মানুষের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে নিজের মনছবিতে উপলদ্ধির মাধ্যমে যিনি তা উপশম করার কায়দা জানেন তাকে আমরা ডাক্তার বলি। রোগে শোকে কাতর হলে আমরা উপলব্ধি করি এ অনন্য সাধারণ ব্যক্তিরা কত মহৎ কাজে নিয়োজিত। এই মানবিক মানুষদের জন্য আমাদের বিনীত শ্রদ্ধা। এ মানবিক পেশায় নিয়োজিত মানুষদের কতিপয় অনৈতিকতা সম্পর্কে লিখা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা চাই, সরকারের সদিচ্ছায় ডাক্তার দেখানোতে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হোক।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার কোনটিই আমরা ফ্রি’তে পাইনা, পাওয়ার আশাও নেই। আমরা চাইনা চিকিৎসার অধিকারটিও আমাদের ফ্রিতে দেওয়া হোক। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর ‘নো ফ্রি লাঞ্চ’ পড়েছিলাম প্রথম আলো’য়। আমেরিকানরা কাজের বিনিময়ে খেতে বিশ^াসী। ওখানে চিকিৎসা অনেক ব্যয় বহুল হলেও রিক্ত-নিঃস্ব সবাই সুচিকিৎসা পান।
চিকিৎসা শেষে যখন হাজার হাজার ডলারের বিল ধরিয়ে দেয়া হয় তখন রোগী এক সময় বলেন, ৫ ডলার করে কিস্তিতে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করবে। তারপরও ওখানে চিকিৎসা খরচ মাফ নেই। আমরা বাঙ্গালীরাও বলি ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। অর্থাৎ গায়ে তেল মাখতে হলে পয়সা ফেলো। শিক্ষক হিসেবে আমরাও চাইনা কোন ডাক্তারের কাছে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে তাঁদের ফি কম দেই¬¬।
আমরা চাইনা তাঁরা আমাদের ফ্রিতে ব্যবস্থাপত্র দিক। আমরা চাই, সরকার আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দিক, যাতে আমরা প্রয়োজনের সময় পকেট ভারী রেখে ডাক্তার দেখাতে পারি। ডাক্তারের কাছে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে যেন অন্যরকম ভালবাসা পাই, যে ভালবাসা অধ্যয়নকালীন শিক্ষকরা তাঁদের দেখিয়েছেন।
গাদ্দাফির দেশে চিকিৎসা সেবা ফ্রি ছিলো। আমাদের দেশে তা ফ্রি না হলেও আমরা গর্বিত যে, আমাদরে দশেরে কোটি কোটি মানুষ এখনও অনেকটা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।
৫ টাকা টোকেনের বিনিময়ে যে মানের সেবা দেওয়া হয়, সেটি বিশ্বের আর ক’টি দেশে চালু আছে আমার জানা নেই। গর্বে আমার বুক ভরে যায়। যাঁরা দেশ চালান সেই কর্তাদের অসুখ বিসুখ হলে মাউন্ট এলিজাবেথ এ চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতা আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা সংবিধান বোধহয় তাঁদেরকে সেই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু যাদেরকে জাতি গড়ার কারিগর বলা হয় সেই গোত্রের আমরা বেসরকারী শিক্ষকেরা মাউন্ট এলিজাবেথে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিনা (তেমন কঠিন অসুখ থেকে পরওয়ারদেগার আমাদের দুরে রাখুন)।
আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদেরকে এমন একটি ‘আইডি কার্ড’ বিতরণ করা হোক যে কার্ড দেখিয়ে দেশের যে কোন ডাক্তারের চেম্বারে ভিআইপি মর্যাদায় চিকিৎসা সেবা পাই। ফ্রি ব্যবস্থাপত্র নয়, সম্ভব হলে শিক্ষকদের ডাক্তার ফি পরিশোধ করবে আমাদের সরকার।
আমরা বেসরকারী শিক্ষকদের চিকিৎসাভাতা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ টাকায়! কিন্তুএটি খেয়াল রাখা সরকারের কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে কি না জানিনা যে, বর্তমানে বেসরকারী মেডিকেল থেকে পাস করা যে কোন এম.বি.বি.এস ডাক্তারের দর্শন ফিও ২০০ টাকা। এই টেস্ট, সেই টেস্ট সব আমরা করাবো - সমস্যা নেই। মানবিক দায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে দিন।
ঈদগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে দেখতে পেয়েছি আমার ছেলের ব্যবস্থাপত্র ডাক্তারই লিখছেন, চারপাশ ঘিরে থাকা এম.আরদের দ্বারা ব্যবস্থাপত্র লিখানো বন্ধ হয়ে গেছে দেখে আপ্লুত হয়েছি। আমরা চাই, এ ব্যবস্থা সব সময় চালু থাকুক। আমরা চাইনা, কোন হাসপাতালে কোন এম.আর ব্যবস্থাপত্র পত্র লিখার পরে তাতে ডাক্তার কেবল স্বাক্ষর করুক। গভীর যে বিশ্বাসে আমরা তাঁদের কাছে যাই, সে বিশ্বাসের ভিত আরও দৃঢ় হোক। স্কুলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া এক মেয়েকে নিয়ে একদিন সকাল ১০টার দিকে সরকারী হাসাপাতালে গেলে ডাক্তারকে হাসপাতালেই পেয়েছি।
আমরা চাই, ডাক্তারেরা অফিস টাইমের পুরোটাই সরকারী হাসপাতালে থাকুক যাতে আমরা স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা পেয়ে ধন্য হই।
ফুয়াদ আল খতিব হাসপাতালে ডাক্তার আবদুল্লাহ আল মাসুমের নিকট একবার গিয়ে আমি অভিভূত হই। উনার পেশাগত ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপত্র সাক্ষ্য দিয়েছে উনি একজন মানবিক ডাক্তার। ডাক্তার চেম্বার ছেড়ে যাওয়ার সময় আরও অবাক হই, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এম.আর’দের সাথে তিনি অযথা সময়ক্ষেপণ করেন নি। বোধ হয় উনি জেনেরিক নামেই ওষুধ লিখতে পছন্দ করেন।
আমরা চাই, ডাক্তারের চেম্বারে রোগীদেরই প্রবেশাধিকার থাকুক। কোন ডাক্তারের চেম্বারে সিরিয়ালে একজন রোগী বের হওয়ার পর প্রত্যেকবারই একজন করে এম,আর প্রবেশ না করে রোগীদের জন্য বরাদ্দ সময়ের সবটুকুই রোগীদের পেছনে ব্যয় করার পরিবেশ নিশ্চিত হোক। কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতালে একবার ছেলেকে নিয়ে যাই। রোগীর কোন বিষয়ে অস্পষ্ট হলে দেখেছি একজন অন্যজনের পরামর্শ নিচ্ছেন, চেয়ার ছেড়ে রোগীর নিকট গিয়ে দু’জনে মিলে পর্যবেক্ষণও করছেন। বিষয়টি আমাকে তাঁদের চিকিৎসার প্রতি বিশ্বাস বাড়িয়েছে।
আমরা চাই, সব হাসপাতালে মানবিক প্রয়োজনে ও যথোপযুক্ত চিকিৎসার খাতিরে আমিত্ব পরিহার করে এক ডাক্তার পাশে থাকা অন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবেন।
ককসবাজার সরকারী কলেজের ইংরেজী বিভাগের এক শিক্ষক একবার ডেন্টিস্ট বশির আহমদের নিকট গেছেন। ভেতরে উনি রোগী দেখছেন। স্যার রিসিপশনে বললেন, ভেতরে গিয়ে বল এক স্যার এসেছেন দাঁতের সমস্যা নিয়ে। ছাত্রজীবনে আমি অবাক হয়েছি রোগী দেখা অসম্পূর্ণ রেখেই ডাক্তার উঠে এসে স্যারকে নিয়ে যান।
আমরা চাই, শিক্ষকের প্রতি ডাক্তারের এই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ যেন দেশের সবখানে ছড়িয়ে যায়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ করে আমার বাবার ভয়ানক শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ফোন দেই ডাক্তার নজরুল ইসলামকে। জানতে পারি উনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। অবস্থা জানানোর পরে তিনি আমার বাবার চিকিৎসা করার জন্য গভীর রাত অবধি হাসপাতালে থেকে যান। চিকিৎসা পরবর্তী বাবার মোটামুটি সুস্থ্যতা এলেও পরওয়ারদেগারের ডাকে পরদিন সকাল ১১ টায় পাড়ি দেন পরপারের সুশীতল ছায়ানীড়ে।
ঐ রাতে ডাক্তার দেখাতে না পারলে আজীবন বিবেকের তাড়নায় বিদগ্ধ হতাম। আমরা চাই, বেসরকারী শিক্ষকদের জরুরী প্রয়োজনে ডাক্তাররা এমন মানবিক হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে আমাদের ধন্য করবেন। বর্তমানে যে কোন ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশের পূর্বে রিসিপশন পার হয়ে যেতে হয়। কাছের ডাক্তার হলেও টাকা পরিশোধ পরবর্তী চেম্বারে ঢুকলাম সমস্যা নেই। শিক্ষকদের লাইনে বসিয়ে রাখা হলে তা শিক্ষকদের মানসম্মানে আঘাত করে এটি কঠিন সত্যটি যেন সবার মাঝে সঞ্চারিত হয়।
সরকারী টাইমে আমাদের যেন চেম্বারের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া না হয় বিষয়টি লক্ষ্য রাখুন। অথবা আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করুন যাতে চেম্বারের টিকিট নিয়ে ওখানেই দেখাতে পারি, যেন তাদের প্রদেয় সব টেস্ট করাতে পারি, যেন তাদের দেওয়া প্রয়োজনীয় ও কম প্রয়োজনীয় সব ঔষুধ কিনতে পারি।
২৩ এপ্রিল সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে যা যা দরকার সব করবে তাঁর সরকার। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সেই শিক্ষক সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধির সাথে এ মহতি কাজটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিন।
সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়া দরকার। শুধু সালাম পাওয়ায় আমাদের পেট ভরেনা। তাই মাঝে মাঝে শরীর বিদ্রোহ ঘোষনা করে। ‘‘গ্যাস যদি অর্ধেক নিই আর আটআনা কম হবে না?’’ - বলে আমরা শিক্ষকরা কারো নিকট নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চাইনা। পরম মমতা ও সম্মানের সাথেই যেন আমরা ডাক্তার দেখাতে পারি, সক্ষমতা যেন আমাদের হয় তাও লক্ষ্য রাখুন।
ব্লগের ডাক্তার সংক্রান্ত একটি লেখার চুম্বক অংশ ভিন্ন আঙ্গিকে বলে লিখাটি শেষ করবো। সিনেমার শাকিবেরা বিপদগ্রস্থ মানুষকে উদ্ধার করে বিনিময়ে কেউ পান নায়িকাকে, কেউ পান রাজত্বসহ রাজকন্যা কিংবা কেউ হয়ে যান দেশের নেতা। হৃদয়াবেগে আমরা হাততালি দিই। আমরা শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর, জাতি গঠনের স্থপতি। সারাজীবন মানবিক ও উন্নত হৃদয়ের মানুষ তৈরীতে যে শিক্ষকেরা ব্যাপৃত, বিনিময়ে সে শিক্ষকেরা কি পাচ্ছি, সভ্য জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইলে তা ভাবার সময় হয়েছে।
সরকার আমাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুবিধাও বৃদ্ধি করবে, সমাজের সর্বস্থরে শিক্ষকদের জন্য সত্যিকারের মর্যাদার আসন অধিষ্ঠিত করবে - এ মানবিক দাবী পূরণের উদ্যোগ নিন। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় আমাদের উর্বর সময়গুলো শিক্ষার্থীদের সৃজনীলতা বিকাশেই ব্যয় হবে, অনন্য জাতি গড়ার কাজে আমাদের দায়বদ্ধতা আরও বৃদ্ধি পাবে - কথা দিলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।