্রশ্ন করা হলে মৌলবাদী ধার্মিকরা যে চরম প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় সে প্রশঙ্গে তিনি বলেন, “ যখনি কোন ধার্মিক ব্যাক্তিকে তার ধর্মের পক্ষে যুক্তি এবং প্রমান দিতে বলা হয়, তখনি সে জ্বলে ওঠে, রেগে যায় এবং প্রশ্নকারির রক্ত ঝরায়। এরা যৌক্তিক মতামতকে অস্বিকার করে, প্রতিপক্ষকে হত্যা করে। এদের কারণেই সত্য নিস্তদ্ধ হয়েছে”। তিনি মনে করতেন যে ধর্মিয় কর্তৃপক্ষের সম্মানিত ব্যাক্তিরা নিজেদের সম্মানজনক অবস্থানকে পুঁজি করে সাধারণ জনগনকে বিশ্বাসের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন যাবৎ নিজস্ব ধর্মীয় পরিমন্ডলে বসবাসের ফলে মানুষের কাছে তার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার একধরণের অভ্যাসে পরিনত হয়। এ অবস্থায় তারা ধর্মীয় সভার সম্মানিত আসনে বসা দাড়িওয়ালা ছাগলদের গালভরা মিথ্যা, মিথ আর গল্পগুজবে বিশ্বাস স্থাপন করে”। তিনি বলতেন, দুনিয়ায় ধর্মের সংখ্যা এত বেশি যে এতে প্রমানিত হয় যে এইসব ধর্ম মানুষেরই তৈরি। তিনি বলেন, “ ইসা বলেছে যে সে আল্লাহর পুত্র, মুসা দাবি করেছে যে তার কোন পুত্র নাই, মোহাম্মদ দাবি করেছে যে ইসা দুনিয়ার আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। মানি আর জরাথ্রুস্তার মতের সাথে মুসার মত মেলেনা, ইসা আর মোহাম্মদের মধ্যে আল্লাহ, জগতের সৃষ্টি এবং জগতে ভালো মন্দের উপস্থিতি নিয়ে নিয়ে মতভেদ রয়েছে”।
তাওরাতে আল্লাহর কুরবানী দাবি করা প্রশঙ্গে তিনি বলেন, “এই ধরণের আল্লাহকে পরিপূর্ণ নয় বরং অভাবি বলেই মনে হয়”। কোরআন সম্পর্কে তিনি বলেন, “ তোমরা দাবি কর যে প্রামানিক মিরাকল একটা আছে, আর সেই মিরাকল হলো কোরআন। তোমরা বলো, যে এই কোরআনকে অস্বিকার করবে তারা পারলে এইরকম আরেকটা কিছু তৈরি করে দেখাক। আমি বলি, অবশ্যই, এইরকম আরো হাজারটা তৈরি করা যাবে, সুবক্তা পন্ডিত আর সাহসি কবিদের সৃষ্টিকর্ম থেকে এইরকম আরো হাজারটা তৈরি করা যাবে,এমনকি সেগুলোতে ভাব এবং ভাষার গঠন আরো ভালো হবে এবং আরো কম কথায় বেশি ভালো ভাবে বোঝানো যাবে”।
পক্ষ-বিপক্ষঃ আল-রাজি তার নিজের সময়ে এবং পরবর্তি সময়েও একজন কঠোর ধর্মবিরোধী এবং কাফির হিসাবে ধর্মবেত্ত্বাদের দ্বারা নিন্দিত হন।
এছাড়াও দার্শনিকদের মধ্যেও তার অনেক সমালোচক ছিলো। তবে তার এই সংশয়বাদ ভিন্ন বিষয় বস্তুর ক্ষেত্রে হলেও পরবর্তি দার্শনিকদের মধ্যে অব্যাহত থাকে। কোন সুলতানের দরবার বা দয়া দাক্ষিন্য এড়িয়ে চলায় তাকে নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ খুব বেশি মানুষ পায় নাই। এছারাও সর্বদা রোগি এবং ছাত্রদের ভালোবাসার মধ্যে অবস্থান করায় এবং চিকিৎসক হিসেবে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ায় তাকে কোন ধর্মীয় বিচারের সম্মুখিন হতে হয় নাই।
চলবে।
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।