জন্মের পর পরই বাব-মা টের পেয়ে যান একমাত্র আদরের সন্তানটির একটি ঠোঁট কাটা। একেতো মেয়ে তার উপর বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিবেশ। মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা উদ্বিগ্ন তোলে বাবাকে। কিছুদিন যেতে না যেতেই টের পান মেয়েটির রক্তের প্যালেটেও সমস্যা। প্রমাদ গোনেন তিনি।
বাংলাদেশে এর চিকিৎসা বিরল, ব্যয়বহুল। বিদেশে নিয়ে গিয়ে বারে বারে চিকিৎসা করার সামর্থ্য তার নেই। তা হলে কি হবে? সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই দেশে ছাড়েন মোহাম্মদ নুরুল হুসাইন। বাংলাদেশ থেকে ইরান, আবার বাংলাদেশে ফিরে আসা। পরে থাইল্যান্ড, জাম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এই ভাবে দেশে দেশে জীবিকার সন্ধান।
শেষমেষ ২০০১ সালে থিতু হন অস্ট্রেলিয়ায়। এই ভাবে দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে আয়ের প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে চেয়েছেন তিনি যাতে মেয়ের চিকিৎসা ব্যাহত না হয়। বারে বারেই সার্জারি করাতে হয়েছে তার, কয়েকবার হয়েছে ব্যাংককে, সবশেষে অস্ট্রেলিয়ায় চূড়ান্ত সার্জারি।
আদরের সেই একমাত্র কন্যা কায়হানা তাহসীন হুসাইন আর বাবা মোহাম্মদ নুরুল হুসাইন এখন পরষ্পরের প্রতিদ্বন্ধী। মাঝখানে তিন সদস্যের পরিবারের অপর সদস্য শাহেদা ইয়াসমিন হুসাইনের লাশ।
টানা তিন বছর ধরে আইনি লড়াই চলেছে বাবা আর মেয়ের মধ্যে। বাবার দাবি তাদের কন্যা খুন করেছে তার মাকে। তাকেও খুন করার চেষ্টা করেছিলো সে। যমে মানুষে টানটানি করে ডাক্তাররা বাঁচিয়ে তুলেছে তাকে। আর মেয়ে বলছে বাবাই মেরে ফেলেছে তাঁর মাকে।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে আদালত স্পষ্ট করে কাউকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করেন নি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ব্রেসবোন সুপ্রিমকোর্ট কায়হানাকে তার মা হত্যার দায় থেকে খালাস দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় এক বাংলাদেশী পরিবারের মর্মন্তুদ এই ঘটনাটি পশ্চিমা মিডিয়ায়ও ব্যাপক তোলপাড় তুলেছে।
ঘটনার সূত্রপাত সাইবার প্রেমকে ঘিরে। সময়কাল ২০০৬ ।
নুরুল হুসাইন তখন জীবিকার টানে কাজ করেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নিভৃত এক অঞ্চলে। গোল্ডকোষ্ট এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করেন মা শাহিদা হুসাইন। এডিলিয়েডের পেমব্যাক কলেজে পড়াশুনা করে তখন মেয়েটি। মেয়ের ইচ্ছেতেই ব্যয়বহুল স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছন তারা। তার মাঝেই মা টের পান, গভীর রাত অবধি মেয়ে তাদের কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে।
দু একবার কম্পিউটারের উপরই ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছেন মা। বাবা পাঁজাকোলা করে এনে বিছানায় শুয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু মায়ের মন! সতর্ক হতে শুরু করেন তিনি। টের পান রাত গভীর হলে মেয়ে তার কারো সঙ্গে খোশ গল্পে মেতে উঠে। মেয়েটির বয়স তখন মাত্র সতেরো।
একদিন হাতে-নাতে ধরে ফেললে মেয়েটি স্পষ্ট করেই মাকে জানিয়ে দেয় তার সাইবার প্রেমিক ব্যানের কথা। ইলিভেন গ্রেডের ছাত্র ব্যান থাকে সিডনিতে, সে তার কাছে চলে যেতে চায় সে কথা বলতেও দ্বিধা করেনা কায়হানা। কায়হানা জানায় ব্যানকে পেতে সে প্রয়োজনে খ্রীষ্ঠান হয়ে যেতেও প্রস্তুত। মেয়ের এই ঘোষনা মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারটির ভিতকেই নাড়িয়ে দেয়।
কায়হানার বাবা মোহাম্মদ নুরুল হুসাইন তখন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।
সামাজিকতা,ধর্ম- সবকিছুই তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। শুরু হয় মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা, বাঙালি কায়দায় শাসন। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, খ্রীষ্টান হলে, ব্যানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সে তার মেয়েকেই ত্যাগ করবে। এমনি অবস্থায় কায়হানা নিজেই ত্যাগ করে বাবা মাকে, পালিয়ে চলে যায় সিডনি, গিয়ে ওঠে তার সাইবার প্রেমিকের কাছে। বাবা মাও ছুটে যান সিডনি।
শ্মরণাপন্ন হন পুলিশের। আঠারো বছর না হওয়ার সুবাদে কায়হানাকে ফিরে আসতে হয় বাবা মার সাথেই।
কিছুদিন পর মা শাহেদা হুসাইন মেয়েকে নিয়ে যান বাংলাদেশে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। ফিরে এসে আবার বসবাস শুরু করেন গোল্ডকোষ্ট এর অ্যাপর্টমেন্টে। শুরু হয় নতুন করে জীবন গড়ার প্রক্রিয়া।
সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয় তাদের। মেয়েকে বন্ড ইউনিভার্সিটির মতো ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেবার পরিকল্পনাও করেন তিনি। কিন্তু হায়! নতুন জীবনই আসে তাদের, সেই জীবন আনন্দের নয়, মর্মন্তুদ এক ট্র্যাজেডির। মা শাহিদা হূসাইন ছুরকাগাতে প্রাণ হারান আর মৃতপ্রায় অবস্থায় নুরুল হুসাইনকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। মাকে খুন আর বাবাকে খুন করার চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় কায়হানাকে।
সাইবার প্রেমের টানে জন্মদাত্রী মাকে ছুরি মেরে খুন করা বাঙালি তরুনীর কাহিনী প্রতিটি মানুষকেই ভীষন নাড়া দেয়।
নুরুল হুসাইন এবং মেয়ে কায়হানা পরষ্পরকে দায়ী করে এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে। ঘটনা সম্পর্কে নুরুল হুসাইনের ভাষ্য, ঘটনার দিন তিনি কাজ থেকে বাসায় এলে মেয়েই দরজা খুলে দেয়। তাঁকে নিয়ে যায় বেড রুমে । বলেছে ‘বাবা চোখ বন্ধ করো তোমার জন্যে সারপ্রাইজ আছে।
’ তিনি চোখ বন্ধ করে হাত পেতে বসেছিলেন। পরমুহুর্তেই প্রচণ্ড বেদনায় চিৎকার করে উঠেন। মেয়ে তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। তিনি শুনতে পান মেয়ে তাকে বলছে, ‘তোরা দুজনেই মর’। চোখ খুলে দেখেন অদূরেই শাহিদার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে।
কিন্তু কায়হানার বক্তব্য সম্পূর্ণ উল্টো । সে পুলিশকে বলেছে, বাবাকে সে বেডরুমে বসিয়ে চোখ বন্ধ করতে বলে। বাংলাদেশ থেকে আনা একটি উপহার সে বাবাকে দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিলো। সে যখন অন্যঘর থেকে উপহারটি আনতে যায় তখনি বেডরুমে চেঁচামেচি শুনতে পান। বাবা চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন না, কিন্তু অন্তত রাগত স্বরে কথা বলছিলেন।
সে দৌড়ে বেডরুমে যায়, চোখের পলকে তার বাবা মায়ের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়। কায়হানা জানায়, আমি বুঝতে পারি প্রথমবারের আঘাতটা লাগেনি, কিন্তু দ্বিতীয়বার রক্ত বের হয়ে আসতে দেখি। আমি পাথর হয়ে যাই। কি করতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। দৌড়াতে থাকি।
বাবাও পেছনে পেছনে আসতে থাকেন। তার বুকেও রক্তের চিহ্ন দেখি। ’ কিন্তু নিজের পেটে নিজেই কিভাবে ছুরি বসিয়ে দিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে কায়হানা বলেছে, সে জানে না ।
প্রথমটায় পুলিশও কায়হানার কথাই বিশ্বাস করে ফেলেছিলো, হুসেইনই তার স্ত্রীকে খুন করেছে। কিন্তু কায়হানার রুমে ‘হাউ টু কিল ইউর প্যারেন্টস : এ কমপ্লিট গাইড’ নামের একটি স্ক্র্যাচ বুক পাওয়ার পর পুলিশের ভাবনায়ও পরিবর্তন আসে।
পুলিশ অবশ্য তার সাইবার প্রেমিকের সঙ্গে চ্যাটিং এর কথাবার্তাও উদ্ধার করে যেখানে কায়হানা স্পষ্ট করে তার প্রেমিককে বলেছে, ব্যানকে পেতে সে প্রয়োজনে তার বাবাকে খুন করে ফেলবে।
তিন বছর পর গত সপ্তাহে মামলাটি যখন আদালতে উঠে তখন নতুন করে আবার পরনো সব ঘটনা সামনে চলে আসে। কায়হানার পক্ষের আইনজীবী অবশ্য শুরু থেকেই বলছিলেন তিনি প্রমান করবেন নুরুল হুসাইনই তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। ছুরিকাহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নার্সকে নাকি নুরুল হুসাইন বার বারই বলেছেন ‘আমি মুসলমান । আমি যা করেছি তার জন্য আমার আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া উচিৎ।
আমার বেশি করে নামাজ পড়া উচিৎ। ’ নুরুল হুসেইনের এই বক্তব্যটিই কায়হানার আইনজীবী জোড়ালোভাবে আদালতে তুলে ধরে বলেন হুসেইনই তার স্ত্রীকে খুন করেছে। হুসেইন অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, ‘হাসপাতালে সে কি বলেছে তা সে মনে করতে পারছে না। ’ কায়হানার আইনজীবীর পাল্টা প্রশ্ন ছিলো মনে করতে পারছেন না, কিন্তু অস্বীকার করছেন না, এইতো?’ ।
টানা ১২দিন শুনানী চলেছে বেসবোর্নের সুপ্রীমকোর্টে।
কায়হানা, তার বাবা ছাড়াও পুলিশ, হাসপাতালের নার্স এমনকি কায়হানার সাইবার প্রেমিককেও ডাকা হয় বক্তব্য দেওয়ার জন্যে। বারো দিন পর এক লাইনের একটি ঘোষনা দেয় আদালত, ‘কায়হানা খুনের দায়ে দোষী নয়। ’ তাহলে কে খুন করলো শাহিদা হুসেইনকে? নুরুল হুসেইন নিজে? আদালত তার নির্দেশনা বা রায়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কিছু বলে নি। পুলিশও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি তারা শাহিদা হুসেইনের খুনের রহস্য উদঘাটনে আবারো কার্যক্রম শুরু করবে কী না। -সুত্র: http://www.notundesh.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।