হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আগের পর্বেই উল্লেখ করেছি, আব্বাসিয় খলিফাদের আমলেই মুসলিম সাম্রাজ্যে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার বিকাশ। রক্ষনশীলদের গুরুত্ব না দিয়ে মুতাযিলাদের মতো মুক্তবুদ্ধি সম্পন্য চিন্তাবীদদের পক্ষে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে মুতাযিলারা ছিলেন ধর্মতাত্ত্বিক। যুক্তির আলোকে ইসলামি ধর্মমত বিশ্লেষন এবং ইসলামের বিভিন্ন মতাদর্শকে যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিলো তাদের মূল লক্ষ। তবে তাদের সমসাময়িক সময়েই কেউ কেউ যুক্তিবাদ এবং বুদ্ধিবাদী প্রয়োগপদ্ধতিতে শুধু ধর্মীয় সমস্যাই না বরং মৌলিক দার্শনিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন, এরাই পরবর্তিতে ফালাসিফা বা মুসলিম দার্শনিক হিসেবে পরিচিত হন।
মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের জন্য আব্বাসিয় খলিফাদের প্রাথমিক সময়টা ছিলো খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। মুতাযিলারা মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে জোয়ার নিয়ে এসেছিলো। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় পাওয়া যেতো রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা। সেই সাথে খলিফ মনসুরের সময় থেকেই গ্রিক, কপটিক, ভারতীয় ইত্যাদি ভাষার গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক অনুবাদ করা হয় যার মাধ্যমে জ্ঞান অনুসন্ধানিরা গ্রিক এনং ভারতীয় বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। তবে দার্শনিকদের মতবাদ এবং দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষনশীলরা কখনোই গ্রহণ করেনি।
প্রথম থেকেই দার্শনিকরা ছিলেন নানারকম অপবাদ আর নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার। আল-গাজালির সময়কাল থেকে ধর্মীয় মহলে তাঁদের রচনাবলি উপেক্ষিত হতে থাকে এবং এক পর্য্যায়ে এই দার্শনিকরা মুসলিম সমাজ থেকে পুরোপুরি প্রত্যাখাত হন। তবে তাঁদের কর্মযজ্ঞ বিফলে যায় নি, মূলত মুসলিম দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের পথ অনুসরণ করেই রেঁনেসার পথে অগ্রসর হন ইউরোপের দার্শনিক/বিজ্ঞানীরা।
আপাতত আমরা ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের কাজ, দর্শন এবং তৎকালিন সময়ে মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে তাঁরা কি ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন তারা হয়েছিলেন তা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো। স্বল্প পরিসরে প্রত্যেকের পরিচয় ও কর্মযজ্ঞ, ধর্ম ও দর্শন এবং পক্ষ-বিপক্ষ তুলে ধরা হবে।
আল-কিন্দি ( ৮০১-৮৭৩)
পরিচয় ও কর্মযজ্ঞঃ আল-কিন্দি’কে বলা হয় আরবের দার্শনিক। তার পুরো নাম আবু ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি। ইউরোপে তিনি পরিচিত হন আলকিন্দুস নামে। আরব দার্শনিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আধুনিক ইউরোপিয় দর্শনে রেনে দেকার্ত যে ভূমিকা রেখেছেন আল-কিন্দিও আরব দর্শনে রেখেছেন একইরকম ভূমিকা।
একারণেই তাকে অনেকে বলেন, দার্শনিকদের দার্শনিক। রেনে দেকার্তের সাথে তার আরেকটা মিল হলো দেকার্তের মতোই তিনি দর্শন চর্চায় গনিতের ব্যপক প্রয়োগের পক্ষে ছিলেন।
কিন্দি গ্রিক এবং সিরীয় ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। এই দুই ভাষা থেকে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে এরিস্টটলের ‘মেটাফিজিকস’, টলেমির ‘ভূগোল’ এবং প্লোটিনাসের ‘এন্নিয়াডস’ উল্লেখযোগ্য।
দার্শনিক পরিচয় ছাড়াও তিনি গানিতিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
তিনি প্রায় ২৭০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। তিনি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, পাটীগণীত, বীজগণিত, সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাত্র, রসায়ন, মনোবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান এহেন বহু বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি ছিলেন সমসাময়িক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। পরীক্ষামূলক মনোবিদ্যার আদীপিতাদের মধ্যে তিনি একজন।
সঙ্গীত থেরাপিতে রেখে গেছেন বিশেষ অবদান। ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করা তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে মনে করা হয়।
ধর্ম ও দর্শনঃ আল-কিন্দি একজন ধার্মিক ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি ধর্ম আর দর্শনের সমন্বয় চেয়েছিলেন। তার প্রাথমিক কিছু লেখায় তিনি দর্শনকে ধর্মের ওপর স্থান দিলেও তার পরের দিকের বেশিরভাগ লেখাতেই তিনি ধর্মতত্ত্বকে দর্শন ও পদার্থ বিজ্ঞানের ওপর স্থান দিয়েছেন।
একদিকে তিনি এরিস্টটলের অনেক মতের সমরর্থন করেন আবার অন্যদিকে ধর্মের সাথে সমন্বয়ের খাতিরে অনেক মতের বিরোধীতা বা পরিমার্জন করেন। এ কারনেই এরিস্টটলের অচালিত চালকের ধারণাকে তিনি পরম স্রষ্টার ধারণায় পরিণত করেন। তিনি মনে করতেন দর্শন একটি ধারাবাহিক জ্ঞান প্রক্রিয়া। প্রত্যেক দার্শনিকই অতীত দার্শনিকদের কাছে ঋণী। এ কারণে প্রত্যেক জ্ঞানানুসন্ধানী দার্শনিকের উচিত দেশ-ধর্ম নির্বিচারে সকল দার্শনিকের রচনা পাঠ করা।
তিনি মনে করতেন, যুক্তিবাদী পদ্ধতিতে সত্যের অনুসন্ধানকে যারা ধর্মবিরোধী কাজ বা কুফর বলে প্রচার করেন, তারা নিজেরাই ধর্মবিরোধী কাজ করেন। তিনি ছিলেন মুতাযিলাদের সমসাময়িক। ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে তিনি মুতাযিলাদের মতের সমর্থক ছিলেন। মুতাযিলাদের মতো তিনিও আল্লাহর সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন আল্লাহর গুণাবলীর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি মুতাযিলাদের পদ্ধতিতে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন নি।
মুতাযিলারা যেখানে আল্লাহর আল্লাহর অন্তঃসার এবং গুণাবলি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন সেখানে তিনি মাথা ঘামিয়েছেন আল্লাহর সত্ত্বায় ক্যাটাগরি প্রয়োগ করা যায় কিনা তা নিয়ে। তার বক্তব্য ছিলো যে, যে কোন বস্তুকে জানতে হলে তার ‘প্রজাতি’ এবং অন্য বস্তুর সাথে তার ‘পার্থক্য’ জানতে হবে। আল্লাহর সত্ত্বায় এইরকম ‘প্রজাতি’ আর ‘পার্থক্য’ এর অস্তিত্ব না থাকায় তিনি আল্লাহর সত্ত্বা বিচ্ছিন্ন গুনাবলীর অস্তিত্ব অস্বিকার করেন।
পক্ষ-বিপক্ষঃ আল-কিন্দি মুতাযিলাদের বন্ধু হিসাবে পরিচিত আব্বাসিয় খলিফা আল-মামুন, আল-মুতাসিম এবং আল-ওয়াতিকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তবে মুতাযিলাদের ওপর খড়গহস্ত খলিফ আআল মুতাওয়াক্কিলের সময় আল-কিন্দি বিপদাপন্ন হন।
কিন্দি ধনী ছিলেন, এবং বহু অর্থ ব্যায় করে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তোলেন। খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশে তার পাঠাগারটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে কিন্দি নিজে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হওয়ায় পরবর্তিতে পাঠাগারটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। এছাড়াও আল্লাহর গুনাবলী নিয়ে নিজস্ব তত্ত্বের জন্য ধর্মবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হন আল-কিন্দি। রক্ষনশীল এবং মৌলবাদিরা তার বিরুদ্ধে ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগ আনে।
তবে প্রভাবশালী আল-কিন্দি বরাবরই নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি মনে করতেন, যুক্তিবাদী পদ্ধতিতে সত্যের অনুসন্ধানকে যারা ধর্মবিরোধী কাজ বা কুফর বলে প্রচার করেন, তারা নিজেরাই ধর্মবিরোধী কাজ করেন। তিনি বলেছিলেন, “যথার্থ দার্শনিক নয়, বরং ধর্মীয় মুখপাত্ররাই অধার্মিক। তাঁরা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করায় প্রবৃত্ত। ধর্মকে কেন্দ্র করে শক্তি অর্জন এবং সেই শক্তির ভিত্তিতে স্বার্থ-সংরক্ষনের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এমন কিছু বাজে অজুহাতে সৎ মানুষের সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি করেন যেগুলোর স্রষ্টা ও হোতা তারা নিজেরাই”।
আল-কিন্দির এ বক্তব্য তখনকার সময়ে যমন সত্য ছিলো আজকের দিনেও ঠিক একইরকম সত্য।
সংশয়বাদের উত্থান, সারাখশি ও রাওয়ান্ডিঃ
আল-কিন্দি মুক্তবুদ্ধি চর্চার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ইসলামের মৌল ধর্ম বিশ্বাসের সাথে তিনি কোন বিরোধীতায় যান নাই। ইসলামের মৌল বিশ্বাসের বিষয়ে তিনি সংশয়বাদী ছিলেন না। কিন্তু আল-কিন্দির পর থেকেই আরব দার্শনিকদের মধ্যে সংশয়বাদের উত্থান ঘটে।
আল-কিন্দিরই অন্যতম শিষ্য আহমদ বিন আলি তাইয়েব আল শারখসি আরব দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সংশয়বাদী দার্শনিক হিসাবে বিখ্যাত। সারাখশি ছিলেন আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাদিদের গৃহশিক্ষক। শারখশি যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ও জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাপক সূনাম অর্জন করেন। বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ কৃতিত্বের কারণে তিনি খলিফার সান্নিধ্য ও আনুকূল্য লাভ করেন। পরবর্তিতে তিনি তার বই পুস্তকে সংশয়বাদী মতবাদ প্রচার করায় রক্ষনশীলদের পক্ষ থেকে ব্যপক বিরোধীতার সম্মুখিন হন।
এইসব কারণে এবং একই সাথে তার ক্রমবর্ধমান খ্যাতির কারণে ইর্ষান্বিত হয়ে খলিফা তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। ৮৯৯ সালে এই মুক্তবুদ্ধির দার্শনিক স্বাধীন মত প্রকাশের অপরাধে মৃত্যুবরণ করেন। তার বই পুস্তক এখন আর পাওয়া যায় না, তাই তার সম্বন্ধেও বিস্তারিত জানা যায় না। আল-বি্রুনির মতে, আল-শারাখসশি তার ধর্মিয় সংশয়বাদকে শুধু খলিফার সাথে আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বই পুস্তকে প্রকাশ করেছিলেন। নবী-পয়গম্বরদের তিনি সমালোচনা করেছিলেন বাগারম্বর এবং প্রতারক বলে।
তবে মুতাযিলাদের অনেক মতের সাথে তিন সহমত ছিলেন।
ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পারস্যের দার্শনিক ইবনে আল-রাওয়ান্ডি। কঠোর যুক্তিবাদী এই দার্শনিক ওহি বা প্রত্যাদেশ, অলৌকিক ঘটনার অতীন্দ্রিয় ভিত্তি, আল্লাহর অস্তিত্বের সপক্ষে যৌক্তিক উত্তরের সম্ভাবনা এবং জগৎ পরিচালনায় ইশ্বরের ধারণার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে এই বিষয়ক তার কোন পুস্তক এখন আর পাওয়া যায়না। কিছু কিছু সূত্র মতে তিনি ওহি বা প্রত্যাদেশের ঘটনাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি মনে করতেন, ভালো-মন্দ আর শুভ-অশুভের ফারাক বোঝার জন্য মানুষের যুক্তি বুদ্ধিই পর্যাপ্ত, ওহির কোন দরকার নাই। এছাড়াও যেসব অলৌকিক ঘটনার ওপর নবুয়্যাতের দাবি প্রতিষ্ঠিত সেইসব অলৌকিক ঘটনাকেও তিনি অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করেন। যানা যায়, শুরুতে তিনি মুতাযিলা ছিলেন, কিন্তু পরবর্তিতে গতানুগতিক ধর্মতাত্ত্বিক উত্তর তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। রাওয়ান্ডির লেখা কোন পুস্তক এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
পরবর্তি পর্বে আমরা সংশয়বাদী দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বৈপ্লবিক দার্শনিক আল-রাজি’কে নিয়ে আলোচনা করবো।
অনন্য প্রতিভাধর, বহু জ্ঞান আর গুনের অধিকারী আল-রাজি ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাধর চিকিৎসক এবং আল ক্যামিস্ট। আল রাজির পর আমরা ধারাবাহিক ভাবে আল ফারাবি এবং ইবনে সিনা’কে নিয়ে আলোচনা করবো।
চলবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।